সহঃ সম্পাদকের কথা – পলাশ দাস

পত্রিকা সম্পাদকের কথা – সায়ন দে

 

কবিতা

১. অশোক কুমার চক্রবর্ত্তী – সপুষ্পক

২. আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় – পরিণতি

৩. শ্যামল কুমার বেরা – আমি পথ শিশু

৪. শিখা পাল মন্ডল – অকাল বসন্ত        

৫. অনামিকা নন্দী – ওরা

৬. অঞ্জন সেনগুপ্ত – ঘর

৭. অমিয় কুমার রীত – গান

৮. শুক্লা রীত – প্রেমিকার ভূমিকায়

৯. তাপস মাইতি – জীবন সায়রে

১০. প্রিয়াঙ্কা ব্যানার্জী – কথা দিলাম

১১. জয়প্রকাশ হালদার – প্রত্যয়

১২. মন্দিরা দে – নীল আকাশের পাখি

১৩. অঞ্জন কুমার মজুমদার – প্রার্থনা

১৪. রিঙ্কু চ্যাটার্জী – আগুন

১৫. রূপালী সেনগুপ্তা – অপেক্ষা

১৬. সুকান্ত ঘোষ – অতীত খামে হাত দিও নাসুধী

১৭. রিতা দে – সাধনা

১৮. সুপর্ণা বেরা – যদি পারোও কোনো দিনও

 

অনুগল্প

১.  প্রবীর কুমার মুখার্জী – সে চলে গেলবলে গেল না

২.  উষসী চ্যাটার্জী – কনে দেখা আলো

 

ভ্রমণকাহিনী

১. প্রবাল মুখোপাধ্যায় – টাকীতে কয়েক ঘণ্টা

 

ভিডিও

১. ভবেশ পাত্র – মাউথ অর্গান পরিবেশন

২. সুচন্দ্রা পাল – স্বরচিত উপলব্ধি

৩. নূপুর কোলে – কবিতা পাঠ

৪. সোনালি মুখার্জী – স্বরচিত কবিতা পাঠ

৫. শ্যামলী বালা বিশ্বাস – গান

৬. পিউ চট্টোপাধ্যায় ও চিত্রা ভট্টাচার্য – যুগ্ম আবৃত্তি

৭. শিল্পী ভট্টাচার্য – গান

অঙ্কুরোদগম একটি সুসংগঠিত সংস্থাএখানে রীতিমত কর্পোরেট ধাঁচে প্রত্যেকের দায়িত্বগুলো বুঝিয়ে দেওয়া ও কাজগুলো করিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত এক ব্যবস্থা রয়েছে। আমার মতো কুঁড়ে সম্পাদক তাই পড়েছে বিপদে। গত বছর নভেম্বরে হাওড়া জেলা অঙ্কুরোদগম ওয়েব ম্যাগাজিন প্রকাশের পর বহু মানুষের প্রশংসা কুড়িয়ে যখন একটু আরাম করার মুডেসঙ্গে সঙ্গে খবর এল – দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ করতে হবে। আর তখনই ফাগুন ১৩৩১-এ সন্দেশে প্রকাশিত সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত ‘সম্পাদকের দশা’ কবিতাটির কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল –

“একদা নিশীথে এক সম্পাদক গোবেচারা ।

পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি হইলেন দেশছাড়া ।।

অনাহারী সম্পাদকী হাড়ভাঙা খাটুনি সে ।

জানে তাহা ভুক্তভোগী অপরে বুঝিবে কিসে?

লেখক পাঠক আদি সকলেরে দিয়া ফাঁকি ।

বেচারী ভাবিল মনে- বিদেশে লুকায়ে থাকি ।”

কিন্তু সুকুমার রায়ের সেই বেচারী সম্পাদকও যেমন পালিয়ে বাঁচতে পারেনিঅবশেষে ধরা পড়ে সম্পাদকের আসনে বসতে হয়েছিল ‘লোলচর্ম অস্থি সার জীর্ণ বেশ রুক্ষ্ণ কেশ’ নিয়েআমারও হয়েছে সেই দশা!

 মজার কথা ছেড়ে আনন্দের কথা বলি – এইবারে কিন্তু সম্পাদক হিসাবে হাওড়া অঙ্কুরোদগম-এর দ্বিতীয় ওয়েব ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতে বসে আমি রীতিমত উচ্ছ্বসিত। এতো বিচিত্র রকমের বিভিন্ন স্বাদের কবিতাগল্পভ্রমণকাহিনী রয়েছে এবারের ঝুলিতেএতো সুন্দর সব ভিডিও উপস্থাপনা পরিবেশিত হয়েছে জেলার গুণী শিল্পীদের তরফে – যা এক কথায় অনবদ্য। আসলে খুঁজে খুঁজে মণিমাণিক্যগুলোকে একজায়গায় জড় করলে যা হয় আর কি! গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অঙ্কুরোদগম-প্রিয় সাহিত্য সংস্কৃতি অনুরাগী মানুষ গত বারের তুলোনায় আরো অনেক গুন বেশি আনন্দ যে পেতে চলেছেন তা আগেভাগেই বলে রাখলাম। এবারে সম্পাদনার কাজে কিছুটা সাহায্য পেয়েছি শুক্লা রীতের কাছ থেকে। তাই কৃতজ্ঞতা রইল তার জন্য। আর যা কিছু ভুল ত্রুটি থেকে গেছে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সকলে ভালো থাকুনসাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে থাকুন – এই কামনা করি। ধন্যবাদ।

 

সায়ন দে

পত্রিকা সম্পাদক

হাওড়া অঙ্কুরোদগম

এখন আমরা অপসংস্কৃতি ও ভোগসর্বস্ব জীবনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। ভোগবাদদুর্নীতি ও স্বার্থপরতা মনকে অহরহ কলুষিত করে চলেছে৷ তবুও তারই মাঝে মুক্তির উপায় খুঁজতে ও সুস্থ  সমাজ গড়তে সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতি চর্চায় মনকে জারিত করলে সেই জারকরসে নবচেতনার ও নবভাবনার উত্তরণের পথ দেখাবে৷ সেই পথকে সুনিপুণভাবে  মসৃণ করে যাচ্ছে অঙ্কুরোদগম৷ সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যার ব্যাপ্তি৷ তারই একটি শাখা আমাদের হাওড়া অঙ্কুরোদ্গম৷ বহু গুণী সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের দৃঢ় মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে আমাদের এই অঙ্কুরোদগম যা একদিন মহীরূহে রূপান্তরিত হবে এই আশা রাখি৷ জেলা সম্পাদক সৈকত ঘোষের নেতৃত্বে এবং হাওড়া অঙ্কুরোদ্গমের সকল সদস্য একত্রে সেই পথকে সুগম করার কাজে ব্রতী হয়েছি ৷

জেলাভিত্তিক ওয়েব ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় পর্বের সাফল্য কামনা করি৷ সকলকে হার্দিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই৷ সকলে সুস্থ থাকবেন৷ আমরা অঙ্কুরোদগম

 

পলাশ দাস

সহ-সম্পাদক

হাওড়া জেলা অঙ্কুরোদগম

আরও কিছুক্ষণ স্বপ্নটা থাক

রেটিনার বন্ধ বাতায়নে

রুক্ষ রাতের চোখের কালিতেসময়ানুবর্তিতায়

ভোর এসে বেল দেয়

আলো হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে এসে

দেখিপরিত্যক্ত বাড়ির দখল নিয়েছে জঙ্গলেরা

পলেস্তারা খসা ইটের দেয়াল ভেঙে

অশ্বত্থের শিকড় যেন

নখ দাঁত বের করে

রোদে পা ডুবিয়ে হাসে

আর পূরানো উৎসবের জায়গায় সবুজ ব্যাঙ লম্ফঝম্প করে

ভালোবাসার সব সোহাগ মুছে

লোভ আর মোহের প্রতিবিধিৎসার অদ্ভুত বিকারে

প্রীতির ঋতুর ফুলদলে

অপুষ্পক অভিশপ্ত পাথরে পা বাড়ালে

ঝোড়ো মেঘের ভার তোমার নয়নতারায়

খেয়ালী শিশুর দুরন্তপনা ছেড়ে

দুই শালিখ মুখোমুখি হই

রৌদ্রকরোজ্জ্বল ঘাসে ঠোঁট রেখে

পতঙ্গের অভিলাষে

স্বপ্নটা দীর্ঘস্হায়ী হোক

অযুত নিযুত বছরে।।

কে যেন বলেছিল,”পৃথিবী আনন্দ দিয়ে ঘেরা”

কেন যে মানুষ তবু দুঃখের সুতো নেয় হাতে!

রক্তের স্নান সেরে উল্লাসে মাতে ঘাতকেরা

ঘুম নেই সে মায়ের যার ছেলে হারিয়েছে রাতে।

 

পাতারা খসে পড়েজাঁকিয়ে পড়েনি আজও শীত

বন্ধুহীন মানুষেরা প্রকৃতই শীতের কাছাকাছি।

মৌ সই হয়ে যায়যাবতীয় সমস্যার হয় কি বিহিত?

কাঠি করেতোষামোদেপ্রেমে-অপ্রেমে বেঁচে আছি।

 

ঘৃণার জন্ম হয়থুতু জমে প্রতিদিন না পাওয়াকে ঘিরে

পাহাড়ের পড়ন্ত নুড়ির মত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে পথে।

আতঙ্ক রাজত্ব নেয়,অন্ধকার নামে ধীরে ধীরে-

দুঃখের সুতোগুলো নাছোড় জড়িয়ে যায় ক্ষতে।

 

তবু আলো আসে প্রতিদিনস্পর্শে জেগে ওঠে স্নায়ু

যতদিন প্রেম বাঁচে ততদিনই পৃথিবীর আয়ু…

আমি আট বছরের কন্যা পথশিশু

আমার নাম ধাম ঘরবাড়ি পরিচয় নেই।

শুধু মায়ের সঙ্গে আমি আর

ছয় বছরের ছোট ভাই খেলা করি।

ভিক্ষা করিপেটের জন্য।

এর জন্য আস্তাকুঁড়ে খাবার খুঁজি। 

কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে

 ভাই আমি খাবার সংগ্রহ করি ডাস্টবিনে,

বাবুদের ফেলে দেওয়া খাবার থেকে।

কাতর প্রার্থনা করি বাবু একটু ভাত দেবে

আমি আর ভাই খাব

 কিন্তু বাবুদের কানে পৌঁছায় না আমার প্রার্থনা

 হয়তো অদৃশ্য শক্তিতে আমার কন্ঠ

বাতাসে বিলীন হয়ে যায়।

তাই তো কারো কানে পৌঁছায় না

এই পথ শিশুর হাহাকার করা কান্না।।

মুঠো মুঠো রোদ কুড়িয়েছি আনন্দের ঝর্ণাধারায়

গেঁথেছি মুক্তমালা বিনিসুতায়

মেখেছি গোধূলি আলো চঞ্চল মন জুড়ে ।

নিঃশব্দ বয়ে চলার গতিতে কান পেতেছি নদী-বুকে

ডালিয়া গোলাপ গাঁদার রেণু মেখে

নিজেকে সাজিয়েছি কাঁচা হলুদে

এসেছে বসন্ত পড়ন্ত বিকেলে ।

উপচে পড়া খুশিতে ভেসেছিল প্রজাপতি ভ্রমরা মৌমাছি

পর্ণমোচীও কেমন আনমনা হয়েছিল খুশির হাওয়ায়

সবুজ পাতারা সোনা রোদ মেখে

নৃত্য করে চলেছে জলতরঙ্গের ছন্দে

মেঠো পথের দুপাশের সবুজ এসে মিলেছিল অকাল বসন্তে

দূর নীলিমা ঢেকে রেখেছিল খুশিকে ছাতার মত

পিঁপড়ে ফড়িং সারিবদ্ধ হয়ে সামিল হয়েছিল আনন্দ-যজ্ঞে 

পাখিদের কল -কাকলীতে মুখরিত সেই সুখ-প্রাঙ্গণ

গোধূলির সাত রং ভেঙে ভেঙে পড়েছিল তোমার মুখে

গোলাপ লাজে রাঙা হয়ে লুকিয়েছিল ডালিয়ার বুকে

শীতের শির শিরে হাওয়ায় আনন্দ -যজ্ঞে এসেছিল অকাল বসন্ত

এসেছিল এক অনাবিল আনন্দএক অনন্য সুখে।

ওরা এক হাতে অক্ষর আর এক হাতে অন্ধকার নিয়ে ছুটে চলেছে সীমান্তের দিকে

বন্ধুর ধূ ধূ দুর্নিবার পথচোখের তারায় আঁকা স্বপ্নিল আকাশ,

ওরাই তো শিল্পীজলছবিতে আঁকা ভারতবর্ষ।

উদাস রাখাল বালক হয়ে মোহনবাঁশীতে চুম্বনের সুর তুলে

ওরা ভিজিয়ে দেয় শরীরের প্রতিটা ভাঁজ।

ওরা যেন ভোরের আকাশে উড়ন্ত পাখি,

পালক ছুঁয়ে নেমে আসা রোদ গ্রাস করছে মাটি,

সীমান্তে ওদের ঠোঁটের ছোঁয়ায় সেজে ওঠে শত বছরের ঘুমন্ত গোধূলি ।

ওদের বুক পকেটে জমিয়ে রাখা প্রত্যয়

আর কব্জিতে বাঁধা দৃঢ়তা উজ্জীবিত করে শতাব্দীর শীতল রক্ত

 

মুঠোতে রাখা অক্ষরে সৃষ্টি হয় কবিতা…..

একটা ঘর চাই,

যার স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল বেয়ে

চুঁয়ে পড়বে নিঃসঙ্গতা,

পলেস্তারা খসা ফাটা ছাদ থেকে

গড়াবে অনটন ফোঁটা ফোঁটা,

বেশ গোছানো অগোছালো ভাব –

পারিপাট্যহীনকয়েক দিনের

না তোলা বিছানা চাদরে বালিশে

স্পষ্ট আলস্যের ছাপ – থাকবে না

সমঝোতা করার কোন তাগিদ –

দাবীদাওয়াহিসেব নিকেষ,

জমাখরচের ফিরিস্তিহীন অসহ্য

ফাইফরমাশ বিবর্জিত এক জীবন।

শুধু জীর্ন তক্তপোষে আমি,

সঞ্চয়িতাকাগজ কলম আর

প্রাণাধিক প্রিয় হারমোনিয়াম।

প্রিয় বিনা কেমনে পোহাবে বলো রজনী?

যারে হেরি আঁখিপাতে

নিদ আসে নিশিরাতে,

প্রবাসে রাখিনু তারে কী কহিবে সজনী?

 

জল ভরিতে খেয়াঘাটে,

ঘুরিতে ফিরিতে মাঠে,

মরমে গাঁথিয়া রহে যে নামখানি,

যত লাজ ভয় হরি,

দিবানিশি যারে স্মরি,

তারেই কণ্ঠে ধরি রাখিব জানি।

 

বিজলী উছলি উঠে গহীন এ আঁধারে,

পথ করিহারাইতে পথ বারে বারে,

ও বিজলী জাগি রহযাবো অভিসারে,

মরমে মরেছি আজ বুঝিবে তা কজনই?

তোমার জন্য রেখে দিয়েছি

আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে জড়ো করা অনুভূতি আর আবেগের উৎপীড়ন।

গড়পড়তায় হিসেব মিলে যাবে ঠিকই

কম বেশি আদান প্রদানের দ্বন্দ্বে

ভালোবাসা হকচকিয়ে গেছে বহুবার ।

তুমি তো হিসাবের ধার ধারোনি কোনোদিনই

তাই আমার দিকে থেকে গেছে শুধুই ডেফিসিট ।

নির্জন দুপুরে পশ্চিম আকাশের ঝাঁঝালো রোদের তেজে

জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছি কতবার

শুধু তোমার প্রতীক্ষায় ।

সূর্যাস্তের শেষ আলো টুকু থেকে একঝলক ভিক্ষে চেয়েছি প্রতিনিয়ত।

শূন্য আকাশকে শুধু তাকিয়ে দেখেছি

তার উদারতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে শেষমেশ ।

কোনো রম্যরচনার নায়িকা হতে চাইনি কোনোদিনই ।

কলম বন্দি কাব্যিক ভাবনার আদলে

হতে চেয়েছিলাম তোমার নিরব প্রেমিকা ।

একটা আকাশ স্বপ্ন রাঙা

একটা আকাশ আঁধার,

একটা নদী বাঁচতে শেখায়

একটা নদী বাধার ।।

 

একটা মন ছবি আঁকে

একটা মন মোছে,

একটা মুখ বুকের ভিতর

জীবন টাকে বোঝে ।।

 

একটা সময় ফাগুন মাখে

একটা মনে বৃষ্টি,

একটা পথে এগিয়ে চলা

নানা রঙের সৃষ্টি ।।

 

একলা আমি পথের মাঝে

একলা আমি একা,

দিনে রাতে ভোর বেলাতে

নিজের মতন থাকা ।।

 

ইচ্ছেগুলো বেঁচে থাকে

জীবন জীবন খেলায়,

বয়স যখন মাঝ আকাশে

ফেরে ছোট্ট বেলায় ।।

কত কথার কচকচি,

কথামালাদের ভিড় সরাতে সরাতে

দিগন্ত রেখার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে…

 

একমুঠো পড়ন্ত রোদ কুড়িয়ে নিয়ে

মুঠোয় বন্দি করেছি।

 

তোমার ভালোবাসার ঋণ শোধ করে দেব-

মুঠো ভরা রোদ্দুর দিয়ে।

জীবনের কালোগুলো ঠিক একদিন মিলিয়ে যাবে…

 

গোধূলীর আলো জীবনে অন্য রং আনবে

সেই রঙে পূর্ণতা পাবে আগামী জীবন।

আলোর রঙে রঙিন হয়ে

হাতে হাত বাঁধা পড়ে যাবে,

 

ভালোবাসার বন্ধনে পথ চলা শুরু হবে

এক নতুন ভোরের….কথা দিলাম।

শ্বেতপত্রে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষনা করি জীবনের বিশ্বাস।

ভাষা শেষ হলে পড়ে অর্থহীন আঁচড়েতে

স্তব্ধ হয় লেখনীর শ্বাস।

মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিশ্লেষণ তবুও তো শেষ হয় না।

আরো কিছু পেতে চায়

সকল ইন্দ্রিয় আর অতীন্দ্রিয় যত কামনা

সকল বোধের বাইরে যে বোধ

খেলা করে আলো আঁধারে

বিদ্যুত শিখার মতো ঝলসাতে চায়

হৃদয় গভীরে অমৃত সত্তারে।

সম্পর্ক ভাঙেসম্পর্ক গড়ে সে জীবনের গভীর নিয়মে

পদ্মপাতায় সারারাত ধরে নিঃশব্দে

ব্যথার পবিত্র শিশির জমে ।।

নীল আকাশের পাখি

একটু নীল এনে দেবে নাকি!

নেব ধুয়ে মনের কালো

জ্বালাব জোনাকির আলো।

রক্তরাঙ্গা মাটি

মাওবাদীদের ঘাঁটি

সবুজ বনেহলুদ ফুলে

বারুদ গন্ধ ঘোরে ফেরে।

স্বজনহারা সাথীপুত্রহারা মা,

স্বামীহারা গৃহবধূ

সামনে মরু ধুধু,

এত আগুন জ্বালা আলো

ঘোচায় নাতো কালো?

তাইতো বলি পাখি

নীল এনে দাওনীল এনে দাও

সবাই সুখে থাকি।

নেমে এসো পারাবত

এই বিষাক্ত গলিপথে

কোলাহলে বধির ইমারত ।

আমাদের দৃষ্টিগুলো আজও

বাকি রেখে বসে আছে কাজও ।

অপেক্ষায় থাকে মৃত্যুর উন্মুখ ছায়া

বিপন্ন রক্তপথে অস্থির

সময়ের হেঁটে যাওয়া ।

প্রতি ঘরে যুদ্ধ সাজ

উন্মাদ উল্লাস খেলা করে

বিগ্রহ বিপন্ন আজ ।

নেমে এসো পারাবত

সকালের শান্ত রোদে

শুভ্র ডানার আলোপথ ।

চারিদিকে বিভীষিকার আগুন

বাঁচার চাহিদা দারুণ,

লড়াই! লড়াই! লড়াই!

দুর্বলের উপর সবল….

এ নির্যাতন চিরন্তন!

কে করবে প্রতিকার?

তুমি আমি সে….

কেউ কি আসবে?

 

জীবন জুড়ে হাহাকার           

হিংসার অনলের ধোঁয়া….

সারা পৃথিবীর উপর,

কোথায় তোমরা মহাপুরুষ?

শান্তির বাণী প্রচারক,

ছোট শিশুর কান্না!

পাচ্ছে কত লাঞ্ছনা,

পাবে কি সান্ত্বনা?

 

পাথরে পাথরে ঘর্ষনে অগ্নির সৃষ্টি,

মানব সভ্যতার প্রগতি এনেছে বহ্নি,

অগ্নিতেই জন্ম পঞ্চপাণ্ডপের পত্নী দ্রৌপদীর,

লালসায় আকৃষ্ট ছিল যে কৌরব….

একদিন অগ্নিকন্যার কারণেই যুদ্ধে ধ্বংস!

সত্যের জয়ে সাক্ষী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!

সেই নারী আজও নির্যাতনের স্বীকার!

কত রমনীর অন্যায়ভাবে হচ্ছে প্রাণপাত।

 

আছে কি মানবজাতীর প্রতিবাদী মানুষ?

মায়ের লজ্জা নিবারণকারী যোগ্য সন্তান!

সৌন্দর্যের রানী প্রকৃতি হুতাশনে প্রজ্বলিত।

মনুষ্যজাতী নির্বিচারে করছে অরণ্য ধ্বংস,

বিশ্ব আজ উষ্ণায়নের দূষনে পরিপূর্ন

চারিদিকে চলছে নিষ্ঠুর সংঘর্ষ!

জেতার উত্তাপে সমাজ নিমজ্জিত!!

অপেক্ষা! আর কতোকাল অপেক্ষা?

অপেক্ষারও একটা শেষ চাই,

নাহলে সে অপেক্ষা মান্যতা না পায়।

অনন্তকালের প্রতীক্ষায় রূপান্তরিত হয়।

আকাশের অপেক্ষা মেঘেদের হেরি,

বক্ষমাঝে ঠাঁই দানে প্রহর গোনা শুরু।

অবশেষে জলরাশি পূর্ণ মেঘ ঝড়ে পড়ে ধরায়।

তথাপি আকাশ নিরন্তর অপেক্ষায় তারই তরে।

মেঘেদের আগলে তার ক্ষণিক সুখ প্রাপ্তি,

পুষ্পের পুষ্পত্বের অপেক্ষায় থাকে মধুকর ,

প্রস্ফুটিত পুষ্পের পরাগরেণু আহরণে তার কি অদম্য প্রচেষ্টা!

পুষ্পের পরাগমিলনে শেষ হয় তার কর্মপ্রয়াস।

অপেক্ষা বেঁধে রাখে প্রকৃতিরে,

অপেক্ষায় অপেক্ষারত জীবন,

পূর্ণ করে জীবনের অপেক্ষার প্রতিটি ধাপ।

এগিয়ে চলে জীবনঅপেক্ষার আর শেষ না হয়,

এক অপেক্ষা হতে আরেক অপেক্ষায় পা বাড়ায় জীবন।

এভাবেই কি অপেক্ষার শেষ!

প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় রয় আবারো জীবন।

অতীত খামে হাত দিও নাসুধী

পুরনো খাম খোলায় আছে বারণ।

ঢাকনা খুলে চলকে যদি বেরোয়

অতীত স্মৃতির মদালসা কারণ!

সুখের স্মৃতিসুখ হারানোর দুখে

দুচোখ ভরে আসতে পারে জল,

দুঃখ স্মরণ দুখেই ভরবে হৃদয়

আজান পূর্ব কিসের কর্মফল ?

অতীত খামে হাত দিও নাসুধী

পুরনো খাম খোলায় আছে বারণ।

অতীতটাকে সাম্প্রতিকের রঙে

ঢেকেছে এক পশমিনা আবরণ।

আমার কাছে

          সূর্যই তো হোমকুণ্ড

দিনের আলোর প্রদীপ্ত  আগুনে

স্থূল ,সূক্ষ্ম শরীরের  আহূতি

তারই শিখা রাতের আঁধার  ধারার

           ক্রম অবগাহনে

যে জন্ম নেবে সকালে

তারই সাধনা চলছে সর্বক্ষণ

              বুঝি বা না বুঝি ৷

 

যদি পারো কোনদিনও

সুপর্ণা বেরা

 

                        আর ভালবাসা?

    ভালবাসা বলে কিছু হয় না।

সব সম্পর্কই শুধু অভ্যাস এ আবদ্ধ হয়ে থাকা।

 

                      সম্পর্ক?

দেখাও তো দেখিভাই- বোনবন্ধু- বান্ধবস্বামী- স্ত্রীএমন কি পরকীয়ার ও সম্পর্ক,

  পৃথিবীতে যত সম্পর্ক আছে সবই অভ্যাস।

   

            আর নিস্বার্থ যে বলে,

স্বার্থস্বার্থশুধুই স্বার্থ,

সব কিছু র মূল্যে শুধুই স্বার্থ

 যে দিন স্বার্থ ফুরিয়ে যাবেসে দিন অভ্যাস গুলোই বদলে যাবে।

 

          তবে যে বিশ্বাস আর ভরসা!!

 

তাহলে এত বিশ্বাস ঘাতকতা র শব্দ শুনতে পেতে?

 

              সম্মান ও শ্রদ্ধা!!

হায়এটা প্রয়োজনের বহিঃপ্রকাশ,

মাথা নত করে আহ্বান জানালে প্রকৃতশ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করা হয় না।

   

         আর সততা?

কঠিন বাস্তবের করাঘাত দুমড়ে মুচড়ে পরে।

  

              ধর্ম তবে বলো?

ধর্ম যদি শেখো,

            সম্মানশ্রদ্ধাসততাভালবাসাবিশ্বাস ও ভরসা —- এগুলো তবে জেনো।

 

যদি তুমি মানোনিজেকে অক্ষত রেখে বহে নিয়ে চলো,

অটুট রেখো তুমি আত্মবিশ্বাস যত,

কেড়ে নিতে কারো সাহস হবে না কোনোদিন ও

নিজের প্রতি নিজের আস্থা রেখো অবিরত।

জমিয়ে শীত পড়েছে। সকালে হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি বিছানায়। বাবা চলে গেছেন রান্নাঘরে পাঁউরুটি নিয়ে। তখন ছিল কয়লার উনুন। পাঁউরুটি সেঁকে মাখন লাগিয়ে হাতে হাতে ধরিয়ে দিতেন আমাদের। বাড়িতে আসতো দুরকম মাখন। হলদে আর সাদা। ঐ সাদা মাখনটাই ছিল আমার পছন্দের। পাঁউরুটির সঙ্গে থাকত সেদ্ধ হাঁসের ডিমকুসুমটা টলটলে। ছুটিছাটায় আসত গ্ৰেট ইষ্টার্ণের কুমীর পাঁউরুটি। কি অপূর্ব তার স্বাদ। তেমনি গন্ধ। আরও একটা জিনিষ বিশেষ পছন্দের ছিল- লিলি কোম্পানির হাতিঘোড়া বিস্কুট।

ফুলগাছের সখ ছিল বাবার। তিনতলায় ছাদে সারি সারি টবে গ্ৰীষ্মে ফুটত জুঁইবেল আর রকমারী বাহারি ফুল। শীতকালে ডালিয়াচন্দ্রমল্লিকা আর গোলাপ। গোলাপ ছিল তাঁর পছন্দের ফুল। নিজের হাতে যত্ন করতেনসার মেশাতেন মাটিতেপোকা ধরলে ভাল ছেঁটে দিতেন। দুবেলা তাঁর ছাদে ওঠা চাইই। ওগুলো ছিল যেন তাঁর সন্তান। দুবেলা চোখে না দেখলেজল সিঞ্চন আর পরম মমতায় ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে না পারলে কোথায় যেন তাঁর বাজত।

  বাবা ছিলেন স্বল্পাহারী। গুরুপাক খাবার পছন্দ করতেন না। অবসর গ্ৰহণের কবছর পর খাদ্যগ্ৰহণে অনীহা দেখা গেল। ডাক্তারের পরামর্শমতো এক্স-রে করে দেখা গেল -অন্ত্রনালীতে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালে অপারেশন সফল হল। বাবা সেরে উঠছেন একটু একটু করে। আর কদিনের মধ্যে বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনব ভাবতে শুরু করেছিবিপদটা ধেয়ে এল তখনই। সেদিন ছিল রবিবার২৫শে ডিসেম্বরকনকনে ঠাণ্ডা। দুপুরবেলায় মা গিয়েছেন খাবার নিয়ে। আমি বাড়ির ছাদে উঠে দুপুরের রোদে নিজেকে খানিক সেঁকে নিচ্ছি। ঘড়িতে তখন ১টা বাজতে কিছুটা বাকি। হঠাৎ নীচে থেকে কেউ একজন ছুটে এসে খবর দিল। এইমাত্র…! খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয়নি।

চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না। ভেতরের মানুষটা একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে যেন চিৎকার করে বলে উঠলতুমি তো মিথ্যা বল না। বলেছিলেযেখানেই যাব বলে যাব। কথা রাখলে কই?

পাড়ে একা দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। ঘন চুলের বিনুনি আলগা হয়ে এলিয়ে আছে পিঠে। নদীর ঠাণ্ডা হাওয়ায় সাদা ওড়নাটা উড়ছে। ওপারের আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে সদ্য ধরানো উনুনের ধোঁয়া। সময় ঠিক কটা তখন জানেনা সে। তবে সকাল। ভোর আর স্নানে যাওয়ার মাঝামাঝি কোনও একটা সময়। রোদে চিকমিক করছে নদীর জল। মেয়েটির চোখেরমনিও। নদীর ছোটো ছোটো ঢেউ যেন পাড়ের সাথে কাবাডি খেলছে। সব সময়ই ঢেউয়ের দান।ঢেউ গুলো বাড়লো হঠাৎ! পাড়ের গায়ের আগাছা গুলো জলের নীচে খানিক ডুব সাঁতার দিয়ে সুবজ হয়ে ফিরলো। একটা খালি নৌকো এসে দাঁড়াল ঘাটে। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুটি েয়ে । একটির ঢেউ খেলানো চুল গিয়ে ঠেকেছে কোমরে। অন্যের খয়েরি মণির চোখে আনন্দের জল উপচে পড়ছে। তাকাল দুজন পরস্পরের দিকে।কি অমলিন। কি পবিত্র সে তাকানো। হাত ধরল পরস্পরের। যেমনি উঠতে যাবে নৌকায় অমনি কোথাথেকে যেন একটা ঝোড়ো হওয়া এসে নৌকাটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পাড় থেকে অনেক দূরে।লম্বা চুলের মেয়েটার পা পিছলে গেল। নদীতে তো প্রায় পরেই যেতভাগ্যিস অন্য মেয়েটি তার হাত ছাড়েনি। সামলে নিল।কিছুক্ষণ পর নৌকোটা আবার ভেসে এলো। এবার দুজনে শক্ত করে হাতধরে এক লাফে উঠে পড়ল নৌকায়।আহা কি আনন্দ। হোহো করে হেসে উঠল মেয়ে দুটো। ভেসে পড়লো নৌকো তাদের নিয়ে।

পাড়ে দাঁড়ানো দর্শক মেয়েটি এসব দেখল খুব উৎসাহ নিয়ে। দেখল নদীর বড়ো ঢেউয়ের ছোট ঢেউয়ে লুকিয়ে যাওয়া। শাড়ি হাঁটুর উপরে তুলে ওপারে রান্নার বাসন ধুচ্ছে কজন। মেয়েটি চুলটা সামনে এনে তার আলগা হওয়া বিনুন ঠিক করতে লাগলো। আবার এলো নৌকো ভেসে। তার গায়ে খুব ুন্দর নকশা করা এবার। তার উপরে বসে থাকা মাঝি কাউকে যেন ডাকল ঘাটের দিকে। দর্শক মেয়েটি দেখলঅন্য একটি মেয়ে ও একটি ছেলে  দাঁড়িয়ে আছে এখন । তারাও ঠিক আগের মতন হাত ধরলো পরস্পরের। ছেলেটির চোখ সরেনামেয়েটির টোল পড়া হাসির থেকে।মগ্ন ওরা একে অপরে। একসাথে পা রাখলো দুজনে নৌকায়। নৌকো দুলে উঠল অল্প। মাঝি খুব সহজেই তা সামলে দিলো। ছেলে মেয়ে দুটি উঠে গেলে এই নৌকাও মিলিয়ে গেল দূরে।

দর্শক মেয়েটির মন কখন যেন এক সুন্দর প্রসন্নতায় ভরে গেছে। সূর্যাস্তের সময়। এ আলোর নাম কনে দেখা আলো। মেয়েটির মুখ সেই আলোতে ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে।ওপারের কোনও কোনও ঘরে একটা দুটো আলো জ্বলেছে। এতক্ষণে সে খেয়াল করলো ঘাটে কখন যেন একটা নৌকো এসে দাঁড়িয়ে আছে। নৌকো থেকে ভেসে এলো কিছু হাসি ও কথার শব্দ। ঘাটে দাঁড়িয়ে আবার অন্য একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। কিন্তু দুজনেরই চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে দুজন। কিন্তু নাহকেউ কারো হাত ধরে নেই। খুব অবাক হলো দর্শক মেয়েটি।তার মনে হলো সে এগিয়ে গিয়ে হাত দুটো তাদের এক করে দেয়। এমন সময় ডাক এলো নৌকো থেকে “কি হলো! দিন যে ফুরিয়ে যায় এবার উঠে এসো!” পা রাখে দুজনেই ,স্বাভাবিক ভাবেই দুলে ওঠে নৌকো। কিন্তু চোখ বাঁধা থাকায় দুজনেই বিচলিত হয়ে উঠলো। কাঁপলো পা। বাড়িয়ে দিল হাত। কিন্তু হায়! দুজনেই তো জানেনা অন্য জনের হাত কোথায়। সেই হাত কি সামলাতে পারবে একে অপরকে ! দর্শক মেয়েটি চিৎকার করে বলতে চাইলো  ঠিক দিকে হাত বাড়িয়েছএবার ধরে নাও শুধু।” কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলোনা। সে ছুটে যেতে চাইলো ঘাটের দিকেকিন্তু পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লো মাটিতে।

চোখ মেলতেই সুচরিতা বুঝলো শীতের ভোরে দরদর করে ঘামছে সে। বিছানার পাশে টেবিলে রাখা মোবাইলে দেখলো সকাল সাত টা বাজে। তারিখটাও অনেক অপেক্ষার ও আলোচনার। সম্বন্ধ করে বিয়ের জন্যে বাড়ির লোকেরা যে ছেলের সাথে কথা বলছিলআজ সুচরিতার তার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন।

তার দেখা ভোরের স্বপ্নের তৃতীয় নৌকোটির কথা তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খেতে লাগলো।

উত্তর ২৪ পরগণার টাকী। ইছামতীর গা ঘেঁষে প্রাচীনতার গন্ধ গায়ে মেখে সেই কবে থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওপারে বাংলাদেশ। কেউ কেউ বলেনইছামতীর এই তীর আর ওই তীর কেবলই কলকল খলখল শব্দে একে অন্যের সঙ্গে কিসব বলে চলেছে। সেই ভাষা কেবল বুঝতে পারে সকালের রোদ্দুরমেঘলা আকাশপড়ন্ত বিকেলবিদ্যেধরী থেকে ভেসে আসা গাঙচিল আর ওপারের মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের খবর নিয়ে ছুটে আসা সমীরণ। আর বোঝে ওই মাঝি- মাল্লার দলইছামতী যাদের মাদিনের বারো ঘণ্টা যাদের কাটে নদীর বুকেজলের রঙ দেখেই যারা বুঝতে পারে কতটা দুঃসহ ব্যথায় নদীর বুক আজ ভারাক্রান্ত।

রাজঘাট থেকে চল্লিশ টাকার টিকিট কেটে বসে পড়ুন ওদেরই এক নৌকায়। একটু সাহসী হলে উঠে বসুন নৌকার চালে। নৌকা চলতে শুরু করলে আপনি দেখতে পাবেন রাজঘাট দূরে সরে যাচ্ছে। আপনি সোনার বাংলা হোটেল ছাড়িয়ে চলেছেন মোহনার দিকে। আপনি বি এস এফের  শিবিরও পার হয়ে গেলেন।  আপনার বামদিকে বাংলাদেশ। তরুণ মাঝি আপনাকে বলে দেবেওই যে গোলপাতায় ঘেরা বিস্তীর্ণ ভূমি দেখছেনওটা পেরোলেই ওপার বাংলা। আরও খানিকটা এগোলেই দেখবেনখানিকটা দূরে জলের মধ্যে যেন একটা বিভাজন তৈরী হয়েছে। মাঝি আপনাকে বলে দেবেঐ হলো তিন নদীর মোহনা। ইছামতীতে এসে মিশেছে বিদ্যেধরী আর কালিন্দী। আপনি দেখতে পাবেনমোহনার বিশাল বিস্তৃতি। হয়তো নবকুমারের কথা মনে পড়বে। এমন অগাধ বিস্তৃত জলরাশি দেখেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো, ‘আহাকী দেখিলামজন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না !‘ নৌকার মুখ ঘুরে গেছে। ফেরার সময় আপনার নজরে আসবে মাঝনদীতে বাংলাদেশী নৌকা। ইছামতীর বুক থেকে ওরা বালি তুলছে। ওই বালি বেচেই চলে ওদের সংসার। আর দেখবেন ইছামতীর বুকে বিস্তীর্ণ চড়া। কিছু বাংলাদেশী মানুষ সেখানে দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আপনার ইচ্ছে থাকলেও ওখানে যেতে পারবেন না। ওই মানুষগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলতে পারবেন না, ‘আসুন ভাইআপনার আমার একই ভাষা। দুদিন আগেও তো আমাদের মাটি পৃথক ছিলো না। কি এক অনতিক্রম্য  শক্তি এসে আমাদের মধ্যে বিভেদের পাঁচিল তুলে দিলো। আমার একার শক্তিতে এই পাঁচিল ভাঙা যাবে না। আপনার সাহায্য লাগবে।’ আপনাকে নিশ্চিত বলতে পারিআপনার ভেতরের কথাগুলো ভেতরেই থেকে যাবে। একটা অতৃপ্তিএকটা অপূর্ণ মনস্কামনার বেদনা আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবে সারাক্ষণ।

এবার টোটোয় উঠে শহরটাকে একটু পরখ করে নিন। নদীর তীর ধরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তা। যেতে যেতে দেখবেনগতবারে আমফান এসে কী কাণ্ডটাই না করে গেছে এখানে। টানা দশ দিন জলে ডুবে ছিলো ইছামতীর তীরবর্তী এলাকা। প্রকৃতির সেই তাণ্ডবলীলার কথা বলতে বলতে টোটো চালকের চোখে মুখে ফুটে উঠছিলো আতঙ্ক আর সব হারানোর ভয়াল রূপ। এঁকেবেঁকে চলেছে তিন চাকার গাড়ি। আপনি প্রবেশ করছেন গাছগাছালিতে ঘেরা শহরের কেন্দ্রে। রায়চৌধুরীদের ঠাকুরদালানজমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষএকশো বছরের স্কুলএকমাত্র গার্লস কলেজজাগ্রত কালিমন্দিররামকৃষ্ণ মিশনটাকী পুরসভা এইসব দেখে টেখে যখন আপনি সামান্য ক্লান্তমনে পড়ছে বন্ধুর কথাআপনাকে বলে দিয়েছিলোমিনি সুন্দরবনটা দেখে আসিস। ঠিক তখনই চালক বলে উঠলোএবার আমরা যাবো জিরো পয়েন্ট। এখানে পরিচয় পত্র জমা রেখে ভ্যান রিকশায় উঠে বসা গেলো। টাকী পুরসভার এক ঢাউস বোর্ডে লেখা মিনি সুন্দরবন।‘ দশ টাকা মাশুল। ব্রীজের ওপর দিয়ে রাস্তা ঢুকে গেছে সুন্দরবনের গভীরে। বিকেল হয়ে গেছে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। দুপাশে ঘন গাছের সারি। বেশীরভাগই গোলপাতার গাছ। অন্য গাছও আছে। সুন্দরবনের সব গাছেরই সন্ধান মেলে এখানে। তাই মিনি সুন্দরবন। যেতে যেতে আর একটি রাস্তার সন্ধান পাওয়া গেলো। এটি শেষ হয়েছে ইছামতীর তীরে। নদী এখানে নির্জনকোলাহলশূন্য। মনে হয়যেতে যেতে খানিক নিস্তব্ধ হয়ে থেকে একটু জিরিয়ে নিতে চায় ইছামতী। ফিরে এলাম। ইছামতীর এখন নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়। সারাদিনের শ্রান্তিঅবসাদ গা থেকে মুছে ফেলে দুদণ্ড নিজের মুখোমুখি হবার সময়। পশ্চিমের সূর্যটাও প্রায় ঢলে পড়লো। অস্তায়মান সূর্য আর নিস্তব্ধ ইছামতী একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। দিন ফুরিয়ে যাবার আগে ওই বুঝি ওদের কথা এবার শুরু হলো।

যেখানে কবির কলম রুক্ষতা হারিয়ে সতেজ হয়ে ওঠেযেখানে লেখক তাঁর কলমকে শান দিয়ে নতুন রচনার বীজ বপন করেযেখানে প্রাণখোলা নিঃশ্বাস পড়ে মুক্ত বাতাসেযেখানে খাতার পৃষ্ঠা জুড়ে রাশি রাশি শব্দেরা ভিড় করে গড়ে তোলে কাব্যঅনাবিল খুশির রোশনাই সৃষ্টিকে করে তোলে প্রাণবন্ত সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে সৃষ্টির প্রেরণাকে উজ্জীবিত করতে আমরা সাহিত্যপ্রেমীরা মিলিত হই একই দরজার চৌকাঠে। ছোট্ট ছোট্ট বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটিয়ে সৃষ্টি একদিন মহীরূহতে পরিণত হবে এই প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই অঙ্কুরোদগমের পথ চলা। ফুরফুরে তাজা বাতাসে প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিতে সবাই জড়ো হই এই পরিবারের অন্দরমহলে।  কবিতা গল্পের ব্যারিকেট ভেঙে গান গল্প আঁকার মতো সৃজনশীলতা প্রকাশ করার মঞ্চ এই অঙ্কুরোদগম।

সংস্কৃতির ভীত রচনায় বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে চলার ব্রতে আমরা অঙ্কুরোদগম আমাদের সুদূরপ্রসারী ইচ্ছেগুলোকে একত্রিত করে আগামীকে উপহার দেবো একটা সুস্থ সমাজ। সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে আমাদের সঙ্গে আছেন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষরা। অঙ্কুরোদগম জেলাভিত্তিক ওয়েব ম্যাগাজিনের খাতায় আমাদের হাওড়া জেলার প্রথম পরিচয় দেবার পালা। হাওড়া জেলা শিক্ষা সংস্কৃতিতে বেশ অনেকখানিই এগিয়ে – এ বিষয়ে মতপার্থক্য নেই। আগামীতে হাওড়া একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই আশা রাখি। সকল সাহিত্যনুরাগী বন্ধু ও শিল্পীকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানাই।

 

সৈকত ঘোষ

সম্পাদক : হাওড়া জেলা অঙ্কুরোদ্গম

দীর্ঘদিন ধরে গোটা পৃথিবী এক অদ্ভুত আঁধারে আচ্ছন্ন। যোগাযোগে বিপ্লব এলেও মনে মনে দূরত্বের একটা আবহাওয়া ঘনিয়ে আসছিল ক্রমশ। ঠিক এমন সময় হাওড়া জেলায় সংস্কৃতি জগতে একটা অঙ্কুরোদ্গম ঘটল। সবুজ রঙের একদল মন ভাল করা মানুষের দল সৈকত ঘোষের হাত ধরে হানা দিল জেলার বেশ কয়েকজন উৎসাহী সাহিত্যানুরাগীর হৃদয় মহলে। তারপর তৈরি হল ইতিহাস। এক অদ্ভুত সেতু বন্ধনের ইতিহাস। শহর গ্রাম মিলে গেল। জুড়ে গেল হাওড়ার দামোদরের পাড়ের সঙ্গে কলকাতার নন্দন চত্বর। কবিতাগানআবৃত্তির ফুল ফুটতে লাগল। এখন আমার সেই সব ফুলগুলো বেছে বেছে একটা সুন্দর মালা গাঁথবার পালা। একটা আবেগমাখা ওয়েব ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ সংখ্যা আজ সকল অঙ্কুরোদগম পরিবারের দ্বারে নিয়ে এলাম আমরা হাওড়ার মানুষজন… কেমন লাগবে জানিনা… তবে মন ভরিয়ে দিতে আমরা চেষ্টা করে যাবো আজীবন। এই প্রত্যয়টুকু সম্বল করে এগিয়ে চলার শুভকামনা জানাই সকলকে।

 

সায়ন দে

পত্রিকা সম্পাদক : হাওড়া জেলা অঙ্কুরোদগম

কবিতা

ড. রীতা দে

আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শুক্লা রীত

তাপস মাইতি

শিখা পাল মণ্ডল

পলাশ দাস

অমিয় কুমার রীত

প্রিয়াঙ্কা বন্দ্যোপাধ্যায়

সুপর্ণা বেরা

শ্যামলী বালা বিশ্বাস

রূপালী সেনগুপ্তা

রিঙ্কু চ্যাটার্জী

গল্প

প্রবাল মুখোপাধ্যায়

নুপুর কোলে

প্রবীর কুমার মুখার্জী

কথিকা

সুচন্দ্রা পাল

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নাটিকা

সায়ন দে

ভিডিও

রিঙ্কু চ্যাটার্জী, স্বরচিত কবিতাপাঠ

সুপর্ণা বেরা , আবৃত্তি

পলাশ দাস, গান

শ্যমলী বালা বিশ্বাস, গান

নূপুর কোলে, আবৃত্তি

পিউ চ্যাটার্জী ও চিত্রা ভট্টাচার্য, আবৃত্তি

ভবেশ পাত্র, আবৃত্তি

শিল্পী ভট্টাচার্য, গান

নন্দিতা তমসা হালদার, আবৃত্তি

আকাশকে তো

সারাক্ষণ দেখছি

সে চোখ দিয়েই হোক

বা মন দিয়েই হোক,

আর

আকাশকে যখন শুনতে গেলাম

বুঁদ হয়ে গেলাম

নীরব শব্দে

যে শব্দ

রেখে যায় আত্মা

দেহ ছেড়ে যাওয়ার সময়।

পথ চলতে চলতে পায়ে লাগে অজস্র ধুলো

দেশের মানচিত্রে বয়ে যায় পবিত্র নদী।

মৌসুমী বাতাস আসে,সঙ্গী তার জলও

ভোটযন্ত্র সত্যিই মানুষের কথা বলত যদি…

 

রক্ত রক্ত চাপচাপ ভিজে যাওয়া মাটি-

ফসল তুলেছে ঘরে বহুদিন প্রতীক্ষার পর!

খুব সহজ চিনে নেওয়া কে যে কত খাঁটি?

পুড়ে যায় দাউ দাউ বহু যত্নে গড়ে তোলা ঘর।

 

ধ্বজা ওরে পতপতবিনিময়ে নিভে যায় প্রাণ

চোখ থেকে জল নয়ঝরে পড়ে তীব্র আগুন।

ধর্মের জামা সব  খুলে দিলেশান্তির গান

অন্ধ চোখ পায়,দেখে নেয় আলোকের গুণ।

বলে ছিলে দেখা হবে

কোনো এক দিনের শেষে

ক্লান্ত বিকেলে কিংবা

সায়াহ্নের অন্তিম লগ্নে

অন্ধকারের অস্পষ্টতায় যদি অবাক হয়ে যাই

যদি খুঁজে পাই সেই চেনা মুখের অস্থিরতা

এক নিঃশ্বাসে হাজার কথার ঝাঁপি উপচে পড়া

কালো চিকচিকে চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে

যদি অনুভব করতে পারো

সেদিন হয়তো তুমি আমি-র মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমবে।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসা রাত্রির আলিঙ্গনে আমাদের প্রেম

যদি ফিরিয়ে দেয় সেই তুমি কে?

আমার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশায়

বসে থাকতে থাকতে কঠিন সত্যিকে আঁকড়ে ধরে

বলতে পেরেছিলে কি যে ভালোবাসো আমায়?

শুধু চলে যাবো বলে

একটাও নুড়ি পাথর কুড়াইনি কোনোদিন।

যতদূর হেঁটে গেছি সবুজ বাগান

নীল লাল ফুলপাঁপড়ি মেলে দাঁড়িয়ে আছে

সম্মোহিত খুশবু বুকে ধরে।

রাক্ষসের মতো গিলে খেয়েছি সবুজ ক্ষিদে

দুদিনের এই জীবনতোমার আমার,

আমার – আমারএতো লড়াই।

চুপিসারে সংযত থেকেছি

সত্যকে অনুভব করে।

তাই যাবার আগে যা কিছু সঞ্চয়

আমি রেখে যাবো আগামীর কাছে

আমার দৌহিত্রের উজ্জ্বল জীবনের স্বার্থে।

যেটুকু কুড়িয়েছিলাম সেটা কোন

পার্থিব ঐশ্বর্য নয়। নয় সোনা দানা

পৃথিবীর প্রান্তরে পড়ে থাকা

কিছু আত্মিক জীবনবোধ।

আর আমার বাৎসল্যের কবিতা।

 

হাল্কা হাওয়ায় নাচছে মন

আকাশ পানে চেয়ে

শিশির মাখা শারদ ভোর

উঠল গান গেয়ে।

স্বপ্ন আঁকে মেঘের গায়ে

প্রেমের রং তুলি

আয় না প্রেম আমার কাছে

এক সাথে পথ চলি।

জোয়ার বানে শিউলি ভাসে

আঁকে কথাকলি

হৃদয়খানি পেতে রাখে

মেখে শুকনো ধূলি।

বইছে নদী কুলুকুলু

যাচ্ছে আপন বেগে

শুষ্ক তৃণ বুকের পরে

সোহাগে রয় জেগে।

হারিয়ে যায় উদাসী মন

সাদা কাশের বনে

ঢেউ খেলে যায় হৃদয় মাঝে

শারদ আলাপনে ।

তোমার অপেক্ষায়  বসেছিলাম

নন্দনে গাছের তলায়

হাতে ধরা ছিলো সাড়ে চারটে শোয়ের

দুটো ব্যালকনি টিকিট

সূর্য তখনও পশ্চিমাকাশে তার অস্তরাঙায় রঙ ঢেলে দেয়নি

মনের গহীন কোনে জন্মেছিল আশার পুলক

তুমি আসবে বলে…

আজকেই তুমি হলুদ শাড়ি আর খোঁপায়

গোলাপ গেঁথে আসবে বলেছিলে

এমনি করে কয়েক ঘন্টা গেল কেটে

তবুও তোমার দেখা নেই…

সেলফিতে তুলবো তোমার আমার যুগলবন্দী

তুমি দিয়েছিলে কথা

কিন্তু  তুমি এলে না…

সন্ধ্যা নেমে এলো দুচোখে

চোখের কোণে চিকচিক করে এল জল

ছলছল চোখে তাকিয়ে ইতিউতি

সময়ের বিবরে সব ভেসে যায়…  

তবুও আকাশের উজ্জ্বল শুকতারায় বাঁচে অপেক্ষা৷

একটি জবা শিখিতে দোদুল্যমান

কপালে চন্দন অঙ্কিত জ্যোতির্বলয়

আবক্ষ চন্দনলেপিত –

এ জ্যোতি অনুভবের

এ জ্যোতি ইন্দ্রিয়-দ্বারা-অনুভূতির-অতীত

তোমার স্পর্ধা এতদূর যে

অনায়াসে অতিক্রম করতে চাও!

তুমি সময়ের গণ্ডী ছিন্ন করে চলবে –

এমনি শক্তিমান!

সূর্যমুখী বেগুন অথবা কুষ্মাণ্ড!!

আজ সেই বেগুন ঊর্দ্ধমুখী শুধু নয়,

সেই কুষ্মাণ্ড ঝুলন্ত নয়,

তাদের নিজ নিজ ভাগ্যনিয়ন্তা।

তুমি না-থাকলে এ বঙ্গভূমে –

সেই শিখা ঊর্দ্ধমুখী হয়ে উঠতো-না-কি,

তোমার শিখা ঊর্দ্ধে উঠে

কর্তন করলে যাদের শিখা?

এক অদ্ভুত ভালো না লাগা পেয়ে বসেছে তার

পাতা ঝরা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পরা

পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে একাকী,নির্জনে।

বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে আসে

এরই নাম কি ডিপ্রেশন?

আচ্ছা,জমে থাকা কালো মেঘে তো বৃষ্টি হয়

তাহলে এত গুমোট কেন?

প্রকৃতি তো লণ্ডভণ্ড করে দেয় চতুর্দিক

মন কেন পারে না?

সেতো ক্রমশ গুটিয়ে নেয় একটু একটু করে নিজের ভিতর।

তারচেয়ে ভালো নোনতা জলের বন্যা হোক।

দুকূল ছাপিয়ে জল আসুক,

মনখারাপের দিস্তা গুলো ভেসে যাক অকূল দরিয়ায়।

ভালোবাসার চাদর গায়ে নিয়ে শান্তির ঘুম দাও দেখি,

চোখ মেলে দেখবে যা তোমার তার সবটাই আছে

হারায়নি কিছুই।

আমি যুগান্তরের ঘুম থেকে জেগে উঠলাম,

চোখ খুলেই দেখতে পেলাম সে আমার পাশেই বসে আছে,

কপালের ওপর ঠান্ডা হাত রেখে বলল –

আবার পাগলামো শুরু করেছিস,

এখন না তোর পড়ন্ত বেলা,

এতো কিছু নিয়ে গেলিদিয়ে যা আমায় কিছু।

 

দীর্ঘ জীবন অতিক্রান্তের পর দ্বিতীয় বার আমার জীবনের তাল কাটলো।

সময়ের সমুদ্র পেরিয়েকল্পনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে সুখ অনুভব করেছি,

দুহাত ভরে কুড়োবার চেষ্টা করেছিহিংসাঅহংকারদাম্ভিকতায় আবিষ্ট হয়েছি

মিথ্যে মায়াজালে জ্বলেছে গোটা সমাজউপভোগ্ করেছি অষ্ঠপৃষ্ঠে,

ঘরের এক কোণে বসে স্বপ্ন দেখেছি রাজা হওয়ার,

দাপিয়েছি গোটা সমাজজ্বালিয়েছি দাবানল।

সমস্ত কিছু নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি ওপারের দুনিয়ায়অলৌকিক সুখ অনুভব করেছি।

তখনই স্তিমিত জগতে শুনতে পেলামকারো ডাক

বাইরে তখনই ম্লান আলোঘরের ভেতর অন্ধকার,

কঠিন বাস্তবের করাঘাতে দীর্ঘনিশ্বাসকে পাক দেয় হাহাকার।

আমার শরীর এখানে থাকলেওআমি মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট।

যেখানে দিন নেইরাত্রি নেইসকাল ও বিকেল নেই,

নেই কোন শরীর ও মনের বিচ্ছেদ।

ওপার থেকে রয়ে গেল শুধুই আক্ষেপ।

মুঠো ভরে কুড়নো যত নুড়ি পাথরফিরিয়ে দিলাম তাকে !

ক্লেদাক্ত বইয়ের পাতায় যতই গাঁথুক অক্ষর মালা

জীবন দলিল লেখা থাকে মর্মস্পর্শী প্রতিজ্ঞার আগুনে।

পরিণীত হওয়ার করুন ভীড়ে

আম্রমুকুল নিজেকে দ্রুত শেষ করে অনায়াসে।

অনুভূতির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে

বিহান থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

রং চটা স্বপ্নের বাসর তিলে তিলে

ক্ষয়ে যায় অনাদরের স্পর্ধায়।

দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ভালোবাসার ছাঁদখানায়

সময়ের সরণি বেয়ে নামে বিদ্বেষের পুঁজ।

আবদ্ধ পথের ধুলো নিরালম্ব শোকে

কারুকার্যখোচিত ভাবনা ছুঁয়ে মিলিয়ে নিতে চায় এক সূত্রহীন সংকেতে।

আশ্চর্য নিদান দীর্ঘ অন্ধকার শেষে

নাক্ষত্রিক পাটের সুখ-স্বাচ্ছন্দের চাবিকাঠি খোঁজে।

কোনো এক মানসিক সন্ধ্যা

চেঞ্জার গ্লাসে প্রতিজ্ঞার আগুনে ঝলসে নেয় যাবতীয় পাওনা গন্ডা।।

সূর্য গেল অস্তাচলে সন্ধ্যা নামে ধরায়,

বিহঙ্গেরই হিয়া নীড় বাসনায় ফেরায়।

বেলাশেষের পক্ষী সবে একসারিতে ভিড়ে,

দিনের শেষে নিজ নীড়ে যায় গো সব ফিরে।

আকাশপানে তাকিয়ে হেরি পাখীদের ঐ সারি,

মন কেমনের বিকালে কি অপূর্ব রূপেই নেহারি!

উড়ন্ত সেই পক্ষীকুলে মন যায় আজ হারিয়ে,

হৃদয় কয়ে যায়বার্তা দেয় সে মন নাড়িয়ে।

দিন গুজরানে সঙ্গী সবে একত্রে যায় বাসায়।

কষ্ট মাঝে সঙ্গীরে তারা পথে কভু না হারায়।

সুখদুখ ভাগে রয় সবে একে অপরের সনে,

একসাথে ফেরা সুখের নীড়ে আনন্দিত মনে।

অতি ক্ষুদ্র রয়েও বন্ধনেসঙ্ঘবদ্ধ আচরণে।

মানবজনম বুঝবে কবে ভালবাসা পরজনে!

ভালবাসায় সবারে রেখো অন্তরমাঝে,

জীবনসুখ ধরা দিয়ে যায় সকাল সাঁঝে।

মায়ের মতো ত্যাগী নয় কেহ,

সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি সারাক্ষণ

হাস্যময়ী সদা নির্মল পূর্ণ আলোকিত,

মিষ্টি মধুর শুভ আলিঙ্গনের পাহাড়         

একনিষ্ঠ কর্মযোগী নব নব উন্মাদনায়…

সকল কার্যের সফলতার উত্তম ধাপ,

পৃথিবীর আলো দেখিয়ে চলতে শেখায়…

সে যে জননীরূপে সম্মানিত।

রাগ -অনুরাগের ছায়ায় জন্মদাত্রীর আকাঙ্খার বিস্তার,

বাৎসল্যে টলমল আনন্দ উপচে ঝলমল!

ছেলে-মেয়ের স্বার্থে অপূর্ব তৃপ্তির বিস্তার,

যাতে নির্ভেজাল অকৃত্রিম আহ্লাদের সন্তোষ।

অসুখের সময় দারুণ সেবায় রত…

ইচ্ছার আধার হয়ে পাশে থাক,

দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একনিষ্ঠ মমতায় আবিষ্ট…

নিরলস অটুট বন্ধনে সত্য সুন্দর!

ভালোবাসা সমুদ্রের গভীরতার ন্যায়,

সন্তানের খুশির জন্য সদা নিয়োজিত…

সমস্ত বাঁধা অনায়াসে করে জয়,

নিষ্পাপ প্রেমে নিজেকে উজার রাখা

সুখের পরশে অনাবিল বিহ্বল চিত্ত,

দুনিয়ার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যে উপহার

মাতৃস্নেহ ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদ।

উদয়দের বাড়ির চারতলার জানলাটা খালি পড়ে ছিলো কতোদিন। কদিন ধরে দেখছি জানলার গরাদ ধরে উঁকিঝুঁকি মারছে এক কিশোরী। পুরোনো ভাড়াটে গেছে চলেসেই  জায়গা জুড়ে বসেছে নতুন। আজ দেখিঐ কিশোরী জানলা দিয়ে দুটি হাত বের করে কাকে যেন ঈশারা করে ডাকছে। তখন সবে সন্ধে নামছে। পশ্চিম আকাশে লালের আভা ধরেছে। আকাশের উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বকের সারি। একটা মন খারাপ করা আলো ওদের ডানায়। এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে ভাসতে ভাসতে এলো এক টুকরো মেঘ। জানলার কাছটায় এসে থামলো। কি গো মেয়ে এই ভর সন্ধেয় এমন জরুরি তলব কেনমুখ ভারহাসি নেইএমন দশা করলে কে শুনি?’ মেয়ে কলকল করে বলে উঠলো, ‘আমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই কারোর। যাকেই ডেকে বলি দুদণ্ড দাঁড়িয়ে যাওএকটু গল্প করিওরা আমার কথা শোনে কইসেদিন যেতে যেতে দুই টিয়া এসে বসলে আমাদের চালে। দুটিতে সে কি ঝগড়া। ওদের ডেকে বললামঝগড়া থামাও,  বারান্দায় এসে একবার বোসোনিজের হাতে ছোলা ভিজিয়ে রেখেছিতোমাদের খাওয়াতে চাই। আর সেই অবসরে শুনে নেবো ঐ হেলেপড়া শিরীষ গাছটার কথা। বারান্দায় বসলেছোলা খেলেআর তখনই মাথার ওপর চক্কর খেতে খেতে একটা চিল এলো ওদের দিকে তেড়েচম্পট দিতেই হলো। সেই থেকে আর ওদের দেখা পাইনি।  আর একদিনের কথা বলি। ঐ যে তোমার ঠিক পেছনে ভূতের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়াওর ডালে বাসা বেঁধেছে একজোড়া টুনটুনি। ওরা রোজ সকালে আমার জানলার কাছে বসে আমার ঘুম ভাঙায়। সকালবেলায় আমার ফুরসত কম। বাড়ির কাজপড়াশোনার কাজভাইয়ের সঙ্গে খেলাধূলার কাজআঁকার স্যার আসেনগানের দিদিমণি,  আরও কতো কাজই তো থাকে। ওদের বলিশেষ বিকেলে এসোবসে বসে তোমাদের গল্প শুনবো।  সেই যে ঝড়ের পর তোমরা দুটিতে কেমন করে বাঁচালে তোমাদের দুই বাচ্চাকেরোজ তোমরা বেলা না হতেই কোথায় যাও উড়ে সেইসব গল্প। ওরা মোটেই কথা শোনে না। ওরা বলেঐ সময়টাতেই আমাদের যতো দস্তুর কাজ। দিনের বেলা আমরা একরকম করে থাকি। রাত নামতে শুরু করলেই অন্য খেলা শুরু হয়। সেই খেলায় টিঁকে থাকা চাইনইলে তুমি যাবে হারিয়ে। আরো কতো কিছু বলে ওরাআমি তো সব বুঝি না। আচ্ছাশেষ বিকেলটায় সবাই অমন অস্থির হয়ে ওঠে কেন?’

এতক্ষণ চুপ করে সব কথাই শুনলো মেঘ। এইকথাতাই মেয়ের মুখ ভার। এই তো আমি কেমন তোমার কাছে এলামদুজনে গল্প করলাম খানিকতাতেও মন ভরলো না। শোনো মেয়েআমি চলি আমার খুশীতেসেটা যদি মেনে নিতে পারোতবেই সমঝোতা হয় তোমাতে আমাতেনইলে নয়। ওই যে মাথার ওপর মস্ত আকাশটা দেখছোরাত নামলেই ও কেমন গম্ভীর হয়ে যায় দেখেছোসকালের খুশীটা কেমন বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। ওর ওপর কি রাগ করা চলেতোমার ওই টুনটুনিটিয়া ওরা তো নিজের খুশীতে ওড়েনিজের খুশীতে চলে। তোমার খুশীতে ওদের বাঁধতে গেলে ওরা তা শুনবে কেন তাই বলি কি,  মন খারাপ করে লাভ কি ওই দেখোআকাশে উঠেছে ধ্রুবতারাড্যাবড্যাবে চোখ মেলে কেমন তাকিয়ে আছে আর হাসছে। চলি ভাইঐ খবর এলোআর দাঁড়াবার সময় নেই।‘ বলতে বলতে ভেসে চললো মেঘ। সঙ্গীহারা কিশোরী খানিক বুঝলো ওর কথাখানিক বুঝলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর পথের দিকে। প্রাণের গোপন কথাটি অধরাই রয়ে গেলো।

এই এক হয়েছে বিট্টুর জ্বালা। লকডাউনে স্কুল বন্ধ। প্রাইভেট পড়াও বন্ধ। কিন্তু বিট্টু বরাবর লক্ষ্য করেছে তার কপাল খুবই মন্দসুকুমার রায়ের নন্দলালের মত। মাত্র দুমাস প্রাইভেট পড়া বন্ধ থাকার পর নিরাপদবাবু আবার এলেন পড়াতে। ওনাকে দেখে বিট্টু তো কোন ছাড় ওর মাও অবাক! আমাদের বাড়ি থেকে তো ওনাকে বলা হয়নি পড়াতে আসার কথা। করোনা বিধি মেনে এখন কেউ কারও বাড়ি যাওয়া বারণকারও বাড়ি খাওয়াও নিষেধ। তাই হঠাৎ যেদিন বিনা নোটিশে নিরাপদবাবু বাড়িতে পড়াতে চলে এলেন বাড়ির সবাই প্রায় অবাকই হয়েছিল। আর বিট্টু হয়েছিল বিরক্ত। কেন রে বাবা.. স্কুলপ্রাইভেট পড়া বন্ধ আছে বলে মোবাইল গেমআর কার্টুন দেখার এমন অবাধ স্বাধীনতা সে তার দশ বছরের জীবনে কখনও পায়নি। সেটা নিরাপদবাবুর সহ্য হলো না! তাঁকে এই লকডাউনের মধ্যে আসতেই হলো।

অবশ্য আজ সকালবেলা সে যখন এক শালিক দেখেছে তখনই তার মনটা খুঁত খুঁত করছিল। তারপর আর এক শালিকের জন্য সে হন্যে হয়ে খুঁজেছেটুলু একদিন কথায় কথায় বলেছিল ওদের বাড়ির ছাদে অনেক পাখি আসেসেখানে পর্যন্ত বিট্টু ঢুঁ মেরে এসেছেনা কোথাও দু শালিকের দেখা মেলেনি। এখন বুঝতে পারছে তার মানে। আর এলেন তো এলেন সেই যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই ওনাকে ধরতে হলো। ভয়েস চেঞ্জ আর ন্যারেশন চেঞ্জ শেখাতে ছ’মাস ধরে নাকাল হয়েছেন। তারপর প্রায় তিন’মাস ধরে ইংরেজির টেন্স শেখাতে শেখাতে উনি নাস্তানাবুদ হয়েছেন তবু হাল ছাড়েননি.. শেখাবেনই।

– ‘বলি.. আর কতদিন লাগবে তোর টেন্স শিখতে?’

বিট্টু তো বলেই দিয়েছিল – ‘এতো জটিল জিনিস সারাজীবন ধরে শেখালেও মনে থাকবে না’।

বলা মাত্রই কানে কষিয়ে প্যাঁচ দিয়ে নিরাপদবাবু বলেছিলেন – ‘বাঁদরতোকে টেন্স না শিখিয়েও আমি ছাড়বো না। দরকার হলে মৃত্যুর পরেও তোকে আমি শেখাতে আসবো।’

        তারপর লকডাউনের দিনগুলো বেশ মহানন্দে কাটছিল। স্কুলের জন্য অবশ্য তার মাঝেমধ্যে মনখারাপ করতো। কিন্তু কি আর করা যাবে স্কুলই যখন খোলা নেই তখন যতটা পারে মোবাইল গেমগুলো সব শিখে নিতে হবে.. এরকমই ভাবনা ছিল বিট্টুর মনে মনে।

কিন্ত হঠাৎ করে স্যার চলে এলেন পড়াতে। কোনো স্যার বাড়ি বয়ে পড়াতে এলে তাঁকে তো আর বারণ করা যায় না। বিশেষ করে বিট্টুর ত ছাত্র হলে তো কথাই নেই। অগত্যা কি আর করা যাবে। বই নিয়ে বসতেই স্যার জিজ্ঞাসা করলেন- ‘এতদিন বাড়িতে বসে বসে কি করছিলি রে বিট্টু?’

        বিট্টু মুখ ভারী করে বললো- ‘মোবাইল গেম।’

        – ‘তা সে খেলা কেমন কই দেখি তো!’

        বিট্টু তো অবাক!! স্যার বলেন কি!! মোবাইল এনে দেখালে যদি ছুঁড়ে ফেলে দেন রাগে। ভেঙে গেলে মা বাপি কেউ আর আস্ত রাখবে না তাকে। স্যারকে তো আর কেউ কিছু বলবে না.. সব ঝাড় তার ওপরেই পড়বে।

বিট্টু বুদ্ধি খরচ করে বললো – ‘মা এখন ছোটমাসিকে ফোন করছে। আপনি এসেছেন না সেই খবরটাই দিচ্ছে। ছোটমাসিকে ফোন করলে অনেকক্ষন কথা বলে। আমি আপনাকে অন্যদিন দেখাবো। আজ  আবার টেন্স খুলি।’

        স্যার গম্ভীর হয়ে কি যেন দেখলেন বিট্টুর দিকে। তারপর বললেন- ‘নিশ্চইসেইজন্যই তো উঠে এলাম। বলেছিলাম না,, তোকে টেন্স না শিখিয়ে…’

        স্যার কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলেন। তারপর বললেন ‘কি হলোদেরি করছিস কেনআমার হাতে বেশি সময় নেই।’ – এই বলে আবার প্রথম থেকে শুরু করলেন। বিট্টুও মোবাইলটা বাঁচাতে বেশ মন দিয়ে শেখার ভান করলো। মাঝখানে মা এসে স্যারকে চা দিয়ে গেলেন। ততক্ষণে স্যার বোধহয় মোবাইল গেমের কথা ভুলে গেছেন। আজ যেন স্যার খুব মন দিয়ে ভালোবেসে আদর করে বিট্টুকে শেখাতে লাগলেন। কোনো রাগ-টাগ নেই স্যারের মনে।

        যাইহোক স্যার পড়িয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর বিট্টুর বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন। ফিরেই জুতো জামা খুলতে খুলতে ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘জানো দেশে কি যে রোগ এসে জুটলো আর বুঝি রক্ষে নেই কারও। এতো এতো চেনা পরিচিত মানুষগুলো হঠাৎ করে জ্বর হয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে আর ফিরছে না। শুধু মরার খবর আসছে। বডিও দিচ্ছে না।’

মা বললো – ‘আবার কার মরার খবর এলো?’

         -‘কেন তোমরা শোনোনিবিট্টুকে যিনি ইংরেজী পড়াতেন সেই নিরাপদবাবু কদিন থেকেই হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। আজ দুপুরে মারা যাবার খবর এসেছে। ওনার ছেলের সাথে দেখা হতে ওই তো বললো। খুব মন খারাপ লাগছে বিট্টুকে কত ভালোবাসতেন উনি।’

কলকাতা-গুয়াহাটি উড়ানইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স। সময় মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। খরচ-যাত্রীপিছু একশো সত্তর টাকা মাত্র। ১৯৭৬এপ্রিল মাস।

        সুপ্রতিমবাবুর মনে পড়েঐ উড়ানে তিনি যাত্রী ছিলেন অগ্ৰজপ্রতিম এক সহকর্মীর সাথে। এক অভূতপূর্ব উত্তেজনাউন্মাদনা মনে। তখন তিনি চব্বিশ বছরের এক ছটফটে যুবকপ্রাণশক্তিতে ভরপুর। স্মরণে আছেসেন্ট্রাল এভিনিউয়ে (বর্তমানে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ) ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সদর দপ্তরে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে তিনি উড়ানের টিকিট সংগ্রহ করেছিলেন। উড়ানটি ছিল সকালের দিকে। সুন্দরী মেঘবালিকারা পরিপাটি সাজে স্বাগত অভ্যর্থনা জানাতে দরজায় দাঁড়িয়ে। সমস্ত কিছু পরীক্ষা পর্ব চুকিয়ে উড়ানে উঠে প্রথমে এক নজরে ভেতরটা দেখে নেওয়া গেল। উড়ানের দরজা বন্ধ হলো। মেঘবালিকার সাহায্য নিয়ে কোমর বন্ধনী আটকিয়ে নিলেন সুপ্রতিমবাবু। উড়ান দৌড় শুরু করে দিলো। খানিক পরেই দেখা গেল মাটি ছেড়ে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে বিমান। নীল দিগন্তে ভাসমান সাদা ধবধবে মেঘরাশি ভেদ করে পাখা মেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে কানের ভেতরে ঝিঁ ঝিঁ ডাক শুরু হয়ে গেছে। যাত্রাপথের মাঝখানে একবার কলঘরে ঘুরে এসেছেন তিনি। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা। ঐটুকু ছোট্ট একটা জায়গার মাঝে সবকিছু পরিপাটি করে সাজানোনিখুঁত ব্যবস্থা। সুন্দর এক সুবাস ভেতরে। কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মসৃণভাবে বিমান ছুঁয়ে যায় গুয়াহাটির মাটি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সাথীকে নিয়ে। গুয়াহাটি বিমানবন্দর সেসময় ছোটব্যস্ততাও কম। কড়াকড়ি কলকাতার তুলনায় একটু শিথিল। যাহোককিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিজেদের সুটকেস বগলদাবা করে বের হয়ে আসা বিমানপোতের বাইরে। এখানে উল্লেখ্যএই বিমান ভ্রমণের জন্য সুপ্রতিমবাবু একটি একুশ ( ২১”) ইঞ্চির আকাশী রঙের সাফারি সুটকেস খরিদ করেছিলেন। সেটি ছিল যেমন মজবুত তেমনই সহজে বহনযোগ্য। সুটকেস টি এখনও বহাল তবিয়তে ভ্রমণসঙ্গী।

        গুয়াহাটির হোটেলে একরাত্রি বাস করে পরদিন সকালে সরকারী বাসে চড়ে শিলং পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা। সাড়ে তিন ঘন্টার সফর পাহাড়ি ঢালে। মন ভরে যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। বিকেল বেলায় চারটের আশেপাশে সময়ে শিলং পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা। শিলং এ দুদিনের পরিভ্রমণ পর্বে দর্শনীয় স্থানগুলো শেষ করে আবার গুয়াহাটি শহরে ফিরে আসা। এদিন ছিল ১৫ ই এপ্রিল- ১ লা বৈশাখ। অসম রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বিহু উৎসবের দিন। বাসে সফররত অবস্থাতেই রাস্তায় কয়েকটি নৃত্য-গীত সহযোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা পরিলক্ষিত হয়েছে। এদিন বেলার দিকে জাতীয় অভয়ারণ্য কাজিরাঙ্গায় হাজির দুজনে মিলে। নিজের শহর থেকে মাসখানেক আগে মানিঅর্ডার মারফৎ জঙ্গল পরিভ্রমণ  থাকাখাওয়ার জন্য অগ্ৰিম অর্থ প্রদান করা হয়েছিল জঙ্গল কর্তৃপক্ষের দপ্তরে। জাতীয় অভয়ারণ্যের বাংলোয় উপস্থিত হয়ে পরিলক্ষিত হল-শুধুমাত্র বিদেশি পর্যটকদের সাড়ম্বর বিপুল উপস্থিতি। এই দুজন বাঙালি তথা ভারতীয় মাত্র। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ছিল অপূর্ব। এদিন সন্ধ্যায় বাংলোর হাতায় জঙ্গল সম্পর্কে প্রচুর স্থির ও চলমান আলোকচিত্র প্রদর্শন সরকারি পর্যায়সাথে বিদেশি পর্যটকদের তরফে অরণ্যে ভয়াল এবং রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা-বিশেষ উপভোগ্য ছিল। সুপ্রতিমবাবুর মনে পড়ে যায়তিনি ঐ বাংলোয় অবস্থিত সরকারী দুর্লভ শিল্পবস্তু বিক্রয়কেন্দ্র থেকে দুটি ব্রোঞ্জ ধাতু নির্মিতঅসাধারণ কারুকাজ সমৃদ্ধ এক শিংওয়ালা গন্ডারের প্রতিমূর্তি (৩”) খরিদ করেছিলেন বিশেষ আগ্ৰহভরে। সে দুটি এখনও সযত্নে রাখা আছে।

        পরদিন ভোর বেলায় হুডখোলা জিপ গাড়িতে চড়ে জঙ্গলের অন্দরমহলে কুনকি হাতিশালার দোরগোড়ায় হাজির। গতকাল রাতে দু-এক পশলা বৃষ্টির দৌলতে আবহাওয়া ভারি মনোরম। এই প্রথম হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে জঙ্গল পরিভ্রমণের দুঘন্টা ব্যাপী এক রোমাঞ্চকর দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ। খুব কাছ থেকে এক শিংওয়ালা গন্ডার ও ছানা,  প্রচুর চিতল হরিণ বাচ্চা সমেতসাদা মোজা পরা বিশাল বপু বাইসনদূর থেকে জংলী হাতি দেখা গেল। সহকর্মী ভদ্রলোক তাঁর ক্যামেরা ইয়াসিকা–৬৩৫ র সাহায্যে শিশু সহ গন্ডারচলমান হাতি পর্যটকদের নিয়েসপরিবারে হরিণবাইসন ইত্যাদির বেশ কিছু আলোকচিত্র সংগ্ৰহ করেছেন। জঙ্গল পরিভ্রমণে মনের ভাঁড়ার পরিপূর্ণ,তৃপ্ত। সে রাতটা জঙ্গলে কাটিয়ে অদ্ভূত সব আওয়াজবিভিন্ন জীবজন্তুর ডাক-আওয়াজ শোনা আর নড়াচড়াদৌড়াদৌড়ি অনুভব করা। তারপর কখন যে ঘুম এসে গেছে। পরদিন গুয়াহাটি শহরে ফিরে আসা হয়েছে। এদিন এখানে ব্রম্ভপুত্র নদের বিশাল ব্যাপ্তি এবং পাহাড়ের ওপর দেবী কাম্যাখ্যার মন্দির পরিদর্শন সমাপ্ত হল। পরদিন সকালের কলকাতা উড়ানে নিজের শহরে ফিরে এসেছেন তাঁরা। এবার উড়ানে কোন রকম অস্বস্তি ছিল নাএকদম স্বাভাবিক। একটা বিষয় আগে উল্লেখ করা হয় নি – শিলং এ অনেকগুলো দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সর্বাধিক বারিপাতের জায়গা চেরাপুঞ্জি পাহাড় পরিভ্রমণ সম্ভবপর হয়েছিলকিন্তু এদিন সামান্য বারিপাতও ছিল না। এখন অবশ্য এই জায়গাটির দখলদার মৌসিনরাম।

 

সাম্যবাদ হল একটা অভেদ সুন্দর আদর্শ। – বলা যায় অনেকটা মেঘে ঢাকা তারার মতো একটা স্বপ্ন বা রূপকথা যা মানব সভ্যতায় সত্যি সত্যি কখনও গৃহীত হবে বলে মনে হয় না। দেশে বা বিদেশে উত্থিত সাম্যবাদী শক্তিগুলোকে দেখলে তো মৌলবাদী বলে মনে হয়। সাম্য আদৌ আছে কিনা জানতে হলে বোধহয় আতস কাচ দিয়ে খুঁজতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে মেঘ সরতে লাগলো। এদেশের কথাই যদি ধরিতো কি দেখতে পাইসাম্যের আড়ালে হয় ভণ্ডামি নয় গোঁড়ামি। ঝাঁ চকচকে বাড়িদামী গাড়িছেলেমেয়েদের শিক্ষা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেবিদেশি ব্র্যামণ্ডের সিগারেটসাধারণ গরীব মানুষ দরজায় এসে দাঁড়ালে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া…! তবু! তাঁরা নাকি সাম্যবাদী!

উঁহু। ভুল হচ্ছে একটু। সাম্যবাদী তো নয়! ওনারা তো বামপন্থী। তাহলে কি দাঁড়ালো?- বামপন্থা আর সাম্যবাদ আদৌ এক জিনিস নয়। কক্ষনো নয়। ওনারা নাকি সেকুলারঅথচ বিতর্ক বাধলে আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতোই যুক্তির ধারপাশ দিয়ে না গিয়েই আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।

আত্মসমালোচনাতওবা তওবা। ওসব আবার কেউ করে? “তবুও বামকেই চাই। বাম মানুষের স্বার্থে কাজ করে।” (নাকি দলের স্বার্থে?)  নিজের নিজের মতো করে সব দলই বোধহয় সাধারণ মানুষের জন্যে কিছু না কিছু করে (দেখায় আর কি)। আর অনেকটাই নিজের পকেটে ভরে। কেউ কম কেউ বেশি। বামপন্থীরা একটু কম করে ভরেন বুঝিজানিনা। তবে লোকমুখে শুনি। মোদ্দা কথা হল এই ঢপের গণতান্ত্রিক দেশে বামপন্থী দক্ষিণপন্থী সবকয়টি রাজনৈতিক দল একে অন্যের জেরক্সকপি। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু অনেক দূরদর্শী ছিলেন। তিনি জানতেন দেশ গড়তে হলে প্রথমেই গণতন্ত্রকে আনা যাবে না। তাই তিনি অন্য কিছু পরিকল্পনা করেছিলেন। সে আর হল কই! শয়তানের  দল তাঁকেও সরিয়ে দিল! যাই হোকবাম আর ডানে তো সত্যিই কোনো তফাৎ নেই! তবে সাম্যবাদকোথায় সেই অভেদসুন্দর সাম্যযে সাম্যের জয়গানে মুখর হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলশুধু লেখনীতে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও যে সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি! এখনও তো চারপাশে চেয়ে দেখি ধর্ম জাতি লিঙ্গ জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে হিংসা হানাহানি বা কর্তৃত্ব প্রভুত্ব ফলানোর উগ্র মানসিকতা! খবরের কাগজে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের বহর দেখলে লজ্জায় ঘৃণায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। অবাক হয়ে যাই যখন খুব শ্রদ্ধাভাজন কেউ আমার নামের পদবী শুনে জিজ্ঞাসা করেন আমি ঠিক কোন জাতের?  সাম্য যদি থাকতো তবে তো মানুষ নিজেকে এবং সকল মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই দেখতো। কিন্তু তা তো কেউ দেখে না! তবে শুধু রাজনীতিকে দুষে কি লাভ! সাম্য তো আপামোর মানুষের মননেও ঠাঁই পায়নি। তাহলে সে আছে কোথায়?  কোথায় সেআছে। সাম্য আছে স্বপ্নবিলাসীর  স্বপ্নে আর রূপকথায়।

প্রেক্ষাপটঃ- সপ্তদশ শতকের আশির দশকের মুঘল আমল। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল। দেশে ঘোরতর অনাচার ও সংকট। চারিদিকে মুঘল বাহিনী জোর করে অ-মুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করছেআর যারা দিতে পারছে না তাদের বাধ্য করছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে। গ্রামে গ্রামে জ্বলছে আগুন। মুঘল বাহিনীর অত্যাচারে সাধারণ মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে।

(কুঁড়ে ঘরে এক হিন্দু পণ্ডিত পুঁথিপত্র ও ঘরের জিনিস পত্র গোছগাছ করছে। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর চারজন ছাত্র।)

প্রথম ছাত্রঃ    গুরুদেব… আপনি আমাদের আর পাঠ দেবেন না কাল থেকে?

পণ্ডিতঃ (গোছাতে গোছাতে) নাতোমরা আজ থেকে মুক্ত। তোমাদের বাবা গতকাল মুসলমান হয়েছে। তাই তোমরা আর পাঠশালাতে পড়বে নাহয়ত তোমাদের বাবা তোমাদের মকতবে ভর্তি করাবেন।

দ্বিতীয় ছাত্রঃ    পাঠশালা হোক বা মকতব… এতে আর আলাদা কি গুরুদেবআপনি কেন চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?

পণ্ডিতঃ         মুঘল বাদশা জিজিয়া চায় শিস্যআমি দিতে পারব না।

তৃতীয় ছাত্রঃ    সে তো আমার বাপও দিতে পারেনি। কই সে তো চলে যাচ্ছে না।

পণ্ডিতঃ         তোমার পিতা জিজিয়া দিতে পারেনি বলে মুসলমান হয়ে গেছে। আমি তো পারব না… তাই পালাচ্ছি।

চতুর্থ ছাত্রঃ     এসব হিন্দু মুসলমান আমরা বুঝি না… আমরা আপনার কাছেই পড়ব গুরুদেব।

প্রথম ছাত্রঃ    আমরা আপনাকে যেতে দেব না।

পণ্ডিতঃ         তোমরা এখন শিশুতোমরা এসব বুঝবে না… ধর্ম বড় কঠিন বিষয় বৎস। যে একে ধারণ করে সে কিছুতেই  বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। আমি হিন্দু ধর্ম ধারণ করেছি মনে প্রাণেতাই মুসলমান হতে পারব না… আর জিজিয়া কর দেবার সাধ্যও আমার নেই। বাদশা নিদান দিয়েছেন… যে যত গরিব তার থেকে তত বেশি কর আদায় করবে। আমি গরিব ব্রাহ্মণআমি কি করে অত টাকা দেব বলোতাই প্রাণে ও ধর্মে বাঁচতে পালাচ্ছি। 

দ্বিতীয় ছাত্রঃ    কি এই জিজিয়াযার জন্যে আপনি আমাদের মতো আপনার এতো প্রিয় শিস্যদের ত্যাগ করে চলে যেতে চাইছেনআমাদের থেকেও কি খুব বড় এই জিজিয়া?

পণ্ডিতঃ হয়ত বড়। জানিনা। তবে এই জিজিয়া এক প্রকার কর… যা মুসলমান শাসকরা অ-মুসলমানদের ওপর চাপায়… যার প্রতিদানে তারা অ-মুসলমানদের দেখভাল করে। সুরক্ষা দেয়। তুমি মুসলমান না হলে এই কর দিতেই হবেনা হলে তুমি বাঁচবে কি মরবে তার কোন নিশ্চয়তা শাসক দেবে না।

তৃতীয় ছাত্রঃ    এ তো অন্যায়!

পণ্ডিতঃ         একশ বছর আগে এক মুঘল বাদশা ছিল… আকবর তাঁর নামখুব ভাল রাজা ছিল। তিনি সব ধর্মের মানুষকে এক চোখে দেখতেন। তিনি এই নিষ্ঠুর কর তুলে দিয়েছিলেন ১৫৬৪ সালে।

চতুর্থ ছাত্রঃ     তাহলে এখনকার বাদশা কেন আবার একে চালু করল?

পণ্ডিতঃ         তা কি করে বলব বলো… রাজার খেয়াল…

দ্বিতীয় ছাত্রঃ    এই বাদশা কি চায় না কোন অ-মুসলমান থাকুক দেশে?

তৃতীয় ছাত্রঃ    খুব বাজে রাজা!!

পণ্ডিতঃ         এ ভাবে তাঁকে বাজে বলা যায় না বৎস। শুনেছি যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে রাজকোষ শূন্যঅনেক অর্থ চাই… কিন্তু এভাবে ধর্মের নামে অর্থ আদায়ের চেষ্টাটা…

চতুর্থ ছাত্রঃ     অন্যায়… অন্যায়…

প্রথম ছাত্রঃ    এতো ধর্ম কেন এলো গুরুদেবসবাই যদি এক ধর্মের হতোতাহলে তো এতো সমস্যা থাকত নাতাই না গুরুদেব?

পণ্ডিতঃ         খুব সত্যি কথা বলেছো… আমি এক সুফি বাবার কাছে গিয়েছিলাম… তিনি বলেছিলেন… সব ধর্মের একটাই কথা… সত্য… আর সত্য হল আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হওয়াই সব থেকে বড় ধর্ম। তাই আমাদের সবার একটাই ধর্ম।

তৃতীয় ছাত্রঃ    তাহলে এই যে হিন্দুমুসলিমআবার বৌদ্ধজৈন… এতো ধর্ম মানুষের?

পণ্ডিতঃ         এ যে বড় কঠিন প্রশ্ন করলে পুত্র। আমার রাস্তা এবার ছাড়ো… এখুনি সৈন্য এসে যাবে। আমায় দেখলেই গর্দান নেবে তারা… আমায় যেতে দাও…

তৃতীয় ছাত্রঃ    এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান গুরুদেব…

পণ্ডিতঃ         (যেতে যেতে) তোমাদের যে শিক্ষা আমি দিয়েছি… তা অন্তরে জাগিয়ে রেখো… তোমার ধর্ম তোমার কাছেই থাকবেআর দুনিয়ায় যাকে দেখবে মনে হবে সেই তোমার ধর্মের লোককিন্তু বাদবাকি আর যা ধর্ম আছে সে সবে গা ভাসিও না… তাহলে তোমাদেরও আমার মত এভাবে পালাতে হবে…

(এই বলে পণ্ডিতের প্রস্থান। ছাত্ররা দূর পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নেপথ্যে ভাষ্য ভেসে আসে…)

নেপথ্যেঃ       এভাবেই জিজিয়া কর মুঘল ভারতে ধর্মীয় বিভেদ বাড়িয়ে তুলেছিল… এই ধর্মের হানাহানি আজও দেশের আনাচে কানাচে মানুষের মনের ভিতরে গুপ্ত রোগের মত লুকিয়ে রয়েছে… জিজিয়া উঠে গেলেও ধর্মের ভয় দেখিয়ে বিভেদ আজও চলছে… জানিনা… কবে আবার কোন আকবরের দেখা মিলবে।