কবিতা
১) সৈকত পাল মজুমদার
২) গোবিন্দ তালুকদার
৩) উত্তম কুমার মোহন্ত
৪) দিগন্ত কুমার দাস
৫) অজিত ঘোষ
৬) সুজন মন্ডল
অনুগল্প
১) প্রদীপ কুমার দাস
গল্প
২) অমর কুমার পাল
সম্পাদকের কথা
আজকে আমরা এক সংকটময় যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। বিগত কয়েক মাসে অতিমারী কোভিড-19-এর থাবায় আমরা আমাদের দেশের বন্ধু, ভাই, বোন ও পরম আত্মীয়দের হারিয়েছি। তাদের প্রতি জানাই গভীর শোক জ্ঞাপন। এই অতিমারীতে আমাদের দেশের শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ এক ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। আতঙ্ক ও ভয় কাটিয়ে আমরা আলোর পথে পা বাড়িয়েছি নতুন করে। সাহিত্যের আঙিনায় দেখতে দেখতে অঙ্কুরোদ্গম এগিয়ে চলেছে রাজ্যর কোণে কোণে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের ভীড়ে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে এগিয়ে চলেছি আমরা দক্ষিণ দিনাজপুর অঙ্কুরোদ্গমের সকল সদস্যা ও সদস্যবৃন্দ। ২০১৮ তে কয়েকজন সুহৃদয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী বন্ধুর হাত ধরে শুরু হয় দক্ষিণ দিনাজপুর অঙ্কুরোদ্গমের পথচলা।
বিগত দিনে অঙ্কুরোদ্গমের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের অনুষ্ঠানে এই জেলার বিভিন্ন গুণীজনদের উপস্থিতি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।
দিনাজপুর একটি ছোট জেলা। এখানকার ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। তা সত্ত্বেও দিনাজপুর সাহিত্য, নাটক ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।
এই জেলার ঐতিহাসিক প্রাচীন রাজার গড় যা বানগড় নামে পরিচিত সারা বাংলার মধ্যে বিশেষ পরিচিতি ঘটিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরকে। আমাদের জেলার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী সকলের এক বর্ণাঢ্য মেল বন্ধনে দক্ষিণ দিনাজপুর অঙ্কুরোদ্গম এই জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে এই আশা রাখি। এই জেলার সকল কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীবৃন্দের হাত ধরে অঙ্কুরোদ্গমর প্রচেষ্টা সফল করে তুলতে পারব। আসুন আমরা সবাই জাত-পাত, ধর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে. অঙ্কুরোদ্গমের হাত ধরে সাহিত্যচর্চাকে আরও সমৃদ্ধশালী করে তুলি।
প্রদীপ কুমার দাস
সম্পাদক
দক্ষিণ দিনাজপুর অঙ্কুরোদ্গম
আজ সবার সামনে বাবা
বাংলাভাষায় বক্তব্য রাখছে,
অথচ যে-কিনা
মা গলা ছেড়ে বাংলাগান
গাইছে,
অথচ যে-কিনা
ইংরেজি ছাড়া ভাবেনা
ছোট্ট মেয়েটিকে রাইম ছেড়ে অনেকদিন পর
ছড়া শেখানো হয়েছে।
মেয়েটি বুঝেছে
আজ একটি বিশেষ দিন
যেমন দুর্গাপুজার অষ্টমী এলে
বাবা জিন্স ছেড়ে ধুতি পরে,
ঠিক তেমনি
আজ বাবার ছায়াপথে
কোনও ইংরেজি নেই
বর্ণমালার দুপুরে মায়ের
শাড়ীর থেকেও ঝলমল
করছে মা ও বাবার বাংলা
উচ্চারণ,
সবটা না বুঝেও
ছোট্ট মেয়েটি
মিটিমিটি হাসছে
উঠোনে কাপড় টাঙানোর দড়িতে ঝুলছে সারি সারি কালো রঙের ওড়না
সায়া ব্লাউজ প্যান্ট লুঙ্গি শাড়ি
শুকানোর জন্য।
শোক কি কখনো শুকিয়ে যায়!
কালো তো শোককে আরো তীব্র করে , দুঃখের প্রকাশ।
কালো কুকুরছানাটি দরজায়।
কুঁইকুঁই শব্দে মায়ের খোঁজে।
যে চলে যায় আকাশের তারা হয়ে, নীরবতা মাখিয়ে
কোনোদিনও হবে না সাক্ষাৎ, তবু মনের ভেতরে
উথালপাথাল ঢেউয়ে তোলপাড়। ভেজা চোখ ভেজা শোক!
মাঝেমাঝে ভুলে থাকবার প্রয়াস, নির্বিকল্প সমাধি!
অনুভবে অতলের আহ্বাণ আকাশের দিকে নিরবধি ।
শীতল স্পর্শের দাগ লেগে থাকে হৃদয়ের জানলায়
উষ্ণতার আদরেও বরফ গলে না। স্মৃতি উথলায়।
মেঘ ছেপেছে আকাশ খানা দিনদুপুরে,
তোমার ছাঁয়া আমার মনের অন্তঃপুরে।
তোমার আলো-ছায়ায় আমি বেগুন পোড়া!
গোড়া কেটে আগায় যেনো জল-ফোয়ারা!
জানি, তুমি ভীষন ভালোবাসতে পারো,
তবু তোমার প্রেমের রঙটি নয়তো গাঢ়।
রাগ করো না- জানি তোমার বাহাদুরি,
জানি তোমার প্রেম নগরে ঘোরাঘুরি!
তুমি ঘুড়ি- লাটাই খানা অন্য হাতে,
তাদের কথায় ওঠো- নামো, চলো সাথে!
দু’দিন পরে কাগজ ছিঁড়ে গোত্তা খেয়ে
কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসো ধেয়ে।
উচিত ছিল তোমার প্রতি ঘৃণা থাকা,
হিসেব খাতায় তোমার আমি হাতে রাখা!
হতে পারি আমি তোমার ,
মূল হিসেবে বাজিমাতে আমিই কিষ্ট!
ছেলে আমি তোমার জন্য বড়োই খাসা!
কারণ আমিই তোমার খাঁটি ভালোবাসা।
তোমরা ঘুমাচ্ছ এখনও, ঘুমাবে আর কত?
পাষন্ডরা পৃথিবীর সুখ- সূর্যকে করছে অস্তমিত ৷
ওঠো, গর্জে উঠুক তোমাদের প্রতিবাদী মুখ,
নতুন প্রজন্মের জন্য পৃথিবীতে নিয়ে আনো সুখ ৷
দূরে ফেলে দাও যত আছে মনের আবর্জনা,
দুর্বলদের পেতে দিয়োনা শত লাঞ্ছনা ৷
দুর্বৃত্ত সৃষ্ট আঁধারেই হোক তোমাদের পথ চলা,
পৃথিবীকে করে তোল আবার সুফলা।
নিজেদের জীবন যতই হোক বিপন্ন,
জীবনকে করতে দিয়োনা পাষণ্ডের পন্য।
যে শিশুরা এখনো পড়ে আছে আস্তাকুঁড়ে,
তাদের সুখ- স্বর্গের জন্য অবিরাম যাও লড়ে।
সুখী হতে পারবেন না কখনো অন্যকে রেখে নরকে,
বিপ্লবের অস্ত্র তুলে নাও আঁধারেই থেকে।
আঁধার কেটে যাবে, ফুটবেই ভোরের আলো,
অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবার প্রতিবাদের আগুন জ্বালো।
ধুলো জমা বাংলা বইয়ের মুখে মৃদু হাসি
শীতঘুম ভেঙে দেবার চলছে প্রস্তুতি পর্ব৷
শিমূলে আড়াল করে শহীদের রক্ত স্মৃতি
ইংরেজি এঁটো শিশু, একুশ মোদের গর্ব৷
তারপর জমে জমে সয়ে সয়ে হাজার যন্ত্রণা
যারা ভাঙালো ঘুম, তাদেরই ঘুম ভাঙবে না।
আজ আমাদের চরমতম শোকের দিন
এদিনেই জিন্নার জালিম বাহিনী প্রচন্ড হিংস্রতায়
ঝাঁঝরা করেছিল বর্ণমালার শরীর—
তবু পারেনি সব অক্ষর মুছে দিতে…!
প্রতিরোধের মশাল হাতে লাখো লাখো রফিক জব্বার
দাঁড়িয়েছিল বুলেটপ্রুফ হয়ে—
আজ আমাদের চরমতম শোকের দিন
তাই বুকের মাঝে জ্বলে আছে সূর্যের মতো একটি নাম :
একুশে ফেব্রুয়ারি…
পুজার বাবা ঠিক করেছে মেয়ের বিয়ের জন্য পুরোহিতের কাছে যাবেনা। কিন্তু শর্মিলার অনেক অনুরোধের পর রাজি হল যে নগেন ঠাকুরকে পুজার বিয়ের দায়িত্ব দেবে। তাই একদিন শর্মিলার অনুরোধে নগেন ঠাকুর বাড়িতে এসে পঞ্জিকা ও গোত্র দেখে বলল -ওরে শর্মিলা তোর মেয়ে জামাইয়ের তো অনেক দোষ ত্রুটি দেখছি। শনি আর রাহু তোর জামাইয়ের ঘাড়ে বসে আছে। এগুলোকে দূর করতে হবে। আর তোর মেয়ের আসে পাশে কেতু ঘুরছে। দুজনের মধ্যে চরম অশান্তি হবে।
শর্মিলা বলল- তাহলে উপায় কি ঠাকুর মশায়?
উপায় একটা আছে।
কি উপায় ?
আমাকে যজ্ঞ করতে হবে। আর আমি মন্ত্র পড়ে ওসব দূর করে দেবো। চিন্তা করিস না। তবে দক্ষিণাটা বেশি লাগবে। যা দিন কাল পড়েছে। আকাশছোঁয়া জিনিসের দাম।
এতক্ষণ রমেশ সব শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আমি কিন্তু কন্যাদান করব না।
নগেন ঠাকুর বলল, সে কিরে ? এ তো ঘোর পাপ, যাকে বলে ঘোর কলি।
রমেশ বলল- মেয়টাতো গরু, ছাগল কিংবা দানের সামগ্রি নয় যে -ওকে দান করব। ওর শ্বশুরবাড়ি যদি ভাল না লাগে আমার কাছে ফিরে আসবে। তাছাড়া একজন পুরুষ মানুষের সাথে একজন মেয়ে মানুষের বিয়ে হবে। তারা এক সঙ্গে সুখে দুঃখে থাকবে একে অপরকে ভালোবেসে। তাই কন্যাদান কথাটাই মনুষ্যত্যের অপমান ।
নগেন ঠাকুর রেগে গিয়ে বলল- ঘোর পাপ, শর্মিলা তুই রমেশ কে বোঝা। আমি বাড়ি গিয়ে ওর জন্য রুদ্রাক্ষের মন্ত্রপুত মালা এনে দেবো। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
দুবছর পর হঠাৎ রমেশের মেয়ে পূজা রাস্তায় নগেন ঠাকুরকে দেখে প্রণাম করে বলল, ক্ষমা করবেন জেঠু , বাবারা কথায় রাগ করবেন না। আসলে বাবা ওরকমই যুক্তিবাদী। তবে যাইহোক আমাদের কোর্টম্যারেজ হলেও তিন বছর থেকে সুখেই আছি। মা আপনার কথা বলছিল। একদিন বাড়িতে এলে জামাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিব। চলি। আসবেন কিন্তু।
এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বার । সঙ্গে ওষুধের দোকান । বাইরে ডাক্তারবাবু এল. দাসের নাম লেখা বোর্ড । সমস্ত রকমের মনোরোগের চিকিৎসা করা হয় বলে গ্যারান্টি দেওয়া রয়েছে । শতাধিক মানুষের লাইন ।
আনন্দবাবুর সিরিয়াল নম্বর বাহাত্তর । সশরীরে হাজির না হলে নাম লেখেন না ডাক্তারবাবু । তাই সকাল আটটায় এসেছেন তিনি, এখন দুপুর দেড়টা । অজপাড়ায় বাড়ি । সাইকেলে সাত কিমি, অটোতে দশ এবং শেষে বাসে করে পনের কিমি আসতে মোট ঘন্টা তিনেকের ধাক্কা । ভোর পাঁচটায় বেড়িয়েছিলেন বাড়ি থেকে তিনি ।
আড়াইটার দিকে ডাক এল ।
কী সমস্যা হয় বলুন ?
সমস্যা কিছুই না ডাক্তারবাবু, আবার অনেক কিছুই ।
এমন সমস্যা তো বাপের জন্মেও শুনিনি ! খুলে বলুন ।
ষাটোর্ধ্ব হলেও আনন্দবাবু ধুতি-পাঞ্জাবিতে বেশ সুদর্শন পুরুষ । গরমে ঘামছেন দরদর করে । তাই কি খুলবেন বুঝতে না পেরে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবিটাই খুলতে গেলেন ।
আরে মশাই করছেন কী ! পাঞ্জাবি খুলছেন কেন ?
আপনিই তো খুলে বলতে বললেন ডাক্তারবাবু ।
পাগল একটা । মনে মনে বলে সজোরে বললেন, আরে মশাই আপনার সমস্যাটা খুলে বিস্তারিত বলুন ।
ডাক্তারবাবু আমি এক অশান্তিতে ভুগছি বুঝলেন । কোথাও কখনো শান্তি পাচ্ছি না । এক অস্থিরতা যেন সবসময় আমাকে গ্রাস করে খাচ্ছে । কোত্থাও একটু শান্তি পাই না ।
আপনাদের পরিবারে কি এইরকম সমস্যা আগে কারো ছিল ?
একেবারেই না । আমরা গ্রামে খুব শান্তিতে বাস করি ডাক্তারবাবু । পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান আমাদের এখনো আছে । আমাদের বাড়ির সীমানার মধ্যেই আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, লিচু প্রভৃতি গাছ আছে । তাতে হরেকরকমের পাখি সবসময় লুকোচুরি খেলে । কলতানে ভরে থাকে । বাড়ির সীমানায় ঢুকলেই মন প্রশান্তিতে ভরে যায় । কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি গত তিন-চার বছর ধরে শান্তি পাচ্ছি না । ভালো করে শান্তিতে খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, কারো সঙ্গে শান্তিতে আড্ডা মারতেও পারি না । বুকের ভেতর কেমন যেন এক অস্থিরতা সবসময় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার ।
কথাগুলি বলতে বলতে মুখ রক্তিম হয়ে গেল আনন্দবাবুর ।
আচ্ছা আপনার পরিবারে কি নতুন কিছু ঘটেছে বিগত তিন চার বছরের মধ্যে ? এই ধরুণ ছেলে-মেয়ের বিয়ে, মামলায় হার, নিকটজনের মৃত্যু, স্ত্রীর অবাঞ্চিত আচরণ — এই রকমের কিছু ?
কই, না তো !
আপনার অস্থিরতা কখন বেশি হয় ? রাতে না দিনে ?
এই ধরুণ সকালের দিক থেকে শুরু হয় আর সারাদিন চলে । সারাদিন শান্তি পাই না । ভেতরটা শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করে ।
যন্ত্রনাটি ঠিক কীসের ?
কিছু করতে না পারার যন্ত্রনা । এত ধর্ষণ, এত খুন, এত রাজনৈতিক হিংসা ! চারপাশে এত কালোটাকা অথচ নিরন্ন মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ চারিদিকে । এইসব আমাকে ঘুমোতে দেয় না ।
ডাক্তারবাবু হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন সমস্যাটির কথা জানতে পেরে । জিজ্ঞেস করলেন, এই সংবাদগুলি আপনি কোথা থেকে পান ? আরও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ডাক্তারবাবু যেন আনন্দবাবুর ভেতরটা পরিষ্কার দেখতে পেলেন ।
ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন রোগের প্রভাব হিসেবে কি কাজ করছে । রাস্তা না থাক, স্বাস্থ্য না থাক, পেটে ভাত না থাক ঘরে ঘরে আজ টিভি মোবাইল আছেই । যেদিন থেকে মানুষ সংবাদপত্র পড়তে, টিভিতে সংবাদ দেখতে ও সোশ্যাল সাইটে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে সেদিন থেকে অশান্তি লেগেছে মনে । পেইড ও ফেক নিউজে ভরা গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভ আজ অসুস্থতা বৃদ্ধির অন্যতম উপায় । তাই তিনি বললেন, আজ থেকে পেপার, টিভির খবর ও ফেসবুক দেখা বাদ দিন । দেখবেন সব অস্থিরতা দূর হয়ে যাবে।
কবিতা
……………
বাপ্পাদিত্য দে
প্রদীপ কুমার দাস
দেবাশিস মহন্ত
শুভদীপ আইচ
ভক্তগোপাল ভট্টাচার্য
অশোক সান্যাল
সুজন মন্ডল
গল্প
………
শিশুপঞ্জি : গোলোকেশ্বর সরকার
হে ঈশ্বর … : অজিত ঘোষ
নিবন্ধ
আগ ধান আনা : শুভঙ্কর রায়
যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও
আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
বিষণ্ণতা দিয়ে গড়েছি এই ঘর
পাজরের হাঁড় দিয়ে বোনা দেওয়াল
আর সম্ভবনাময় ফসলের ক্ষেত
এ সবই আমার শেষ সম্বল।
যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও
আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
আকাশের নীচে মেঘেদের দল।
সেখান থেকেই ঝরেছিল
অভিশাপের পোড়া জল।
ধ্বংসের হাওয়া মেখে কী আশ্বাসে
লুঠে নিল প্রকৃতির দল
বিষণ্ণতা দিয়ে গড়া
আমার এই একচালা ঘর।
যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
আমি তো দেখেছি অট্টালিকার অন্ধকার ঘরে নীল জোনাকীর আলো
আকাশ ছোঁয়া প্রাসাদের চূড়া ।
কৈ তাদের চোখে-মুখে তো
তোমার ধুলো পড়েনি ?
দেহ-মন দিয়ে সাম্যের গান
আমিও তো গেয়েছি।
তবে আমার পথেই কেন এত অন্ধকার ?
তবু বাঁচার স্বপ্ন দেখি আমি।
তাই বেঁধেছি ঘর তোমাকে আলিঙ্গন করেই।
আজকাল তুমিও হয়েছ ফন্দিবাজ
কাউকে বিলোচ্ছ মহাভোগ রাজ
কাউকে দিয়েছ ফকিরের সাজ।
থালার ফুটোটা বড় হয়ে উঠলে
জেগে উঠছে ভয়
তোমার দেওয়া এই জন্ম, এই জীবন
থাকবে তো ?
ঐ একরতি মেয়েটি কী জানে,
জীবনের মানে ?
আমি বুঝি ওর উপস্থিতি
বংশের স্মৃতি… বোঝা হয়ে গেছে
ওর চোখের জল আরও বেশী ভারী
দুঃখ-কষ্টে, অনাহারে
যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
শীতের অ্যালবামে শহরের রাস্তায়
কুয়াশার মিছিলে উত্তরের হাওয়া নিয়ে আসে প্রেম….
সরষে ফুলের পাতায় শিশিরের গন্ধ নিয়ে আসে
সোনালী দুপুরের পর্ণমোচী রোদ্দুর
কবিতার হাত ধরে শীতের লিকারে মাপি
স্তূপে জমে থাকা শিলালিপির উষ্ণতা…
পাহাড়ী রূপকথায় মেঘেরা কাছে এলে
জীবনের মলাটে বাঁধি জ্যোৎস্নার রঙ…
ভালোবাসা ছাই হয়ে উড়ে গেলে
রাতের জঠরে লিখে রেখো নগ্ন চাঁদের আর্তনাদ …
শীতের হাফ্-টাইমে কোনো একদিন মুখোমুখি বসে
পিচরাস্তা ছেড়ে ভেসে যাব কুয়াশার বন্দরে।
খুব হাওয়া উঠুক।
মুখে এসে লাগুক উড়ন্ত ওড়না, বান্ধবীদেরও…
কিছুটা বয়স কমে যাক।
টাকে চুল গজাক, আজ বসন্ত…
আমরা যারা ফরটি পার্সেন্ট, বি.এডহীন–
বেসিক-পে, বেসিক-সেন্স,এমনকি বেসিক-ট্রেনিং নেই–
দশটা বছর, অন্তত আরও দশটা বছর
হাওয়া চালু থাকুক।
উড়ন্ত ওড়নার কথা ভেবে
অন্তত আরও দশটা বছর বেঁচে থাকি।
জল থেকে ডিঙিয়ে উঠছে ঘাস
দেবী উঠে আসছেন গত জন্মের অভিশাপ নিয়ে
মুন্ডুহীন কাঠামোর কাছে দু’দন্ড জিরিয়ে নিতে থাকি
দূর আরো মনোরম বেজে ওঠে
চড়াই এর নিঃশ্বাস থেকে উড়ে যায় পাখি
বাতাস নরম হলে গৃহস্থ নিয়মও
নগ্ন ও বেহিসেবি
আমরা এখন সেই সব আম আদমি
স্বপ্ন নিয়ে জন্মাই , দু একটা হাতে ধরে রাখি
হাত ধরে সবাই ঘুরপাক খাচ্ছি
বিশ্বাস করি না, উপায় নেই ।
শ্মশানের ছাই থেকে টাটকা তুলে এনেছি
এ সব গল্পগুজব সব আমার নিজস্ব ,
দলা পাকানো মাংস পিন্ডের ভিতর বসে আছি
হাস্নুহানার গন্ধে বারবার ধোঁকা খেয়ে
বোকা হয়ে বসে আছি।
নিত্যদিনের রক্ত মাংস গাথা কোলবালিশ
ওই দলাপাকানো মাংস পিন্ডের উপর
বসে আছে যুবক যুবতী।
ওরা সব রুলটানা কাগজে লিখে রাখে ,
খেলনা বন্দুক আসলে ওরা ভুসিমাল
নতুন করে প্রতিবন্ধী কালা দৃষ্টিহীন …।
চুম্বনের দাগটুকু ঠোঁট থেকে যেই খুলে পড়ে
অর্কেস্ট্রার সুরধ্বনি মিশে গেল গোঙানির স্বরে
আমরা চুম্বন জাত সেই কথা ভুলতে কী আছে
তাহলে গ্রহণ লাগে মানচিত্রে পাখিদের গাছে
বিশল্যকরণী ঠোঁট আমাদের অনন্ত আশ্রয়
চুম্বনে বিশ্বাস থেকে সূর্য ওঠে আজো গান পায়
মৃত্যু শুধু অনিবার্য পড়ে নিই জন্মের সকালে
তারপর ভুলে গেছি চোখ দুটি আকাশে ছড়ালে
আড়ি দিতে পারব না তাতে করে যা হবার হোক
ভাইরাল জ্বরে ডেকো মুছে দেব সজল দুচোখ
আমি এত ধনী নই সামলাবো মুখ ও মুখোশ
শিখিনি অনেক কিছু অক্ষমতা কিংবা মুদ্রাদোষ l
আমরা কখনও কাছাকাছি ছিলাম না
শুধু গ্ৰহণের আয়ুর মতো কিছুক্ষণ পাশে ছিলাম…!
তারপর নিম্নগতি নদীর মতো যে যার পথে
ভেসে গেছি জীবনের সন্ধানে—
জানি না আজ
কে কতখানি পৌঁছেছি কাঙ্খিত লক্ষ্যের কাছে
তিতিক্ষা বাড়ি গিয়ে গণনা করছে। তিন দিন হয়ে গেল কাজ করা। পঞ্চাশটা বাড়ি হয়ে গেছে। বাড়ি -বাড়ি যাচ্ছে, বাড়িতে কোন কোন শিশু আছে , তারা পড়াশোনা করছে কিনা, নাকি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, পড়াশোনা করলে তারা এখন কোন শ্রেণিতে পড়ে, পড়া ছেড়ে থাকলে তারা কেন পড়া ছাড়ল, তাদের বয়স কত-এসব আরও তথ্য বাবা-মা-অভিভাবকের কাছ থেকে ভাল করে জেনে শিশুপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করছে। কোনও কোনও বাড়িতে শিশু এসে তিতিক্ষার পাশে দাঁড়াচ্ছে, তার লেখা দেখছে। গণনার প্রমাণস্বরূপ তিতিক্ষা বাড়ির দরজায় চক দিয়ে নির্দিষ্ট কথা লিখে আবার অন্য বাড়িতে যাচ্ছে।
তিতিক্ষা আল দিয়ে হেঁটে চলেছে। তিতিক্ষা প্রাইমারি শিক্ষিকা। শ্রীরামপুর বিদ্যালয়ের দিদিমণি। হাতের ব্যাগটা খুবই যত্ন সহকারে সাবধানে নিয়ে চলেছে। ব্যাগের মধ্যে রয়েছে শিশুপঞ্জি। আলের রাস্তা ধরে গিয়ে আলের শেষের দিকে যে- ক’টা বাড়ি রয়েছে সেখানে যেতে হবে তাকে।
এসআই তিন দিন আগে তিতিক্ষাকে অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিল। এসআই যুবক ছেলে। অবিবাহিত। বংশীহারী চক্রে নতুন এসেছে তিতিক্ষা অফিসে এলে এসআই সৌষম্য বলল , “দিদিমণি, আপনাকে আপনার বিদ্যালয়ের পাশের বলিপুকুর সংসদে চাইল্ড রেজিস্ট্রার মানে শিশুপঞ্জির কাজ করতে হবে। শূণ্য থেকে চোদ্দ বছর বয়স অবধি শিশুদের গণনা করতে হবে। বিশেষ -চাহিদা -সম্পন্নদের ক্ষেত্রে আঠারো বছর বয়স অবধি। শিশুরা এখন কী করছে, পড়াশোনা করছে, না পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে- সমস্ত বিষয়টা বিস্তারিত ভাবে নথিভুক্ত করতে হবে। সাতদিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।” তিতিক্ষার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। বলল, “ স্যার, আমি এই কাজ করতে পারব না। এই কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়।” সৌষম্য বলল, “কেন ? “ তিতিক্ষা উত্তর দিল, “ স্যার, আমি নিঃসন্তান।অনেকদিন হল বিয়ে হয়েছে আমার কোনও সন্তান নেই। আর আমাকে দিচ্ছেন আপনি সন্তান গণনার দায়িত্ব, আমাকে দিচ্ছেন শিশুপঞ্জির কাজ ! ব্যাপারটা খুবই কষ্টের, তীব্র যন্ত্রনার, ভীষণ ব্যথার। এই কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়।” সৌষম্য বলল, “এটা সরকারি কাজ। আপনি ছাড়া এই মুহূর্তে কাউকে পাওয়াও যাচ্ছে না। তাই আপনাকেই এ কাজ করতে হবে।” তিতিক্ষা চক্র-প্রধান এসআই-এর কথা উপেক্ষা করতে পারল না। তিতিক্ষা কাজটা করতে রাজি হয়েছিল।
তিতিক্ষার শরীরটা বেশ তরতাজা লাগছে। সারাদেহে সতেজতা। চনমনে মন। আকাশের দিকে তাকাল তিতিক্ষা। আকাশে সাদা মেঘ। পাখিরা দলবেঁধে উড়ে চলেছে। রাস্তার ধার থেকে একটা গাঁদা ফুল তুলে নিল তিতিক্ষা। আলের রাস্তার মাঝে গিয়ে আলের ওপর দু’হাত পাখির ডানার মতো মেলে ধরে একহাতে ফুল অন্য হাতে শিশুপঞ্জি নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে তিতিক্ষা নিজে নিজে বলে উঠল, “ কী ব্যাপার ! শিশুপঞ্জির কাজ করতে গিয়ে আমার বুকের মধ্যে যন্ত্রণা হওয়ার কথা, ব্যথা হওয়ার কথা, কষ্ট অনুভূত হওয়ার কথা কিন্তু আমার বুকের ভিতর আনন্দ হচ্ছে কেন ! আমার বুকের মাঝে সুখ অনুভূত হচ্ছে কেন !
নদীর বাঁধের উপর নির্মিত “বৈকালিক উদ্যান” বহু পরিচিত দুজনের কাছে৷ অনেকবার ওরা এসেছে এখানে৷ বসেছে পাশাপাশি৷ সন্ধের আলো ফোটার পরেও অনেকদিন শেষ হয়নি ওদের কথা বলা৷ সে দিনগুলোতে ওরা অপেক্ষা করত লোডশেডিংয়ে৷ দু’ মিনিট পরেই পুনরায় আলো ঝলমলে হয়ে ওঠার সময়টিতে জড়িয়ে ধরত পরস্পরকে৷ আজও এসেছে দুজনে৷ বহুদিন পরে ওদের ফিরে পাওয়াতেই হয়তো অন্যদিনের তুলনায় আজকের আলোর তীব্রতা বেশি৷
মেয়েটি স্বতঃস্ফূর্ত৷ বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে৷ ছেলেটি কিছুটা তফাৎ-এ দাঁড়িয়ে৷ বিষন্ন প্রকৃতির ছায়া ছড়িয়ে তার মুখে৷ বাদলা দিন৷ লোকজন বিশেষ কেউ আসেনি৷ ওরা দুজন না এলে উদ্যান একা পরে থাকতো৷
“বলো ডেকেছো কেন ?” মোবাইলে মুখ গুজেই বলল মেয়েটি৷ কিছু কিছু সময় ভাষা অধরা থেকে যায়৷ দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটি৷ “কি হলো, বলো৷”
“ঠিক বুঝতে পারছি না , কেন ?” ভাঙা ভাঙা ছেলেটির উত্তর৷
“থাক আর বুঝতে হবে না৷ কি দিতে চেয়েছিলে , দাও৷”
কিছু না বলে হাতের প্যাকেটটি মেয়েটির হাতে দিল ছেলেটি৷
“কি আছে এতে ? “ এবার মুখ তুললো মেয়েটি৷
“খুলে দেখো৷”
কৌতুহলে মেয়েটি প্যাকেট খুলে একঝলক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল , “শার্টটি ফিরিয়ে দিতে পারলে ?”
“না দিয়ে উপায় নেই৷ যেমন সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় তোমার জানা নেই৷”
মেয়েটি উঠে দাড়ালো৷ শ্লথ গতিতে রেলিংয়ের ধারে গিয়ে প্যাকেটটি ছুড়ে ফেললো বর্ষায় ফুলে ওঠা জলে৷ কিছুক্ষন নদীর দিকে চেয়ে থেকে ফিরে এসে বলল , “তোমার আর কিছু বলার আছে ?”
“ না৷ কিছু বলার নেই৷”
“ভালো৷ কিছু যখন বলার নেই তখন এভাবে না ডেকে বনির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারতে৷ অন্ততঃ তোমার সামনা-সামনি হতে হতো না৷”
“সামনা-সামনি না হলে আমি যা মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম তা সম্ভব হতো না৷”
“কি মিলিয়ে নিতে চাইছিলে তুমি ?”
“ছবি৷”
“ কিসের ছবি ?”
“ছয়মাস আগে বইমেলায় তোমায় প্রথম দেখার মুহুর্তে তোমার মুখে যে ছবি ফুটে উঠেছিলো সেই ছবির সঙ্গে এই মুহুর্তের ছবি৷”
কিছুক্ষন থেমে থাকার পরে পুনরায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ সোঁ সোঁ শব্দে বইছে বাতাস৷ সেই বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে গেল মেয়েটির দীর্ঘশ্বাস৷ যেন কিছুটা দেরি হলে তার দম বেরিয়ে যেত৷ মেয়েটি যে নিজেকে স্বতস্ফূর্ত রাখার বৃথা চেষ্টায় ছিল, দীর্ঘশ্বাস তার উজ্জ্বল প্রমান৷ বলল , “ মিলেছে ?”
আগের মতোই বাকরূদ্ধ ছেলেটি৷
দুটো বিচ্ছেদপ্রায় হৃদয়ের পুনরায় এক হবার করুন আকুতি নিয়ে বয়ে চলেছে উদ্যানের পেছনে নতুন জলে ভরপুর নদী৷ সামনে বৃষ্টি৷
ফিস ফিসিয়ে কাঁদছে মেয়েটি৷ পুরুষের কান্না সংসারের পক্ষে অমঙ্গল৷ পুরুষরা কাঁদে না৷ পাথরের মতো ভারী বুকে জমিয়ে রাখে ব্যথা৷ হাতের ছাতা বাতাসে উড়িয়ে ভিজতে ভিজতে চলে যাচ্ছে মেয়েটি৷ ছেলেটি দিশাহীন৷ এখনই না ফেরালে আর কোনদিন ফেরাতে পারবে না৷ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে জমাট ব্যথা উগরে দিয়ে বলে যেতে থাকল, “বিশ্বাস করো তুমি ছাড়া আমার জগৎ অন্ধকার৷ ছবি মিলবে না আমি জানতাম৷ তোমার মুখে প্রথম দিনের সে মায়া রয়ে গেছে৷ আমি বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারবো না, কিছুতেই না৷ দুজনের স্বপ্নগুলোকে এভাবে ভেসে যেতে দিও না , না , না , না …৷
বৃষ্টির জলে মিশে গেছে মেয়েটির চোখের জল৷ নিজের হাত ছেলেটির হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে দু ধাপ এগিয়ে ফিরে বললো, নক্সা ৷
গ্রামীণ লোক সমাজে সংসারে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ও মনস্কামনা পূরণের জন্য নানারকম লৌকিক আচার পালন করে থাকে। তেমনি কৃষির উন্নতির জন্য ও কৃষি কেন্দ্রিক অনেক আচার পালন করতে দেখা যায়। কৃষি ক্ষেত্রের আচারের মধ্যে একটি হলো আগ ধান আনা বা ধানের আগ নেওয়া। কেউ বলেন ‘ধানের আগ লওয়া‘। আবার কোন অঞ্চলে এই আচারকে ‘বাতা ডুগল‘ নামে অভিহিত করেন। মূলত এটি ফসল কাটার পূর্ব-মুহূর্তের আচার-অনুষ্ঠান। এই আচার এর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ধানের অগ্রভাগ ফসলের দেবীর নামে উৎসর্গ হেতু কেটে আনা হয়। তাই হয়তো আগ ধান আনা বলা হয়েছে। আবার এও হতে পারে ফসল কাটার পূর্বমুহূর্তে বা আগমুহূর্তে দেবতার উৎসর্গ স্বরূপ কিঞ্চিৎ ধান্য ফসল গৃহে আনা হয়। তাই হয়তো আগ আনা বা আগে আনা।
এই আচার সম্বন্ধে লোক বিশ্বাস, যেহেতু ফসলের দেবী লক্ষী। লক্ষীদেবী তুষ্ট হলে মাঠের ফসল ভালোমতো ঘরে আসে। লক্ষ্মী দেবীর অন্ন ফসলেই জীবকুল প্রতিপালিত হয়,তাই লক্ষীদেবী অসন্তুষ্ট হলে গৃহস্থের অকল্যান হয়।এইরূপ অন্ধবিশ্বাস থেকে কৃষকরা ফসল কাটার আগে লক্ষী দেবীর উদ্দেশ্যে এই রূপ আচার পালন করে থাকে।
ধানের আগ আনা আচার সম্বন্ধে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন,-‘প্রথম দিন ধান কাটিবার সময় পাঁচটি পাতা গাছের অগ্রভাগ লইয়া ক্ষেত্রে যায়, তাহা সিন্দুর প্রভৃতি মাঙ্গলিক দ্রব্যে অনুলিপ্ত। এই বাতার পাঁচটি ডুগলের সঙ্গে পাঁচটি ধান্যের ছড়া বাধা হয়, তাহাই কৃষকেরা লক্ষীর আসন মনে করিয়া ঘরের কোণে বিশিষ্ট স্থলে তুলিয়া রাখে।‘১। মুসলমান কৃষক সমাজেও এই অনুষ্ঠানটি ধানের আগ লওয়া নামে প্রচলিত আছে। তবে গবেষক ইব্রাহিম খাঁ মহাশয় এটিকে আগ ধান আনা-র অনুষ্ঠান বলেছেন। তিনি আগ ধান আনা সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন-‘ধান পাকলে চাষী পাক-সাফ অবস্থায় খেতে যেত। সঙ্গে থাকত কাশ বা বিন্না ছোপার তিনটি ডাটা। সে ধানের তিন, পাঁচ বা সাতটা শিনজা কাটতো। সেই শিনজা ওই ডাটার সাথে মিশিয়ে কলার কচি পাতায় মুড়ে কাপড় দিয়ে ঢাকত, তারপর তা সশ্রদ্ধ ভাবে মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরত। ধানের সিনজা কয়টি বড় ঘরের মধ্যমখামের আগার দিকে বেঁধে রাখতো। তারপর গোড়ার কাছে সে দুধ ভাত খেত। এতদানুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলত না। ২।
মূলত এটি শস্য পুজারই লুপ্তপ্রায় অবশেষ বলে মনে হয়। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে ধান শস্য পাকলে এই আচার পালন করা হয়। এতে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতের প্রয়োজন হয়না। গৃহস্থ বাড়ির কর্তা ও গৃহিণী পুরো আচারটি সম্পন্ন করেন। বৃহস্পতিবার বা রবিবার সকালে কর্তা স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে ফসল কাটারি বা কাস্তে কলাপাতা নতুন বস্ত্র এবং পূজা উপকরণাদি নিয়ে জমিতে যান। জমির ঈশান কোণে ফসল দেবীকে পূজা দিয়ে ধানের আগ বা শিষ কেটে কলাপাতা ও নতুন বস্ত্রে মুড়িয়ে মাথায় করে বাড়িতে আসে। গোলাঘর বা যে ঘরের লক্ষী গৃহদেবতার আসন থাকে সেই ঘরের সামনে কর্তা দাঁড়ায় এবং গৃহিণী পূর্ব আয়োজন অনুসারে কর্তার পা ধুয়ে দিয়ে প্রণাম করেন। কর্তার মাথায় করে লক্ষীদেবী মাঠ থেকে ঘরে এলেন। গৃহকর্তা ধানের আগা বা শিষগুচ্ছ ঘরের মধ্যমখাম বা খুঁটির উপরিভাগে ঝুলিয়ে রাখে। কেউ আবার গৃহদেবতার আসন মধ্যে রাখে। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে ভিন্নতর পরিসমাপ্তি বা পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়।তবে এই সম্পূর্ণ আচার পালন করতে গৃহকর্তা কোনরূপ বাক্য ব্যয় করতে পারবে না।
ক্ষেত্র সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য ও ইব্রাহিম খাঁ মহাশয় এর তথ্য প্রায় পুরোপুরি একই। আচার বর্ণনায় মিল থাকার কারণ এও হতে পারে যেহেতু উনি বাংলাদেশের সামাজিক ভিত্তির ওপর আচার বর্ণনা করেছেন। আর ক্ষেত্রসমীক্ষার বর্ণনা সংগ্রহ করা হয়েছে পূর্ববঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে উঠে এদেশে আসা কিছু জনজাতির আচার পালনের বর্ণনা পরিলক্ষিত করে।
ধানের শিষগুলো একেক সম্প্রদায় একেক ভাবে সংরক্ষন করে রাখে। মাহিষ্য সম্প্রদায়েরা ধানের শিষ থেকে ধান নিয়ে চাল বের করে এবং সেই চাল অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে গোপাল পূজার প্রসাদ নিবেদন করে এবং সকলেই প্রসাদ গ্রহণ করে। আমার দেশি পলি ও রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা লবান বা নবান্নতে আগ ধানের চাল দিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করে। বৈশ্য কাপালি সম্প্রদায়েরা আজ ধানের শিষগুচ্ছ সযত্নে গোলার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখে, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজার সরার সাথে। বাতা ডূগল, ধানের আগ আনা, বা আগ ধান আনা মূলত একই অনুষ্ঠান, কেবল অঞ্চলভেদে বা সম্প্রদায়গত ভাবে ভিন্ন নাম এবং ভিন্ন রূপে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
উত্তরবঙ্গ তথা সারা বাংলা মূলত কৃষি প্রধান অঞ্চল।কৃষি প্রযুক্তি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের পূর্বে শুধুমাত্র বৃষ্টির জলের উপর এবং জৈব-রাসায়নিক এর উপর নির্ভর করে চাষাবাদ হত। তাই বর্ষাকালের চাষাবাদই ছিল প্রধান।আর বর্ষাকালীন ফসল কে কেন্দ্র করে বা ফসলের জন্যই কৃষিভিত্তিক আচারগুলি প্রবর্তিত হয়েছিল। বর্তমানে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সারা বছর চাষাবাদ হচ্ছে।গ্রীষ্মকালীন ধান চাষ ও বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শুধু বর্ষাকালীন নয়, গ্রীষ্মকালীন ধান কাটার পূর্ব-মুহূর্তের আগ ধান আনা-র আচার পরিলক্ষিত হয়।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে গ্রাম বাংলার অনেক লৌকিক আচার আজ বিলুপ্ত হবার পথে। অনেক বিলুপ্ত আচারের মধ্যে ধানের আগ আনা বা আগ ধান আনাও প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমান সময়ে কিছু কিছু গৃহস্থবাড়িতে এই আচার দেখা গেলেও আগের মত জৌলুস আর নেই । আগামী দুই – তিন দশক পরে হয়তো এই আচার কালের অতলে হারিয়ে যাবে।