কবিতা
বিধায়ক ভট্টাচার্য
সোমা মুখোপাধ্যায়
ঈশিকা ভট্টাচার্য্য
স্মৃতিরেখা মুখার্জী
মিলি ভট্টাচার্য্য
দেব দত্ত
ঝর্ণা ভট্টাচার্য্য
গোপা চক্রবর্তী
প্রিয়দর্শিনী রূপ
শিল্পী দাস
গল্প
হারাণ খুড়ো উত্তম চক্রবর্ত্তী
মাঝে মাঝে আকাশটা অনেক কাছে নেমে আসে
চাঁদ যেন ঘরের সিলিংএ ফিলামেন্ট লাইট,
কখোনো ধর্মতলার মনুমেন্টটা মাথা নামিয়ে
আমায় বলে যায় গুড নাইট !
আমি তো দূর থেকে ভিক্টোরিয়ার পরীকে দেখি
আমি তো গন্ধে মাতাল খুঁজি ফুলের গাছটাকে !
বুঝি নি পরীটা আমার দিকেই ছিলো তাকিয়ে,
শুধু দুটো চোখই চিনিয়ে দিল মাছটাকে !
দু’কলম ছন্দ লেপে দিয়ে লিখেছি মানেই
কবিতা লিখেছি,ভুল সেটা আমি জানি৷
এখোনো বাকি আছে তার কথাগুলো লিখতে !
আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাটা লিখতে পারি নি,মানি !
যোগ্যতা থেকে ভালোবাসা পেয়েছি ঢের বেশী
যদিও রাত্রির কাছে কখোনো সূর্য চাই নি আমি৷
শুধু তোমার কাছে নিশ্চিন্ত একটা যাপন চেয়েছি
সে কথা উহ্যই থাক যেহেতু,
তুমি নও অন্তর্যামী !
পূর্বরাগ
তোমাকে দেখলেই শান্ত হয় মন,
সামনে থাকলেই সুখ সারাক্ষণ।
জীবনে কখনোই সম্পর্কে চাই না,
সমুদ্র, তোমাতেই জলের বাসনা!
অভিসার
কপাল থেকে সরিয়ে দিলে চুল,
কাঁধের উপর যেই রেখেছি মাথা…
ঝিম দুঃখ উবে যায় বিলকুল,
শুকনো ডালে ফাগুন উজ্জ্বলতা…
বিরহ
দূরত্ব কাছে আনে
চুম্বকটান।
অন্তর সংগোপনে
সমস্যমান!
মান
আর কত দূরে থাকবে প্রিয়ে ?
না দেখে দেখে হাফসানো হিয়ে।
ভুল মেনে মাফ চাইছি দেখ…
মানি তুমি, সংগোপনে থাকো!
আক্ষেপানুরাগ
কেন কেন? কী বিভ্রমে করেছি এমন?
ফিরে এসো, ফিরে এসো, লক্ষ্মীটি কেমন !
তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিকভ্রান্ত আমি।
জ্বলছি অহরহ জানেন অন্তর্যামি !
কাঁটাতার ডিঙিয়ে যেই ছুঁয়েছি তোমাকে
তুমি কেমন পাহাড় হয়ে গেলে।
ভেবেছিলাম আমি নদী হবো,
তুমি বালুচর।
রোজ রোজ ভিজিয়ে দেব তোমাকে
তুমি যে পাথর হয়ে গেলে।
তোমাকে ভেজাবো কেমন করে !
ঠিক আছে উলটে দিলাম সব,
তুমি জল হও আমি বালি।
ভেজাও আমাকে।
বা আঙুল হয়ে ধরো আমাকে।
আমি তোমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে ঝরে পরি।
পাহাড় হয়োনা তুমি।
আমি যে ডিঙাতে পারিনা,
জানিনা ডিঙাতে।
আমি লেপ্টে থাকতে পারি।
মিশে যেতে পারি তোমার অনুভূতির সঙ্গে।
এমনটা হতে পারে,
এই মুহূর্ত থেকে
আমি ঈশ্বর।
তুমি চাইবে আমার কাছে
যা কিছু চাওয়া আছে
আর আমি কল্পতরু হয়ে
দিয়ে দেব একটা আকাশ
কিংবা গোটা একটা পৃথিবী
কিন্তু,তুমি তা চাইবে না আমি জানি।
তোমার ছোটো চাওয়ার কাছে
তাই তো হেঁটমুন্ড
শুধুই মানুষ
চিন থেকে গায়ে ভেসে দেশে দেশে যাচ্ছে
এমনই বিচ্ছু এরা বিশ্ব কাঁপাচ্ছে।
ভয়ে ঘরে বন্দী ছোট বড় দস্যি
বিচ্ছু গুলোর কাছে তোরা সব নস্যি।
আদরে বাঁদর তোরা এতোদিন জানতাম
বাঁদর অনেক ভালো এরা সব শয়তান।
হাত নাক গলা বেয়ে ফুসফুসে বাঁধে ঘর
চোখে দেখা যায়না
বুক করে ধড়ফড়।
টুপটাপ প্রাণ নেয় এতো বড়ো বজ্জাত
দল, জাত, ধর্ম ভেদাভেদ কুপোকাত।
দেশে দেশে গবেষণা রুখতে এ ‘করোনা‘
নিঃশেষ হলে ওরা একতাটা ভেঙো না!
ডাক্তার যুদ্ধে দিনরাত একাকার
তুমি আমি ঘরে থেকে যুদ্ধে অংশীদার।
জব্দ হবেই ওরা
তোরা শুধু ঘরে থাক
তুরতুরে রাক্ষস রুখতে দেশ সজাগ।
কিম্ভুত করোনা আর বেশী বেড়ো না
পৃথিবীতে তোমাদের দাপট রবে না।
অনেক নিয়েছ প্রাণ টিকা এলে জব্দ
‘করোনা‘ শেষ হাসি আমরাই হাসবো
এক পশলা বৃষ্টি ধুয়ে দিল যন্ত্রণাকে
আর এক পশলা বৃষ্টি আনল প্রেম।
বৃষ্টি ভাসায় নদী,
নদী ভাসায় জীবন
যে জীবনে সে সমুদ্রে তোমাকে জানলেম।
বৃষ্টি আমি তোমাকে জানতে চাই
বৃষ্টি আমি তোমাকে জানতে চাই
আর জানতে চাই তোমার, পতন মুখরতা
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে।
ভারত মহান
অমূল্য হৃদয় অকালে নিলো প্রাণ
বীর-জওয়ান।
পরিবার আঁকে বিজয়ার আলপনা
সবার মনে আন্দোলনের ভাষা
তার বোবা অলিন্দে নীরবতা।
বুকে লয়ে টলটল ইঁদারা
এ জীবনে নেভেনা।
তাজমহল গড়েছে যে
বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে বিদায় নিয়েছে
ঘুমিয়ে কবরে বধিরতা।
বেণীমাধব আমি কিন্তু তোমার বাড়ি যাব না।
তোমার স্ত্রীকে অপূর্ব সে আলো বলতে পারবো না।
বেণীমাধব আছো থাকো মনের কোণে একান্তে,
কাছে গিয়ে চাই না তোমার
ঘর-সংসার ভাঙতে।
বেণীমাধব আমি কিন্তু কালো মেয়ে নই,
বলবও না কেমন হবে যদি নষ্ট মেয়ে হই!
আমিও দিব্যি আছি
তুমি আছো যেমন
মাঝে মধ্যে
একটু-আধটু কেমন করে মন।
একটু-আধটু
লিখি-টিখি
নই সেলাই দিদিমণি
তোমার জন্য উজাড় করবো ভালোবাসার খনি,
তেমন বোকা নই।
যদি হয় আজ শেষ বিদায়ের রাত,
হিম কঠিনে শেষ ঘুম,
নেই আফশোস !
তোমায় মেখেছি দুর্ভেদ্য অঙ্গ ভাঁজে,
পরতে পরতে,
সবার চোখের আড়ালে,
শহুরে নিরিবিলি বহুতলে।
মিথুন মুদ্রা মন্থনে ফেনীয়ে ওঠে বিষের অমৃত,
নশ্বর দেহ যায় যদি, যাক পচে, গলে
বিষের গাঢ় নীলে।
সর্বাঙ্গ পৌরুষ স্পর্ধার দৌরাত্ম্য,
স্পর্শে – করেছি আকণ্ঠ পান,
শীতল মরদেহে চৈত্র লু-তাপ, ঝাঁকুনি, কাঁপুনি, আনচান,
আত্মা পেয়েছে অমরত্বর বরদান ।
ঝেঁকে ঝেঁকে আসে হিংসুক জন্তুর লোটলোটে জিভ,
চিটচিটে ঠোঁট,
চেটে লেপে যায় উবর-খাবর শরীর উঠোন,
শিকড় বেয়ে উঠে আসা সেক্স- হরমোন ,
ঘূর্ণির মত পাক খায় ধমনী শিরায়,
স্ফীত হয় ক্ষীণকায়া স্তন।
শুষ্ক নদী গর্ভে,
পুরুষ বীর্যের ভরা জোয়ার,
নাভী পদতলে বিপ্লবী কোন্দল,
উৎসুক কোমল কমল-যোনি দ্বার ।
নেই আফশোষ !
যদি হয় আজ শেষ ঘুম, দিতে হয় নিজ হাতে শেষ রাতের বিদায়,
তুলে দিও আমাকে জ্বলন্ত চিতায়,
আস্ত আমিটাই কুঁকড়ে নরম তুলেতুলে,
তোমার কব্জায় ।
জ্যোৎস্না খুঁজেছিলো সেদিনের রাত,
গাছগুলো খুব দুলছিলো এলোমেলো বাতাসে।
দেখো পাতাগুলো সোনালী রঙের মুখাপেক্ষী।
শিশির ছুঁয়ে পাতারা স্নান সেরে নিচ্ছে কি ?.
নিশুত রাত শেষে সূর্যকে উপহার দিও ফুল।
ঋণের বোঝা তোমার বাড়ছে কি থরে থরে?
আর তুমি কবিতাকে দেখো
নিরাভরণ ছেড়ে..
কবিতা কেন আর আসে না ?
তোমার আত্মতুষ্টির সৌজন্যে
কবিতা আজ শোক উৎসবে মেতেছে।
সেবার ওর উরুতে আদর রেখেছিলে,
জোছনা খুঁজেছিল সে, মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে।
গাছের খসখসে গায়ের উপরে চেপে,
কবিতার এলোমেলো অক্ষর গুলো,
সাজিয়েছিলে প্রেমিকের ছদ্মবেশে ।
গাছেরা দেখেছিলো কবিতার কান্না,
সেদিন কবিতার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিলো
ছাই রঙা জল
থৈথৈ চোখ দুটো সেদিন, ডুবে গেলো গহীন সমুদ্রে।
উলঙ্গ কবিতার নাভির নীচে,
হাজার লাল গোলাপের জন্ম হলো…
নিশ্চুপ নির্বাক গাছেরা সেদিন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিলো …
তোমার নির্মায়িক আশ্লেষ সঙ্গম।
তুমি পরিত্যক্ত দূষিত নাগরিক হয়ে উঠেছো।
গাছেরাও জেনেছে সেদিন, তুমি কখনো আর
কবিতা লিখতে পারবে না।
অনেক দিন পর বাড়িতে এসে হারাণ খুড়ো কে দেখলাম। কাঁসাই চরে।
হারান খুড়ো ছিল আমাদের বাড়ির মুনিশ। ছোটবেলা থেকেই তাকে খুব ভালো লাগতো। সে বাবার খুব বিশ্বাসী ছিল।
ছোটবেলায় একদিনের কথা খুব মনে পড়ে।
সবে সন্ধ্যা। মা তুলসীতলায় প্রদীপ হাতে। হঠাৎ হারান খুড়ো মাঝ আঙিনায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো -আর ডর লাই গো মাঠাকরুন, ইবারে আর ডর লাই ।
মা অবাক হয়ে হারাণ খুড়োর দিকে তাকিয়ে। আমি আর আমার পিসতুতো ঝিঙ্কু দিদি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ঠাকুমা বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে হারাণ ?
হারাণ খুড়ো আবারও বলল, আর কুনঅ ডর লাই গো মা ঠাকরুন।
আমি ও ঝিঙ্কুদিদি একে অপরের মুখ চাওয়া- চাওয়ি করছি। ব্যাপারটা বুঝে নিতে সময় লাগছে।
মা বললেন, কেন রে হারাণ, কিসের ভয় ছিল, যে আর নেই।
হারাণ খুড়ো বলল, উটাই ত বলছি গিন্নি ঠাকরুন। হামদের গাঁয়ের উপর দিহে উই যে বাস ট রাত্যের বেলি কহিলকাতা যায় ন, উটা যাওয়ার সমুই হামদের গাঁ ছামুতে কাটিনে,উয়ার পর লেদাকেঁদি ,বয়রামুঢ়ি আর বনকাটা বিরিজে প্রায় লিতই ছিনতাই হয়। চোর গিল্যান পিসিঞ্জারদের দমে মাইরে, শির বিদকাই ছিৎরাফুটা কইরে সোব কাড়্যে লেই। আইজ হামার লুলহু গেলহ কহিলকাতা, কাইজ ধুঁউড়ত্যে। জুয়ান হয়্যেছে ন ? উয়াকে বাসে চাপাত্যে যাইয়্যে দেখি দু-দুটা গাঁওলি পুলহিস বাসে ডেলহি যাছ্যে। উই জন্যি বলছি, আর কুনঅ ডর লাই। দুগ্গা দুগ্গা।
ঝিঙ্কুদিদি বলল, ও খুড়ো, গাঁওলি পুলিশ আবার কি ?
হারাণ খুড়ো বলল, উটাও লাই ঠাঁউরাল্যে দিদি ঠাকরুন? গাঁ ঘরের উদমা ছাল্যারা লাইসিন কইরে ইকটা কইরে দুলনা বন্দুক কিন্যেছে। উয়াদের কে বাসওয়ালারা বেরুইন দিহে বাসে ছিনতাই টেকাবার লাগ্যে রাখ্যেছে। উই জন্যি ত বইলছ্যি ,আর কুনঅ ডর লাই।
ঘন্টা খানেক পরেই গাঁয়ে খবর এল কাটিনে পানিফলের মত লোহার ফলা দিয়ে বাসের চাকা পাংচার করে ছিনতাইবাজরা বাসের সব যাত্রীদের টাকা পয়সা লুট করেছে। বাসের দুজন বন্দুকধারীর বন্দুকও লুট হয়েছে। সবাই বাড়ি ফিরলেও হারাণ খুড়োর ছেলে আর বাড়ি ফেরেনি।
পরদিন কানাঘুষো তে শুনলাম, হারাণ খুড়োর ছেলে যাত্রী সেজে ঐ বাসে ছিল।সেও নাকি ছিনতাইকারী। পুলিশ হন্যে হয়ে ছিনতাইকারীদের খুঁজছে।
তারপর থেকে হারাণ খুড়োর ছেলেকে আর পাওয়া যায়নি। সহজ সরল হারাণ খুড়ো আমাদের বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলো।
এখন কাঁসাই নদীর ধারে একাকী শূণ্য চোখে ছেলেকে যেন খুঁজে বেড়ায়। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, — আর কুনঅ ডর লাই, কুনঅ ডর লাই, কুনঅ ডর লাই ।