নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন-যন্ত্রণার সার্থক রূপকার হাসান আজিজুল হক :  সৈয়দ হাসমত জালাল

 

কবিতা

 

অজিতেশ নাগ

আর্যতীর্থ

শ্রাবণী বসু

রণেশ রায়

দীপান্বিতা হক

আলো চৌধুরী

ঈশিকা ভট্টাচার্য্য            

চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়

মধুমিতা ঘোষ

তানিয়া ব্যানার্জী

তরুণ গোস্বামী

সিক্তা

অজয় চক্রবর্তী

মৈত্রী

দীপা সরকার

‌‌প্রদ্যুৎ রায়

আইভি দত্ত

তরুণ কুমার ইন্দু

 

গল্প

মহেশ (এক ভালোবাসার নাম )                অজন্তা প্রবাহিতা

মিথ্যেটাই যখন সত্যি                           রণেশ কুমার রায়

নিশির ডাক                                    অগ্নিমিতা দাস

গরু                                          আর্যতীর্থ

 

ধারাবাহিক

 

সান্দাকফুতে ওরা ছয়                        নমিতা দাশ

 

বড় গল্প

 

বন্ধুত্ব                                           গোপা দাস

 

ভিডিও

 

তাপসী ব্যানার্জী

টুম্পা রায়চৌধুরী

ভবেশ পাত্রর আবৃত্তি, কবিতা- তাপস মহাপাত্র

গত ১৫ নভেম্বর রাজশাহী শহরে তাঁর নিজস্ব বাসস্থানে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে নটা নাগাদ প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তার আগে বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। তাঁর  মৃত্যু সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে এক বড়ো ক্ষতিসন্দেহ নেই।

সারাজীবন তিনি প্রগতিশীলধর্মনিরপেক্ষ মানবতার পক্ষে কথা বলেছেনকলম ধরেছেনপথেও নেমেছেন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের প্রতিবাদে।

হাসান আজিজুল হক আদতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। ১৯৩৯ সালে তাঁর জন্ম বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত যবগ্রাম নামে একটি গ্রামে। ১৯৬১ সালে তাঁর পরিবার যবগ্রাম ছেড়ে চলে যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায়। তাঁরা সম্পত্তি বিনিময় করে চলে গিয়েছিলেন। তাই কোনো দুর্দশার মধ্যে তাঁদের পড়তে হয়নি। কিন্তু সেসময় তিনি আশেপাশে বহু পরিবারকে দেখেছিলেন যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছে। দেখেছেন তাঁদের কী অমানবিক কষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তখনই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে কী বিষবৃক্ষই না রোপণ করা হয়েছে। তাঁর এইসব অভিজ্ঞতা রূপ পেয়েছে তাঁর এক-একটি ছোটগল্পে এবং পরবর্তী সময়ে উপন্যাসেও।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল‘ পত্রিকায় পর্যন্ত হয়েছিল তাঁর গল্প শকুন এটি বেশ চমকে দিয়েছিল বিদগ্ধ পাঠকদের। একটি শকুনকে কেন্দ্র করে এগোচ্ছিল গল্পের প্রাথমিক ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু গল্প যত এগোয়ততই বিভিন্ন বাঁক নিতে থাকে তার রূপ।

সুদখোর মহাজন জমিরদ্দি যেন সেই শকুন। কিন্তু গল্পের শেষ পর্যায়ে এক অদ্ভুত চমক অপেক্ষা করে থাকে। কাদু শেখের বিধবা বোনের সঙ্গে এক অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে জমিরদ্দি।  হয়ত তাকে বাধ্য করে ওই সুদখোর জমিরদ্দি। আর ওই সম্পর্কের ফলে জন্ম নেয় অপুষ্ট মৃত শিশু। শেষে মৃত শকুনের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় মৃত শিশুটিকে। শকুনের দল নেমে আসছে দেখে সবাই কৌতূহল নিয়ে ছুটে যায় দেখতে। আসলে ওই মৃত শিশুর লোভে আসছে শকুনের দল।

বস্তুত সমাজের বিকারক্ষমতাবান লোভ এবং  অর্থশক্তির কাছে দরিদ্রের অসহায় আত্মসমর্পণ– এরকম এক নগ্ন সমাজ-বাস্তবতার সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন হাসান আজিজুল হক।

রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ‘ পত্রিকায় তাঁর লেখা একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে‘ গল্পটিও বেরিয়েছিল ১৯৬০ সালে। এরপর থেকে ব্যতিক্রমী লেখক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকেন তিনি।

তাঁর বহু-আলোচিত গল্প আত্মজা ও একটি করবী গাছ।‘ তাঁর ওই নামের গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এই বিখ্যাত গল্পটিতে ধরা আছে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া একটি পরিবারের   অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের রূপ। এখানে করবী গাছ একটি প্রতীকযা আসলে দেশভাগের সেই বিষবৃক্ষ। করবীর কয়েকটি বিচি খেলে মৃত্যু অনিবার্য। পরিবারের কর্তা বৃদ্ধ লোকটির কোনও উপার্জন নেই। সে বাধ্য হয়ে নিজের কন্যাকে ঘরোয়া দেহব্যবসার কাজে লাগিয়ে দু-মুঠো অন্নের 

সংস্থান করে। সে জানেকোনোদিন তাকে হয়ত ওই করবীর বিষাক্ত বিচি খেয়েই আত্মহত্যা করতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বহুচর্চিত একটি উপন্যাস আগুনপাখি ২০০৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্যে ২০০৮ সালে কলকাতায় তিনি পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার। এই উপন্যাসের শুরু দেশভাগের কয়েক বছর আগে থেকে এক গল্পের মধ্য দিয়ে। একটি গ্রামীণ পরিবারের এক গ্রামীণ গৃহিনীর আত্মকথনে লিখিত।অবিভক্ত রাঢ়বঙ্গ এই উপন্যাসের পটভূমি। দুর্ভিক্ষমহামারীসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগ উঠে এসেছে ওই পটভূমিতে।

উপন্যাসের শেষে পরিবারের কর্তা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে চায় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু তার গৃহিনীউপন্যাসের মূল কথক চরিত্রথেকে যেতে চায় তার শ্বশুরের ভিটেতেই। তাকেই তো সে নিজের বাড়ি বলে জেনে এসেছে সারাজীবন। সে বলে, ‘একই দ্যাশএকইরকম মানুষএকইরকম কথাশুধু ধম্মো আলাদাসেই লেগে একটা দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেলই কি কুনোদিন হয়?’ এ প্রশ্নের উত্তর নেই তার স্বামী ও সন্তানদের কাছে। শেষ পর্যন্ত তারা সবাই দেশ ছেড়ে গেলেও এই ভিটে ছেড়ে গেল না সেই বয়স্ক গ্রাম্য নারীটি। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগলেও একসময় তার মনে হয়সকাল হলে সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে সে উঠে দাঁড়াবে একাই।

হাসান আজিজুল হক তাঁর সাহিত্যের বিষয়বস্তু করেছেন গত পাঁচ-ছয় দশকেরও বেশি সময়ব্যাপী ঘটে যাওয়া বাঙালি জীবনের সামাজিকরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনাপ্রবাহকে।

একই সঙ্গে তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব নির্মাণরীতি। ভাষা ব্যবহারেবাক্যবিন্যাসেআখ্যান রচনায়চিত্রকল্প এবং রূপক ও উপমাতেও তাঁর নতুন নতুন প্রয়াস চোখে পড়ে। কোনও প্রথাগত সাহিত্যতত্ত্ব মেনে তিনি চলেননি।

হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশে বসবাস করলেও এপার বাংলাও ছিল তাঁর হৃদয় জুড়ে। মহাশ্বেতা দেবীশঙ্খ ঘোষদেবেশ রায় এবং আরও উল্লেখযোগ্য কবি- সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি জগতের মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর হৃদ্যতা। তাঁর লেখার মধ্যে বারবার উঠে এসেছে বিস্তৃত রাঢ়বঙ্গ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। পরে ১৯৭৩ সাল থেকে একটানা ২০০৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই। সেখানেই ছিল তাঁর স্থায়ী বসবাস। কিন্তু দেশভাগ যে তিনি কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননিতা তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট। সুযোগ পেলেই তিনি ঘুরে যেতেন তাঁর জন্মভিটে যবগ্রাম। 

তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম যবগ্রামে  তাঁর শৈশব-কৈশোরে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর দুরন্ত দিনগুলির কথাতাঁর পরিবারের কথা। দেশভাগসাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাঁর সত্তাকে খণ্ডিত করতে পারেনি কখনও। অবিভক্ত রাঢ়বঙ্গের একক প্রতিনিধিত্ব করতেন  হাসান আজিজুল হক। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের এই দিকটিতেও তৈরি হলো এক অপূরণীয় শূন্যতা।

বলেছিলাম সঙ্গে যাবযেতে পারিযদি সেই চোখের দৃষ্টি দাও,

সাথে শুধু নেব কাকভেজা বাতাসকে,

সেই সন্ধেসেই চোখসেই মৃত্যুজয়ী সম্ভার।

বলেছিলাম রসদ কিছু থাকঅন্য পথ যদি নাই পাও,

অনেক হিমখনি খুঁড়ে তুলে নেব অনেক অপাপবিদ্ধ ঘাসফুল,

অনেক দুরের বন্দরে আশ্রয় খুঁজে নেবযদি সাথে নাও।

হঠাৎ হেসে ফেলে বুকের ছাইয়ে পেতে নেব চির আসন,

চোখে জড়িয়ে নেব পরিপক্ক ফসল জন্মাবার স্বপ্ন।

ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় উড়িয়ে দেব বিষণ্ণ স্মৃতির ঘুড়ি।

কান্নার জল ছড়ায় শুধু বোকারাআমি রোদের নৌকা তুলে নিচ্ছি,

নিমেষে ছারখার করে সাজানো সংসার – চলে যাবচলে যাব।

এক একটা প্রিয়নাম বেছে নিয়ে সাজাবো তোমার কাজলে।

আমি দহন পছন্দ করিঅনুভূতি সাজাই নিরুদ্দেশে।

যদি সাথে নাওকথা দিচ্ছি মাছরাঙাদের উপহার দেব জলছবি,

মহামহোপাধ্যায় উপাধীপ্রাপ্ত বৃক্ষের অন্তরালে লুকিয়ে যে পরী,

ওর হাসিটুকু পবিত্র আধারে সংগ্রহ করে – 

অকাতরে তোমাদের মাঝে বিলিয়ে দেব পরমাত্মীয় যৌবন –

আবার নবজন্মের ফসল হব বলে।

ভেন্টিলেটর চাইবো ঠিক,

শেষের দিন,

বাঁচতে নয়করতে শোধ তাবত ঋণ।

 

মগজ ছাড়া আমার নয়,

এই শরীর,

অংশ সেএই গ্রহের থোড় বড়ির।

 

আস্কারায় এই মাটির

পুষ্টি তার,

বুকের দুধ আজন্মই শুষছি তার।

 

এই শরীর নষ্ট নয়,

তাই চিতায়,

ছাই করে ডোমের দল জল ছিটায়।

 

শেষ দিনে থাকতে চাই,

ভেন্টিতে,

রক্ত যাকশেষ হওয়া ব্রেনটিতে।

 

চোখ তুলুক,

হার্ট লিভার কিডনিও ,

লাগবে যারসেই দেহে ঠিক দিয়ো।

 

অঙ্গ সব পাক তারা,

পাক আয়ু,

সেই সুযোগ ,দিক আমায়  শেষ বায়ু।

 

নলগুলো সব খুলো

তার পরে,

লাশ তবু ফিরবে না আর ঘরে।

 

লাশ তো নয় অন্য নাম

তার আবার,

ছাত্ররা কাটবে সেই.. ক্যাডাভার।

 

এইভাবেই শোধ দেবো ধার আমার।

তুমি আর আমি ভিন্নদেহবাসী

এক মন প্রাণ সত্ত্বা

তুমি ছাড়া আমি অর্থহীন হয়,

নর-নারী সারবত্তা।

 

চোখের গভীরে বসতি গড়েছি

বসেছিও দুইজন

লতায় পাতায় আদর মেখেছি

হয়েছি চিরন্তন।

 

এই আমাদের চির চর্চিত

প্রেম পরশিয়া গান,

আলোকোজ্জ্বল শতাব্দী লেখো

আমাদের সম্মান।

আজকাল আমার ঘরের জিনিস গুলো

 রোদে দিতে বড্ড ভয় হয়,

আমি যাই দিইতুমি অন্যের ভেবে নিলাম করে নিঃস্ব হয়ে যাও।

এইতো সেদিন তোমার যখন ধুম জ্বর,মুখে অরুচিমন খারাপ!

আমি ফল্গুর মত তোমার জন্যেশুধু তোমারই জন্যে  নিঃশব্দে আমার বাঁ দিকের ঈশান কোনে যে আলমারিটা!

তার থেকে আমার তৈরি তোমার জন্য যে রাজবেশসেটার গায়েও রোদ লাগাতে দিলাম-

তুমি বললে এটাও আমার নয়,

আমার তো অসুখ আমি মৃত্যুশয্যায়…

 

আমি যতবার আলোজ্বালাই তুমি দূর থেকে জোনাকির দিকে পিছন ফিরে শিয়ালের চোখে মহেঞ্জোদারো খোঁজো আর স্বরসজ্জায় শুয়ে পোশা তোতার কন্ঠে ভগবত গীতা শোনো।

 

এরপরও নিয়তিকে দেবে দোষ মহারাজ?

 

তোমার কান আর কাকের মাঝখানে পৃষ্ঠ হচ্ছে যে শিশু!

 যে বেড়ে ওঠে রোজ তোমার আস্কারায়!

এবার তার কী হবে?

জীবন যাত্রার পথে

হঠাৎ দেখা দুজনে

কোন এক রেলগাড়ির কামরায়

দেখা পরস্পর স্বজনে,

সে বসে বিপরীত বেঞ্চিটায়

কত না গুণগ্রাহী তাকে ঘিরে;

অনেকদিনের সে অপেক্ষা

আমি বসে দোটানায়

হয়তো মিটবে সে তিতিক্ষা।

 

আগে ও এসেছে কচি সবুজ শাড়িতে

এই অভাগার মানস তটে,

যেন ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত

কচি ঘাসের মাথায় শিশিরবিন্দু

জ্বল জ্বল করেঅপেক্ষারত

বাষ্প হয়ে কখন উড়বে

আকাশে সূর্যের সঙ্গে মিলবে।

 

আজ দেখি ওকে সাদা বুটি তোলা কালো শাড়িতে

ফুটে উঠেছে বয়সের গাম্ভীর্য পাহাড়ের প্রত্যয়

সে প্রত্যয় লেখা থাকে জীবনের শেষ প্রান্তে।

 

আমি মূক হয়ে থাকি  আনমনে,

ভরসা পাই না চিনতে,

ভয়ে থাকিসে যদি না চেনে !

লজ্জা পাই তার দিকে তাকাতে,

ভাবি স্তব্ধতাই সবচেয়ে ভালো;

যে ক্ষত বয়ে চলি চিরন্তন

রক্তক্ষরণ সেখান থেকে

স্তব্ধতাই তার নিরাময়

বন্ধ হবে রক্তক্ষরণ।

 

জাবর কেটে চলে স্মৃতি

বিস্মৃতির সমুদ্র মন্থন

যৌবনের সেই রঙিন সন্ধ্যা

অতীতের কত না সাতকাহন,

পথ ধরে হেঁটে চলা

নির্জন পার্কে মজলিস দুজনে

সময় কাটে একান্ত নিভৃতে

গ্রীষ্মের মধ্য গগণে সূর্যের দহনে,

নেয়ে উঠি দুজনে

ভবিষ্যতের ছবি এঁকে চলি

সমুদ্রের বালু তটে,

বাধি বালির বাঁধ,

তারপর! দুটি পথ দুদিকে।

 

মনে হয় আমাকে দেখেছে

দেখেও না দেখার ভঙ্গিতে,

সে আমাকে আজ থোড়াই পোছে

যদিও বসে বিপরীতে,

নিজেকে রাখতে চায় আলো আঁধারে

এক কুহেলির আড়ালে।

 

তাকে চিনি নি কোন দিন,

জানি না কোথায় তার যাত্রা শেষ

কোন ইস্টিশনে সে নামবে,

তাও আমার কৌতূহল তাকে ঘিরে

সে কৌতূহল ঘিরে থাকে তার পরনের শাড়িতে

শিরিষের মাথায় ভোরের শিশিরের নাচনে

অথবা আকাশের নিলাঞ্জনে

সে আজও আমার কুহেলিবনে।

 

স্টেশনের পর ষ্টেশন চলে যায়

কথা নেই দুজনায়

নিরুদ্বেগ তারউদ্বেগ আমার

আমার নামার সময় হল বলে এবার,

তবে কি নিরর্থক রয়ে গেল এ অভিসার!

পুরোন ব্যথাটা যেন গুমরে মরে

রক্তক্ষরণ সে ক্ষতে আবার।

 

স্টেশন এসেছেআমি উঠি নামব বলে

হঠাৎ ই সে চিনতে পারে সেই পুরোন আদলে,

জ্বলে ওঠে আলো রাতের জ্যোৎস্নায়

আমায় হাত নেড়ে দেয় বিদায়,

আমার মনে হয় এই বিদায় কালে,

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সূর্য আজও হাসে

নিজেকে লুকিয়ে মেঘের আড়ালে

সুখে থাকা খুব ভালো

সুখের ভান করে থাকাও ভালো।

গরীব- গুর্বো হয়ে খুদ কুঁড়ো খেয়েও থাকা ভালো

পয়সার টানাটানিকানা কড়ি হিসেব করে চলাও ভালো

ঋণী হয়ে বেঁচে থাকা মানে

ঋণ শোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেঁচে থাকাতাও ভালো।

কপর্দক শূন্য হয়ে বেঁচে থাকা বড়ো কষ্টের

তবুও একদিন ধনী হবার লোভে বেঁচে থাকা।

অসুস্হ যেসুস্হ হবার প্রভাত  দেখার স্বপ্নে বাঁচে

নিঃসন্তান প্রমীলামা হবার স্বপ্নে বাঁচে।

শরণার্থীর বুকের জ্বালাঅপমানের জ্বালা কে আর বুঝবে?

বুকের মাঝে পোষে স্বপ্ননিজের দেশে ফিরবে।

আকাশ ভরা এত স্বপ্নের মাঝে-

যাদের স্বপ্নগুলো শুধুই ধূসর রঙের হলো-

স্বপ্ন ও নেই তাই মূল্য ও নেই

সুখেরদুঃখেরতাপেরশোকেরহারিয়ে গেছে সব-

শুধুই ভাবিকি করবে সে নিয়ে আগামী কাল?

শুধু চোখের দেখা নয়

        মনেরও দেখা থাকে

আমার এই দ্বিতীয় দেখার একটা চশমা চাই।

 

তোমাকেও দেব।

দু’তরফে মনের দেখা না হলে ভাষা ভিন্নমুখী হয়।

আমার একটা ঘর থাকবে।

ঘরের মধ্যে স্বপ্ন বোনার এক চিলতে আকাশ থাকবে।

সেই আকাশে ভেসে চলা মেঘ থাকEবে।

আমার একঅটা ঘর থাকবে।

ঘরের ভিতোর এক টুকরো বারান্দা

সেখানে ইচ্ছা গুলো  ঝরের সাথে লুটপুটি করবে।

হঠাৎ  কারো পায়ের শব্দ চমকে উঠে ঠোঁটের কোনে লজ্জা রাঙা হাসি

 

আমার একটা ঘর থাকবে।

ঘরের কোনে মোড়া,

আলনা থাকবে,

পরিপাটি ভাঁজে শাড়ি থাকবে।

তোর বুকের মাঝে ওম খোঁজার তাড়া থাকবে।

দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাগুলো 

ছাদ ছুঁয়ে মনের মাঝে ছড়িয়ে যাবে

তোর চওড়া বুকে মাথা রাখার মুহূর্ত থাকবে।

হাসি থাকবেগান থাকবে।

ঝগড়া গুলো  চার দেওয়ালে মাথা কুটবে

আমার একটা ঘর থাকবে

সেদিন অলক্ষ্যে তোমার পিছু নিয়েছিলাম…

 

বিমূঢ় চোখদুটো দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলাম বারেবার।

মনে হলো এই বুঝি অন্ধকার

ছায়া ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলো,

অথবাহয়তো গোপনে আলিঙ্গন করছো বিশ্বসংসার।

 

মাথার কাছে খোলা জানলা,

বাতাসের কার্পণ্য ছিল না।

তোমার ঠোঁটের ফাঁকে হাসি,

মনে হলো-

এলোমেলো হাওয়ায় এলোচুলের খুনসুটির খবর এলো বুঝি!

 

আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা গাছের সব শিকড়যেন

কোনো সাহসিনীর দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরেছিল তোমাকে

হয়তো বা…

 

মাঝেমধ্যে বেঁকেচুরে যাচ্ছিল তোমার শরীরের আনাচকানাচ,

পাখির ঝাঁকের সাথে তুমিও কি  এঁকেবেঁকে যাচ্ছিলে ডাইনে-কিম্বা বাঁয়ে ?

 

তোমাকে প্রদক্ষিণ করছিল বর্ণচক্র। একের পর এক পাপড়ি মেলে

জেগে উঠছিল তোমার রচনা।

সে দৃশ্য আজও অন্তঃস্থল খুঁড়ে চলেছে।

 

তোমার ভিতর দেখেছিতাঁর আকার। বলেছিঈশ্বরতুমি ঈশ্বর…

ভ্রূকুটি আর সহ্য করবো না৷

এলোমেলো বিষাদগুলোকে সমস্ত পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিয়ে বলেছি –

এবার অন্য কোনো চৌকাঠে গিয়ে রাত পোহাও৷

আমি খোলা প্রান্তরে অসীমের নেশায় রূপকথার জাল বুনবো আজ থেকে৷

একলা নির্জনতাকে প্রত্নলিপির গাদায় শুইয়ে রেখে –

মায়াপিঙ্গলের নেশায় ঋতু বদলাবো অচেনা নক্ষত্রে৷

দেখি কতকত রাক্ষুসে যন্ত্রণা আমার পথ আটকাতে পারে ?

উল্টোপাতার যে ভুলগুলো পিছনের নূড়িপথে বিছিয়ে আছে —

তাদেরকে সোনালী অক্ষরে মুড়িয়ে যাবজ্জীবনের মতো ছড়িয়ে দেবো প্রকাশ্য রাজপথে ৷

একটা গোটা রাতের অন্ধকারকে শ্মশানের নাভিমূলে বসিয়ে রেখে –

ব্রহ্মকল্প আলোয় স্নান সারবো সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ডিঙিয়ে

এই জলমাটিআকাশ

তেমনই আছে

ঠিক তোমার মতই উদাসীন ৷

 

অন্ধকার আছেদহন জ্বালা ;

স্নিগ্ধ উষা,  উল্লসিত ঊর্মিমালা ;

অনু-পরমানুতে তরঙ্গায়িত আনন্দ

প্রবহমান প্রাণের উৎসব 

তবু চলে যেতে হয়…

 

সমস্ত শরীরী অবয়ব

মাধুকরী শেষে

সব ধার শোধ করে একদিন ৷

তারপর ঐ শীতল-দৃষ্টি-গভীর

সীমাহীন বৈরাগ্যে লীণ হতে হয়…

 

আমিও মিলিয়ে যাচ্ছি

বুদ্বুদের মত ৷

যৌবনের জুঁই

ফ্যাকাসে ক্রমশ:

ভেসে যাচ্ছে সুবাস

আমার নিশ্বাস

মেঠো পথে

পাতার শিরশিরানিতে

পাহাড়ের কোল বেয়ে

দিগন্ত রেখায়

কোন এক প্রাচীন সুরের মুর্ছনায়

ব্যপ্ত হয়ে আছে দশ দিক ৷

 

তবুও নিজেকে

অনুভবে পাবো বলে

শিশির ভেজা পায়ে হাঁটছি…

চারদিকে কুন্ঠাহীন জীবনের কোলাহল

তাই নতুন সূর্য দেখবো বলে

তোমার চোখে চোখ রেখেছি…

 

বীক্ষিত প্রতিবিম্বটুকু

মুছে যাওয়ার আগে

আবাহন থেকে বিসর্জন

অপ্রদীপ

তোমার ত্রিনয়ন আহুতি দিক

আমার অস্তিত্ব হোমকুণ্ডে৷

যজ্ঞের ছাই

কাজল হয়ে থাক

বিস্মৃত ঐ চোখে

কপালে তিলক রেখা

হে প্রিয় মুখ আমার…

এমন করে আগুন জ্বালিয়ে যাও আকাশ থেকে জলে,

কই পুড়ছে না তো কিছুই দাউ করে আগুনের গ্রাসে !

ওই আগুনের সোনা রঙে প্রকৃতি লাজে মুখ ঢাকে,

আমার দুচোখে ওই লেলিহান শিখা যে শুধুই ভাসে !

আঁধার পিছে অপেক্ষায়বিছিয়ে দেবে সে আলকাতরা

মাঝে মাঝে তাতে সোনার ফুল ঝিকমিকিয়ে ওঠে !

আঁধারেতে মাণিক বুঝি ছড়ায় মুঠো মুঠো হাসির রাশি,

অভিমানী চাঁদ বুঝি তাই যায় হারিয়ে নিরুদ্দেশের পথে !

বিস্ময়ে ভরা দুচোখ মেলে দেখিকখন যেন আকাশের —

ওই মাণিক গুলো জ্বলছে আমার চারিপাশে !

জলরাশি সেজেছে আজ কৃষ্ণ কালো বেনারসি শাড়িতে

অজস্র সোনার ফুল শাড়ির সারা অঙ্গে ভাসে !

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝিঁ ঝিঁ রবে সানাইয়ের সুরে

বুঝি ঘুমপাড়ানি গানের তান অবিরাম বাজে !

আকাশ জলের ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুগ্ধতার রেশ

ছড়িয়ে পরেমন্ত্রমুগ্ধ আমি থাকি স্ট্যাচু-সাজে !

হায় সর্বংসহাবসুন্ধরা হারিয়ে ফেলেছো সব,

কোথায় তোমার স্নিগ্ধশান্তআনন্দ কলরব ?

অসহায় এক ধূসর বর্ণে সজ্জিত হয়ে আছো,

প্রাণ জুড়ানো যে রূপ ছিল সবই তো ভুলে গেছো।

 

নবজাতকের কাছে তোমার নেই কি অঙ্গীকার ?

কি নিয়ে বাঁচবে জন্মালো আজ জিজ্ঞাসে বারবার।

রোগ-শোক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো বিষাদ হাহাকারে,

এই পৃথিবীর আলোমাটিজল হারায় অন্ধকারে,

 

বাঁচার আশাই নেই যেখানে স্বপ্ন ভবিষ্যতের,

হাঁটতে শিখবে কোথায় শিশু টলোমলো পায়ের ?

যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি মৃত্যু-মিছিল বাড়ে,

জন্ম নিয়েছে আজকে শিশুনিজের কাছেই হারে।

 

দিকে দিকে আজ বিষের ছোঁওয়ায় নিষ্ঠুর মানবতা,

নিদারুণ রোগের  বিষের বাতাসে হারায় যে সভ্যতা।

সেরে ওঠো তুমি অতি তাড়াতাড়ি পুণ্য মাতৃভূমি,

তোমার বুকে জন্ম নিয়ে তোমারি পায় চুমি।

 

স্থান দাও কোলে নবজাতকেরে মুছে দাও যত গ্লানি,

আবার পৃথিবী নতুন করে শোনাও নতুন বাণী।

দেখোনি কি তুমি সন্তান সব রয়েছে মলিন মুখে,

তুমিই তো পারো ঘোচাতে দুঃখ নব প্রভাতের সুখে।

মনের ভেতর সাজানো আছে যে ঘর,

সেই ঘরের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি,

তোমার নাম ছাড়া কারো নাম তো মনে আসে না।

পথে যেতে যেতে কতো মুখ,মনের জানায় উঁকি দিয়ে যায়-

তোমার মুখ ছাড়া কারো মুখ আঁখি পটে ভাসে না।

জানালার বাহিরে যতো দূর চোখ যায়

ভাটিয়ালি সুরে উদাসী মন আমার —

লাল মখমলে কাগজে লিখে যায় যতো কবিতা

তোমার নামে,

তুমি ছাড়া মনের জানলায় কাওকে তো খোঁজা

হয় না।

কোনো দিন কোনো শ্রাবণ সন্ধ্যায়,

মন আমার কেঁদে ওঠে কোনো অজানা ব্যথায়—

উদাসীন মন আমার খোঁজে তোমাকে,

মনের জানলায় রাখি চোখ,

তুমি ছাড়া কাওকে মনে আসে না।

শ্যাওলায় ভেসে যাওয়া স্রোত —

নির্জনে রূপকথার রূপসাগরে

ডুবেছে এই মন।

বুকের উত্তাপে ঘন নিশ্বাসে —

নিভিরতায় খুঁজে পাওয়া তোমার ছোঁয়া,

মনের জানলায় উঁকি দিয়ে দেখি

তোমাকে শুধু তোমাকে ভালোবেসে

কারো মুখ তে মনে আসে না।

এই শহর জানেএই ব্যপ্তির মাঝে

 লুকিয়ে আছে এক গভীর সুরঙ্গ।

আকাশে একটা ঢিল ছুঁড়ে দেখো,

তারা রাও বিদ্রোহ ঘোষণা করবে 

চোখের নিচে যা জ্বলজ্বল করে তা সবসময় জল নয়,

আগত অনুভূতিকে আর প্রশ্রয় না দেওয়া এক অলিখিত সংবিধান।

 

বালিশ ভিজিয়ে রাত জেগে অনুভব করেছি,

যে তারা খসা গুলো আমার দিকে ছুটে আসেআসলে ভালোবেসে কাছে আসে।

 আরওই যেসুরঙ্গও আমার স্বপ্ন সুখ।

 

বসন্তবৌরী বীণা বিনিদ্র বাজে

অসীম দাস

 

মনের শরীর ছুঁয়ে এখনও তো

টুপটাপ চুঁয়ে পড়ে খেজুরের রস !

এখনও ব্যাধির কানে

বসন্তবৌরী বীণা বিনিদ্র বাজে 

 

জীবনের মাঝপথে থেমে আছে উৎস সময়

কিভাবে নিঃস্ব হবো স্মৃতি না ফুরালে !

সপ্তসাগরে শেষ রোদ ডুবে গেলে

প্রতিপদ আয়ু জ্বেলে জ্বেলে

চোখের ছানিতে ফোটে কোজাগরী ফুল

 

বেপরোয়া সব ব্যথা

শুধু আগামী শ্বাসের লোভে

একান্নবর্তী হিমে

শীতঘুমে ঠিক যেন সুবোধ বালক

কিভাবে দুঃস্থ হবো ব্যথা না পোড়ালে !

কালকে বেলাকাজের ঠেলা

যখন ছিল একটু কম

বাড়ির পিছেসিঁড়ির নীচে

সিগারেটে আয়েশ দম

পকেট কোণেহঠাৎ ফোনে

উঠল বেজে গানের কলি

ধরে ফোনমিষ্টি বোল

অনুরোধের দু-চার বুলি

জেনে নিনদুই তিন দিন

কেবল সময় আছে হাতে

লিখতে হবেকবিতা তবে

দেওয়ার মতন হবে পাতে

ম্যাগাজিনেসঠিক দিনে

ছাপা হবে সেই লেখাই

পড়বে যখনসবাই তখন

বলবে- কি লিখেছো ভাই

 

ফোনটা এসেমনটা আমার

করে দিল ভীষণ ভারী

শব্দ গুলোজব্দ করে

আমায় গেছে কখন ছাড়ি

সঠিক ভাষাপাবার আশা

আর করি না এখন আমি

কোথায় শুরুওহে গুরু

কোথায় যে এখন থামি

তাই তো আমিএক অনামী

লিখলাম নাআর কিছুই

অক্ষমতায়, ছাপার পাতায়

লেখার জন্য এটাই দিই 

♦ সম্পাদকের কথা ♦

সাহিত্য সংস্কৃতি প্রতিটি বাঙালীর মজ্জাগত। বেশীর ভাগ বাঙালীই মনের তাগিদ থেকে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা করেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রিয় এই বাঙালীদের মধ্যেকার সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্হাপন করে চলেছে অঙ্কুরোদ্গম। সময়ের দাবী মেনে আমরাও পাল্টে নিয়েছি মাধ্যম। অনলাইনের এই ওয়েব – ম্যাগ ভিস্যুয়াল পৌঁছে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। অঙ্কুরোদ্গমের পেজে সমস্ত জেলার অনুষ্ঠান হচ্ছে নিয়মিত। তবে পরিস্হিতি স্বাভাবিক হলে আবার আমাদের প্রিন্টেড পত্রিকা প্রকাশিত হবে।

পৃথিবী সুস্হ হোকআমরাও দ্রুত পুরানো ছন্দে ফিরি এই কামনা আমাদের সবার। সবাই ভালো থাকবেনসুস্হ থাকবেনসৃজনে থাকবেন।

নমিতা দাশসাধারণ সম্পাদক )

কবিতা

 

১) আর্যতীর্থ

২) লিপিকা চট্টোপাধ্যায়

৩) প্রবীর কুমার দত্ত

৪) অমিত

৫) সুদীন বন্দ্যোপাধ্যায়

৬) বিদূষক অরিন কবি

৭) দীপান্বিতা হক

৮) দীপশিখা চক্রবর্তী

৯) দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়

১০) আলো চৌধুরী

১১) অমিত চৌধুরী

১২) অজয় চক্রবর্তী

১৩) উদয় শঙ্কর বাগ

১৪) মধুমিতা ঘোষ

১৫) সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য

১৬) চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়

১৭) তনুশ্রী দেবনাথ

১৮) মৌসুমী লাহিড়ি

১৯) আইভি দত্ত

২০) মোহনা মজুমদার

২১) নদী রায়

২২) তরুণ কুমার ইন্দু

২৩) মৈত্রী

২৪) পাঁপড়ি দাস সরকার

২৫) প্রদ্যুত রায়

২৬) রণেশ কুমার রায়

 

ভ্রমণ

 

পিনাকী কাঁড়ার

 

গল্প

১) বর্ণালী মুখার্জী

২) সিক্তা পাল

৩) অলোক কুমার মাজী

 

ধারাবাহিক গল্প

১) নমিতা দাশ       সান্দাকফুতে ওরা ছয় (তৃতীয় পর্ব)

২) গোপা দাস        বন্ধুত্ব (প্রথম পর্ব)

 

 

 

ভিডিও

১) অতসী চক্রবর্তী ঠাকুর

২) অজিতেশ নাগ

৩) কাকলি দাস

৪) অলকা মুখোপাধ্যায়

৫) তাপসী ব্যানার্জী

৬) ডা. সংঘমিত্রা সাহা

তুমি মহাকাশ ঘুরে এলে বুঝিতা বেশ ,তা বেশ

আমিও ঘুরছি মাটিতে জানো তো! ইচ্ছে যদিও নয় তা বিশেষ,

থিতু হতে চাইভিতু পায়ে ঠাঁই খুঁজছি এখনো এদিকে সেদিকে।

খোঁচা ও ধমকে এটুকু ফেলেছি এতদিনে  শিখে,  আমাকে চায় না আজও কোনো দেশ।

 

কোন দেশ সেটাসে  প্রশ্ন করা ঠিক নয় মোটে,

মহাকাশে গেছো মানুষ হিসেবে । কোথাও কখনো প্রশ্ন কি ওঠে,

কার নাম লেখা পাসপোর্ট জুড়ে ভাড়া দিয়ে যেই ব্যোমে গেলে উড়ে,

নিচে উল্লাসযেন চাঁদ থেকে আসা যাবে ঘুরেআমরা যেমন তাড়নায় ছুটি বাসে ট্রেনে প্লেনে যখন যা জোটে।

 

তাড়না কিসের সেটা মোটামুটি আজীবন সাথী,

খিদে মারে লাথিমেধা দেয় জ্বালাভালো হতো যদি ওখানে পালাতি,

জাগরুক চোখে স্বপ্নের দাবী,সুখের চাবিটা ওইখানে পাবি ভাগ শিগগিরই।

আমিও তেমন সুযোগের খোঁজে দ্বারে দ্বারে ফিরিযদি আশা হয় কালকে পোয়াতি।

 

যদিও ঘুরছি মূলহীন হয়েমজাটা কী জানো…

তোমাকে ডেকেছি অতলান্তিক নামে

মেধায় মননে রক্তের অনুভবে

যেখানে গোপন নিজস্ব ইতিহাস ,

হৃদয় সেখানে নতুন জন্ম পাবে ৷

 

তোমাকে ছুঁয়েছি বেহিসেবী দুই হাতে

ঢেউ ভেসে গেছে নিকষ শূন্যতায়

যে ভাষা অথৈ চোখের গভীরে আছে

সুখ লিখে যাবে মগজের বাসনায় ৷

 

তুমি আলো দিলে গোধূলির অভিমুখে

সান্ধ্য আকাশ মায়াটুকু নিয়ে সাজে ,

অনুচ্চারিত প্রতীক্ষা নিয়ে থাকে

মুহূর্ত গুলো আতসকাঁচের মাঝে ৷

চিরটা কাল হেঁটেছি পথ

জলজঙ্গলজমির আল ধরে,

মিটে নাই ক্ষুধা না পেয়েছি সুধা,

বারবার দিয়েছি ডুবঘামের সরোবরে।

ঘর্মাক্ত দেহে ছাড়িনি হাল ;

বেয়ে চলেছি দাঁড় সুখের অন্বেষণে।

অতৃপ্তি আর অসুখের ভারে ন্যুব্জ দেহ নতজানু শির,

জরাজীর্ণ মন জ্বলে ওঠে

মাঝে মাঝে ;

জেগে ওঠে ভিসুভিয়াসের লেলিহান শিখায় !

জেনে নিতে চায় ;

বুঝে নিতে চায় বিধাতার কাছে,

কোন উদ্দেশ্য সাধনে হে নাথ

এনেছো এ কুটিল সংসারে,

যেখানে আমারই কোন এক

লোভী প্রজাতির শাসনে,

নিষ্পেষিত হতে হবে সারাটি জীবন  মরুর পথ ধরে?

“শ্মশান” নামক এক শেষ আশ্রয়ে মিশে যেতে হবে,

বেলা অবেলায় সাম্যবাদী অভিধায় !

এ জীবনের মতো যাবতীয় ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে ?

হয়ত আর কোন দিন ফেরা হবে না এ পৃথিবীর বুকে!

শাসন আর শোষনই রয়ে যাবে যুগে যুগে মাথা উঁচু করে!

আর আমরা মানুষ নামক অপার্থিব জীব;

অপরাধী সেজে ঠাঁই খুঁজে যাবো সাধের গঙ্গাবক্ষে,

কিংবা হয়ত বারানসীর কোন এক বারান্দায়!

উত্তর নেই জেনেও কলম হাতে আজও বসে,

জগতের কবি রামধনুর অপেক্ষায়।

উচ্ছল চরাচরে উত্তাল ছন্দ

শীতকাল মাঠঘাট ধোঁয়াশায় স্তব্ধ,

রাতভোর চারদিক মায়াবী নৈঃশব্দ

শুঁকে দেখোপাচ্ছো কি বারুদের গন্ধ?

 

চুপিচুপি কানে ঢোকে ফিসফিস শব্দ

ধুপধুপ বুট ছোটে খোঁজখোঁজ জব্দ,

ঘুমচোখে লোকজন ভয়ার্ত ধন্দে

চিকচিক টর্চ ঘোরে ফুঁড়ে খানাখন্দে

 

সেই যারা ধুয়েছিল নামহীন রক্ত

মুছেছিল রুমালেতে সাবলীল ছন্দে,

ক্ষুরধার ছুরি হাতে ভয়ানক ধন্দ

বাতাসেতে শুঁকেছো কি বারুদের গন্ধ?

 

সন্ধ্যার নির্জনে পাহাড়ী উপান্তে

বাঁশিহাতে ঝুঁকিহীন কান্নার প্রান্তে,

কবিদের চোখ ছিল কুঁয়াশায় বন্ধ

বাতাসেতে মিশে ছিল বারুদের গন্ধ

 

জোৎস্নাতে শিশুগণ কলরবে মত্ত

ঘুম নেইভাত চাইঅতীব ক্ষুধার্ত,

ঝুঁকি আছে যদি নাও শপথ উদাত্ত,

রক্তের বিনিময়ে নেওয়া চাই রক্ত।

 

ভাত ছিলসেই ভাতে মিশেছিল রক্ত

বুঝে নেবো কেন ভাতে হাড়মাস রক্ত,

ঝুঁকি থাক তবু নেবো শপথ উদাত্ত

শোষকের প্রতিবাদী হাত করো শক্ত।

এমন বন্দি করেছে শরীর পরিবেশ;

যেতে চায় মন বাঁধা দেয় বুকের ভাঙা–

হৃৎপিণ্ডের ছোবল।

এক রক্ত ধমনীতে বয়অগ্রজের চোখের জলে —

ভেসে যায় অনুজের নিথর দেহ।

কালকেও কতো কথামায়ের ভিটায় চলছে সংস্কার।

সে তো মায়ের ইচ্ছায়মায়েরই দান।

কিছু দূরে ছিলো ওরা ভালোই ছিলোকোন্ যমদূত —

ওৎ  পেতেছিলোচিরতরে আকাশের তারা হয়ে গেলো।

ডাক্তার  বদ্যির চেষ্টা বিফলে গেলো সব।

বাঙালি বলে গর্ব আমার

বাংলা জানি ভালো –

তাই শিখিয়ে কাব্য লিখে

মনে জাগাই আলো!

কিন্তু কিছু বাংরেজ সে

দো আঁশলা হয়ে

বাঙালির মান ম্লানই করে

বিকট ভাষা কয়ে!

না ইংরেজি না বাংলা

কোনটাই না জেনে 

বাংলা শেখানোটাই  বৃথা

নিলাম কেন মেনে?

এমনই এক ছাত্র তারে

শিক্ষা দিয়েও শেষে

“বাংলাতে যে শূন্য পেলাম “

গর্বেতে কয় হেসে!

 

সেই বাঙালি ইং – পুঙ্গব

তার সাথে যে দেখা

গাড়িতে তার লিফ্ট দিলো

চলছিল সে একা!

হঠাৎ লার পথে আমায়

প্রশ্ন বটে করে –

” বলুন তো এক কথায় প্রকাশ

-শুয়োর দাঁড়া সরে!

কী হবে এই বাক্য বটে

একটি শব্দতেই?”

হাসিতে তার দুষ্টুমিটা

ছেলেবেলার সেই!

 

আমি তখন আকাশ পাতাল

ভাবছি অভিধান –

এই ডেঁপোটার কাছেই হরি

গেলোই বটে মান!

 

তবুও তো শিক্ষক আমি

শেখার শেষ কই?

বললাম যে “এ শব্দ তো

আমার জানা নেই?!”

 

মুচকি হেসে সেই বান্দা

তখন আমায় কয় –

” সহজ সেটাজানেন না কি?

– সরবরাহ হয় “!

জীবন যন্ত্রণা তুলি বোলায় সরীসৃপের পদছাপ

আঁকা বাঁকা কুৎসিত রেখাগুলো ঘৃণ্য যেন শাপ।

 

দীর্ঘায়িত হয় কালো রেখাগুলো অভিজ্ঞতার সাথে

রূপোর চাঁদ ও মলিন হয় কালো মেঘের হাতে।

 

লুকানো ব্যথাগভীর বেদনাঅপমান আর বঞ্চনা

প্রিয়জন ও বুঝতে পারে নাঢেকে রাখা ওই লাঞ্ছনা।

 

এমনি করেই দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে নামেরাত্রি শেষে

ডাহুক ডাকে একটানা স্বরেহৃদয় আসে মলিন বেশে।

 

চোখের জলে ধুইয়ে দিলামনব জন্মের দায়

জয় করে নাওপুড়িয়ে দাও জঞ্জাল সম কায়।।

মনে হয় চুপচাপ হারিয়ে যাবো কোথাও,

বাতাসহীন চমকে ওঠা ভুলে;

দগ্ধ স্তবকমিথ্যে আমন্ত্রণ,

আলপিন-গাঁথা পোশাক যাচ্ছে খুলে।

 

নির্জনতম ঘর খুঁজেছে পথ,

সন্ধে হলেই নিভছে আলোর খেলা;

আয়না কেমন গভীরে মাপে জীবন,

যাচ্ছে ছুঁয়ে ক্লান্ত ভাঙা-বেলা।

 

জানালা-পাশে আকাশ জাগে এখন,

চোখ বুজলেই যাচ্ছি হেঁটে দূরে;

যদিও ছবি স্পষ্ট হতে নারাজ,

ঠিকানাবিহীন ঢাকছে শূন্য জুড়ে।

 

ক্ষত আঁকা ডানাহীন এই শরীর,

কুয়াশা সরে চুপ আছি তো বেশ;

সাজিয়ে রাখার নীরব বৃষ্টি-ভীড়ে,

আসছে সময়শান্ত নিরুদ্দেশ।

মেঘেরাও পুড়ে যায়

ঝরে যায় অকাল বর্ষায়

এক একটা সকালের ভিতর লুকিয়ে থাকে

অসংখ্য সকালের জন্মবীজ।

সমুদ্র ঢেউয়ের আগে ও পরে শুধুই নিরুদ্দেশের গল্প!

কোমল বুকের খাঁচায় কংক্রিটের চাবুক!

প্রতিটি উড়ানের আগে কোমরে লোহার সিট বেল্ট!

মানুষের দুচোখের পাতায় বেদনার  দীর্ঘশ্বাস!

মেঘ পোড়া দুপুর হারিয়ে যাচ্ছে গভীর শূন্যতায়!

বৃষ্টির খবর আবহাওয়াবিদদের কাছে নেই

পুরানো হিসেব হাতে সময় বসে আছে ঘাপটি মেরে

মেঘেদের সাথে এবার পুড়বে যেখানে যত আছে হাহাকার!

জন্মবীজ ফুটে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়বে

সোঁদা মাটির সুঘ্রাণ।

মৃত্যুর অনুবাদ শিখেছি

নিভৃতের অর্থও বদলে গেছে

মহামারীর এই বিশ্বে সংজ্ঞা বদলেছে একাকীত্ব—

এভাবেই কেটে যায় একুশ শতকের অভিশাপ।

 

মনের ভিতর এক কঠিন সমুদ্র ধাক্কা দেয়,

আহ্নিক গতি মেনে বদলেছে তরঙ্গের রঙ।

আগামীদিনের জন্য নিরাপদ জন্ম রেখে-

          বিপদের মরসুমে নতুন জন্ম নিয়েছিলাম।

 

ভালো থাকবো এই ভেবে ভালো আছি নকল জন্মে।

ভেসে আসে ভাঙনের গান

বাতাসে বাতাস কণা মেশে

চিতাকাঠ নদী পাড়ে অঙ্গরাগ করে

মণিকর্ণিকায় জ্বলে ওঠে মশাল

হরিশচন্দ্র ঘাটে তখন

মদিরা নেশায় মত্ত মাল্লার

লাল চেলি পড়ে শবাসনা ভৈরবী।

 

এমন সময় দূরে কে বাজায়

ভাটিয়ালি সুর

সুরের লহরি ছোটে

মন্দিরে মন্দিরে বাজে পূজার ঘণ্টা

ঢংঢংঢং

জেগে ওঠে ভৈরব

উত্তরবাহিনীর জল তিরতির কাঁপে

ভোরের ক্ষ্যাপা সানাই আর আজানের ধ্বনিতে

শঙ্খনাদ হয়

অণু থেকে খসে পড়ে পররেণু

জেগে ওঠে মহাপ্রাণ

উত্তরবাহিনীর কাঁপন আগের মতোই স্থির

ভাঙনের গান তলিয়ে যায়

আজান আর শঙ্খনিনাদে।

কেন আমি আজও লিখতে পারিনা বহু সমাজের কথা,

আমি তো লিখতে পারি না কখনো হারানো মানবিকতা।

আমি কি শুধুই লিখে যাবো সেই প্রেমের কবিতা খানি,

ফুল ,নদী ,আর সাগর ,পাহাড় আকাশকে টেনে আনি।

 

সমাজটা তো নেই সমাজ আর আমার লেখনি কই,

মানুষের কত হাহাকার দেখে স্তম্ভিত আমি হই।

বুকের মধ্যে চাপা কান্নায় জলভরা টলোমলো,

দীর্ঘশ্বাসে ছড়ায় আগুন আমি কি করবো বলো?

 

আমি তো দেখেছি মায়ের কোলেতে মৃত শিশু আছে শুয়ে,

পথের পাশে অভুক্ত মার কোমরটা গেছে নুয়ে।

সমাজ দেখেনি এই অজুহাতে আমি নিশ্চুপ থাকি,

একা একা আমি মন ক্যানভাসে সেই ছবিটাই আঁকি।

 

আমার যায়নি অন্যায় দেখে প্রতিবাদে গলা চিরে,

প্রতিবাদ যারা করেছেগিয়েছি সেদিকে পিছন ফিরে।

আমি তো লিখিনি সন্তানহারা পিতার আর্তনাদ,

আমি তো লিখিনি তাদের কথা ,করে যারা প্রতিবাদ।

 

চারিদিকে দেখে শোষণ পীড়ণ আমি আজও বেঁচে আছি,

বাঁচব বলেই সব মেনে নিয়ে থাকি তার কাছাকাছি।

স্বার্থপর এর সংজ্ঞা জানিনা ভাবি আমি তবে কি!

আপস করেই শুধু বেঁচে থাকা এই জীবন নাকি?

আকাশজুড়ে মেঘ জমেছে

বৃষ্টি ভীষণ ঝরে !

বাইরে এখন পা রাখা দায়

বন্দি আমি ঘরে !

চতুর্দিকে জল থই থই

শহর ভাসছে শুধু !

ব্যস্ততা আজ ডুব দিয়েছে

চারদিকে সব ধূ ধূ !

আকাশভাঙা বৃষ্টি এসে

দিচ্ছে ছুটির ঘন্টা,

খিচুড়ি আর ডিম ভাজাতে

মজল এবার মনটা।

ভুবনডাঙার চেনা আকাশটা ছিটকে গেছে –

অনুভূতিগুলো অন্ধকার পেরিয়ে ,খাঁড়িপথে পাড়ি দিয়েছে পূর্বপুরুষের চৌকাঠে৷

পা টিপে টিপে পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করে সেই পুরোনো পাড়াটায়৷

যেখানে গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতাম মনের পান্ডুলিপিটা৷

 

এখনতো রোদ পড়ে আসছে বসন্তের পৃষ্ঠায়৷

একমুঠো পলাশ পেলে কিম্বা নিদেনপক্ষে একটা ছোট্ট কাগজের নৌকা পেলে –

আবার করে নদী আঁকতে পারতাম শরীর জুড়ে৷৷

তারপর,একটা একটা করে দেহজ খোলস সরিয়ে

আতরগন্ধী রাতের দরজায় এসে থেমেছি।

সমস্ত অযাচিত সংস্কার কাটিয়ে শরীরের আদর

       ঢেলেছি সুগন্ধির মতো।

যে শোক আমার ছিল নাতারজন্য বিন্দু মাত্র

        অনুতাপ করি না।

বিকেল শেষে যে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ শরীরে মেখে নিই,

তার প্রতিটি রন্ধ্রে তোমার পুরুষালী

আঙুলের খরস্পর্শ তো মিথ্যে নয় আজও।

মোক্ষ লাভের মতো কুড়িয়ে নিই সেই সব উচ্ছিষ্ট সুখ

যা কখনও তুমি দিয়েছিলে দৈন্যের আড় ভেঙে।

আমার আজন্ম লালিত নারী সুখে গলন্ত

মোম ছড়িয়ে একটা মিথ-এর গল্প সাজিয়েছ

        নির্বিকল্পে—

অথচ এভাবেও প্রেম আসে,শরীরে ও মনে।

মৃত্যুর ঠোঁটে চুমুক দিয়ে বিষ পান করার আগেও

       সঙ্গম করি স্বেচ্ছাচারীর মতো।

যে সম্ভোগে শরীরের ইচ্ছামৃত্যু হয় সেখানে ডেকো

         না আমায়—আমি অস্পৃশ্য নই।

যৌনতা আমি রোজ মাখি,আমারই ছায়ায়—

টিমটিমে আলো…

দুটো জীবিত ইচ্ছে

তখন-ও হাত বাড়িয়ে একে অপরের দিকে।

এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলো শেষ রাত্তিরের ঘুম।

 

কিন্তু ফিরতে যে হবেই,

আলিঙ্গনে বিদায় দিতে নেই।

তাই দুচোখ বন্ধ করে,

দাঁতে দাঁত চেপে শুধু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা…

 

আর কিছু নেইসামনে শুধু ব্যথার রাস্তা,

নিয়ন্ত্রনহীন হাঁটার শুরুতেই ভালোবাসার শুদ্ধতা গলে গেলো।

তখন-ও বুঝিনিনিজের মনে ঘূণ-পোকা বাসা বেঁধেছে।

বাঁকা ঠোঁটের কোণে আঁকা ছিলো সাদাকালো কৃপণতা।

 

হয়তো বুঝেও

সে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল,

চোখের কোলে স্বপ্ন-ভাঙ্গা শোক।

পিছু ডেকে ছিল কী শোনা হয় নি।

যা আমার হবে না তাকে নিয়ে আসর জমিয়ে লাভ কি!

 

বিষন্নতা আড়াল জানে না।

স্মৃতির অববাহিকায় ফলন্ত লেবু গাছটা

এখনও আমায় চাবুক মারে।

একটা রাত্রি জুড়ে প্রেম নামতে পারতো….

নামে নি,

ফিরতি গাড়িতে ওর ঠাঁই জোটে নি বলে।

……………………।।

যে শহর এক সময়ে উষ্ণতা খুঁজে ফিরতো

আজ তার গায়ে প্রবল জ্বর!

বিস্বাদ বিবর্ণ জীবনে কবিতা আসে না

পাড়ি দিয়েছে সে অনেক দূরের মেঘের রাজ্যে!

পৃথিবীর দিকে তাকালে চোখে পড়ে সার সার চিতার আগুন,

কেউ জানে না এর শেষ কোথায়।

দামাল শৈশব মুখ ঢেকেছে কালো ধোঁয়ায়

বাতাসে মিশেছে বিষমুখ আর মুখোশ একাকার!

চেনা মুখ অচেনা হয়েছে মুখোশের আড়ালে,

একান্ত প্রিয় জন ও আজ দূরের মানুষ

দূরত্ব বিধি মানতে শিখিয়েছে জীবাণু !

ভালবাসা বেঁচে থাকে শুধু মাত্র সেলফোনের সবুজ আলোয়,

তবু ও থাকে মৃত সঞ্জীবনী হয়ে।

মেঘভাঙা একটা বৃষ্টি নামুকধুয়ে যাক যত ক্লেদ রোগ শোক জ্বরা ব্যাধি ।।

আমি বর্ষার আকাশ থেকে

এক টুকরো মেঘ পাঠাবো

তুমি এক পশলা বৃষ্টি দিও।

 

আমি মেঘমল্লার রাগের

স্থায়ী ও অন্তরা পাঠাবো

তুমি সঞ্চারী শুনিয়ে দিও।

 

আমি বর্ষায় বাগান থেকে

দোপাটির কুঁড়ি পাঠাবো

তুমি রঙবেরঙের ফুল দিও।

 

আমি ঘন বাদল দিনে

রবি ঠাকুরের কবিতা পাঠাবো

তুমি আবৃত্তি করে শুনিও।

 

আমি বর্ষার জলস্রোতে

কাগজের নৌকা পাঠাবো

তুমি বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে দিও।

 

আমি মুষলধারে বৃষ্টিতে

গোলাম আলীর গজল পাঠাবো

তুমি কণ্ঠে তুলে নিও।

 

আমি রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে

তোমাকে উড়ন্ত চুম্বন পাঠাবো

তুমি একটু ভালোবাসা দিও।

আমার আর তার মাঝে

একটা স্বচ্ছ কাঁচের জানালা।

কে যে ভিতরে কিংবা বাইরে?

দুজনের কাছেই ধাঁধার মতো।

 

আমার সুখ দুঃখের সাথে

সেও সুখী দুখীর সমান ভাগিদার।

যখন আমার হাসির মাঝে কান্না ঝরে,

সেও হাসতে হাসতে কাঁদতে  শুরু করে।

একেই বলে ভালোবাসা,

ওজন পাল্লা হয়না উঁচু নিচু।

 

মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে একই কথা বলি,

একসাথে মন উজাড় করে।

দুজনেই একই পথে চলি,

আবেগ ভরা এক পৃথিবীর মাঝে।

তবুও হয় না দুটি হাত এক হতে।

মাঝে যে স্বচ্ছ কাঁচের জানালা!

চালকোলিথিক ভাবনায় বসন্তের দাগ পড়েছে

নিজেকে পাল্টানো যুগান্তরের মতো ।

 

শেষটায় পৌঁছে ভাবি

কিছু ডিলিট করে ,আবার যদি এডিট করা যেতো !

 

তবু ঘুম আসে চর্যাপদের অন্তিমে এসে ,

কখনও ক্লান্ত লাগে ভালোবাসায় ।

 

স্থিতিশীল কিছু কম্পাংক ,

ফিনকি দিয়ে বেরোনো অনুভূতিরা ভীষন শান্ত আজ

 

নিজের মতো করে খুঁজে নেওয়া একটা পথ ,

বাকিটা ব্লারিং স্কেচে নিমগ্ন ।

 

যদি পারো ,

কোনো একটা ফসিলে আমার নাম লিখে রেখো !

বাকিটা ইতিহাস আমি গড়ে নেবো।

ময়নামতী রোদ্দুর ছুঁতে চায়নি

সে শুধু অমলকান্তিকে ছুঁতে

চেয়েছিলো।

ময়নামতী বোকা মেয়ে,জানতোনা

অমলকান্তিকে ছোঁয়া যায়না,

রুপোলি জ্যোৎস্নার মতো আঙ্গুল

ছুঁয়ে ভেসে যায় অমলকান্তি,মেঘের

ভেলায়।

অমলকান্তিকে বাঁধা যায়না,বসন্তের

হাওয়ার মতো পলাশগন্ধে মুখ ডুবিয়ে

ছড়িয়ে পড়ে সে।

ময়নামতী তবুও অমলকান্তিকে খোঁজে

মাঠ-ঘাট,গলিপথ-রাজপথ কিচ্ছু বাকী

রাখেনা।

ময়নামতী বোকা মেয়ে,জানেনা

অমলকান্তি লুকিয়ে থাকে মণিকোঠার

অতলে।

আয়নার কাঁচে ঝলমল করে অমলকান্তি

শরীর জুড়ে।

দুর্বার আশাগুলো হয়েছে যখন অলখে ম্রিয়মাণ

তবু এ মনেতে আছে যেনিবীড় ভরসা অফুরান;

খুশীর ছোঁয়ায় দীগন্ত

চলছে ছুটে যে অনন্ত,

ডুবন্ত সূর্যটা যায় ফিরেরেখে সে স্বপ্ন-নিশান

নির্ঝর অনুভবে পাইতার দৃপ্ত সুরভিত প্রাণ ।।

 

হৃদয় ভাঙার খেলাকরেছো খুবই যতনে তা রপ্ত

যে অছিলায় গিয়েছো ফিরেছিলো দৃঢ়তায় সুপ্ত;

ছেড়ে যেতে যে অভিনয়

ছিলো অচেনা সে পরিচয়,

এ ভাবে হারিয়েরইলে তুমি যে জয়ের পরশে লিপ্ত

নীরব অনুভবে পাইঅতল মননে রেখেছো যারে গুপ্ত।।

 

অজানার ভেলায় যায় যদি ভেসেতৃষিত ব‍্যাকুল এ মন

সবটুকু উজাড় করেওনিঃস্ব হয়ে শুধু কাল-রাত্রি যাপন;

কত অশ্রু নিয়ে নদী

প্রতিক্ষায় নিরবধি,

দূরের বলাকারা রেখে যায় শুধুঅবুঝ রুদ্ধ সে ক্রন্দন

অস্ফুট অনুভবে পাইতার সিক্ত আকুল হৃদ-স্পন্দন ।।

সব পাখি ঘরে  ফিরে

নদী খুঁজে তার কূল

খেয়া তরী

বুকের নদীতে ভাসিয়ে

আমি ভালবাসায়  আকূল।

 

ঝরণা কুল কুল ধ্বনিতে

হারিয়ে যায় কোনো সুদূরে

আমি দখিনা দুয়ারে বসে

থাকি প্রতিক্ষার প্রহরে।

 

আকাশেতে ঘনঘটা

আঁধারেঢাকা মনো মেঘ

সারাদিন ঝরছে  অবিরাম বৃষ্টি

বাঁধ ভাঙা হৃদয়ের আবেগ ।

 

বৃষ্টির ফোঁটা মুক্তার মতো

পাতার বুকেতে লেপ্টে

বৃষ্টির জলেডুবে  আঁখি

আজো রয়েছি তোমার স্মৃতি

বুকের মাঝে ঝাপটে ।

বেয়াড়া শরীরে জেহাদি রোদ

অসংখ্য শব্দের জলসিড়ি

উঁপোসি বাতাসে দুটি হাত

জৈবিক চাহিদায় জীবন যাপন

আমি সহিষ্ণুতার চাদর জড়িয়ে

সংখ্যালঘু মেঘে বৃষ্টির কারুকাজ

শীতঘুম ভেঙে জেগেছে সরীসৃপ।

 

নরম পলি মাটির কোমল স্তর

অসংখ্য পুরুষের জলসিড়ি,

বাঁকা চাঁদের রহস্যের আবছায়া

পলাশ পাতায় খাবারের প্রয়াস.

আমি চেটে পুটে খাই প্রথম সভ্যতা

উদ্বাস্তু র মতো ভীড় আমার রাজ্যে.

জলসিড়ি বেয়ে আমি নেমে যাচ্ছি নরকে।

নদীর উপর সেতূর মাথায়

অস্তাচলের রবি ।

এ যেন প্রকৃতির এক

ক্যানভাসে আঁকা ছবি ।

 

বলাকারা ঘরে ফেরে

পিছনপানে তাকায় না কেউ ।

নদীতে বয় মৃদু বাতাস

ঢেউয়ের উপর ঢেউ ।

 

এই পাড়েতে একলা বসে

উদাস চোখে আমি ।

ওই পাড়েতে আবছা ভীষণ

সন্ধ্যা ধীরে নামি ।

 

মাঝি-মাল্লারা ব্যস্ত সবাই

ফেরাতে তাদের তরী ।

কেউ খুশিতে ডগমগ

কারোর মুখখানি ভারী ।

 

কেউ পেয়েছে আশাতীত

কারোর ঝুলি শূন্য ।

নিরাশায় কারোর ভাবনা দোলে

কারোর আশা পূর্ণ ।

 

 

জীবনটাও প্রায় একইরকম

একই গল্প আর কথা ।

কেউ পায় ঝুলি ভরে

কারোর নিরাশা আর ব্যথা ।

 

আশা-নিরাশার ঢেউয়ে দুলে

জীবন নৌকো বাওয়া ।

যেখান থেকে এসেছিলে

সেখানেই ফিরে যাওয়া ।

 

এমনি করেই চলে চিরকাল

উদয়-অস্ত জীবনের ।

আসা-যাওয়ার এই যে খেলা

জন্মের আর মরণের ।

সময় থেমে গেছে আজ

প্রবাহিত হয় না সে আর

দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল নিশ্চুপ

কোলাহল নেই তার,

পাখিরা লুকোয় খাঁচায়

বাতাস বয়  না

ফুল ফোটে না 

জঙ্গলের ক্রন্দন শোনা যায়।

 

পৃথিবী স্থবির নিশ্চলনেই  কলরব

মানুষ হারিয়েছে দিশা

জনপদ নিস্তব্ধ নীরব,

মেঘের আড়ালে সূর্য মুখ লুকায়

সমুদ্র ঢেউ হারা ঘুমে অচেতন 

পাহাড় প্রত্যয় হারায়।

 

পৃথবী নিজেকে করে না প্রদক্ষিন

সে শৃঙ্খলিত শোষণের কারায়

দিক হারা উত্তর দক্ষিন

দিন রাত একাকার এ গর্ভ গুহায়।

 

ধর্মের ওষ্ঠে অধর্ম চুমো খায়

ভালো মন্দ বিভেদ হারা

আঁধার নামে চেতনায়।

এরই মাঝে লড়াইয়ের ডাক

বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ

নতুন পথ নিয়েছে বাঁক,

জ্যোৎস্নার রাতে অন্ধকার ঘনায়

পোয়াতি মায়ের গর্ভে নতুনের জন্ম,

পরিবর্তনের বার্তা শোনা যায়।

তালুকা বনবিভাগের চেক-পোস্ট থেকে হাঁটা শুরু। গোভিন্দ পাষু জাতীয় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে প্রায় সাত ঘন্টা পাহাড়ি রাস্তায় চদ্দো কি.মি.হেঁটে পৌঁছে গেলাম সীমা গ্রাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টনস্(তমসা) নদীকে বাম দিকে রেখে হালকা চড়াই উদড়াই ভাঙা পথ….সাথে টনস্ নদীর সুর-লহরী ও বুনো আখরোট গাছের ফুলের গন্ধ। দু একটা “স্নেক লিলি”বুনো গোলাপবুনো স্ট্রবেরি পথে দেখা দেয়। সীমা গ্রাম এর ঠিক অন্য পারে অর্থাৎ টনস্ এর বামপার্শ্বে পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো অনেকগুলি  কাঠের বাড়ি যেন কেউ আটকে দিয়েছে সুন্দর করে…..এটিই ওসলো গ্রাম। কথিত আছেপান্ডবদের কাছে যুদ্ধে দুর্যোধন পরাজিত হবার পর তাঁর কিছু একান্ত অনুচর প্রাণরক্ষার জন্য  জঙ্গল পেরিয়ে এই পর্বতগাত্রে বসতি স্থাপন করে। এই গ্রামে একটি সুপ্রাচীন কাঠের তৈরি দুর্যোধন মন্দিরও আছে…..তবে তা বর্তমানে মূর্তি শূন্যতালা বন্ধ। স্থানীয়রা সামাজিক কালিমা মোছার তাগিদে এটিকে বাইরের লোকের কাছে “সোমেশ্বর মন্দির ” বলে। আসল ধাতব মূর্তিটি সাংরীগাংগার প্রভৃতি চার পাঁচটা গ্রামে দুই মাস করে পালা করে ঘুরে ঘুরে পূজিত হন। সাংরী তে এই মূর্তির পূজা ও ভোগ দান রাতের অন্ধকারে আমরা কজন দেখতে পেয়ে ছিলাম। যদিও বাইরের মানুষদের এ পূজা দেখা বা ছবি তোলা স্থানীয় মানুষরা পছন্দ করেন না। মূর্তিটি কিন্তু শিবের মতো নয়অনেকটা মুকুট পরা রাজার মতই। ওসলো গ্রামেই আমাদের গাইড বাহাত্তর সিং রানা জীর কাঠের দুতলা বাড়ী। গ্রামটি বেশ সুন্দর ও সমৃদ্ধ।

    সীমা থেকে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে প্রাতরাশ সেরে হাঁটা শুরু হল। প্রথমেই দুটি কঙ্কৃটের পিলারে ঝুলন্ত লোহার ব্রীজ পেরিয়ে টনস্ নদীর ওপারে ওসলো গ্রামের দিকে গেলাম। ওসলো কে বামে রেখে আমরা এবার ডান দিকের পথ ধরলাম।  প্রথমেই পথ উঠেছে বেশ চড়াই। ঝিড়ঝিড়ে বৃষ্টি ও শুরু হলো। পাত্তা না দিয়ে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেছি। ঘন্টা দেড়েক চলার পর চড়াই শেষ হয়ে শুরু হলো সবুজ বুগিয়াল ও গমের ক্ষেত। রোদ থাকলে আজকের ট্রেলে কষ্ট ছিল। সুন্দর মেঘলা আবহাওয়ায় গল্প করতে করতে তিনটে বুগিয়াল টপকে একটা চড়াই পার হয়ে পৌছালাম এক সুন্দর সুউচ্চ ঝর্নার নিচে। সাবধানে ঝর্নার জলপ্রবাহ টপকে পেলাম একটি ছোটো সমতল জায়গাপলিথিন সীট দিয়ে ঢাকা। তারই নিচে পোর্টাররা আগুন জেলে আমাদের জন্য চা ও প্যাকড লাঞ্চ এর ব্যাবস্থা করেছে। পিঠের স্যাক নামিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া গেলো। আবার চড়াই ভাঙা শুরু। এর পর বেশ কয়েকটি কঠিন চড়াই। পাহাড়ের নিয়মে চড়াই উঠলেই আবার উৎড়াই নামতেই হয়। এটাই আমার কাছে বিড়ম্বনা মনে হয়। এবার গাছপালার ঘনত্ব  প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আট ঘন্টা পর এক অসাধারণ উপত্যকায় উপনীত হলাম। একটি টিনের সাইনবোর্ডে বনদফতর লিখেছেন Har-ki-doon valley,11660 ft” যাক আজকের মত ট্রেক শেষ। উপত্যকার শেষ প্রান্তে আমাদের তাঁবু খাটানো চলছে। আমরা স্যাক নামাতেই হাতে হাতে চলে এলো গরম স্যুপ। সবুজ ঘাসের বুগিয়ালে বসে স্যুপ এ চুমুক দিতে দিতে চলতে লাগল হর-কি-দুন এর পৌরানিক কাহিনী। মহাদেব মৃত সতীর দেহ কাঁধে প্রলয়নৃত্য করছেন। সৃষ্টি ধংসের মুখে। বিষ্ণু তাঁর চক্রের আঘাতে সতীর দেহ ছিন্নভিন্ন করছেন। মহাদেব নৃত্য করতে করতে এই উপত্যকায় পৌঁছে খেয়াল করলেন তাঁর কাঁধে সতীর দেহ আর অবশিষ্ট নেই। বিরহী পুরুষ মনের তীব্র অবসাদে এই স্থলে সুদীর্ঘ সময়ের জন্য ধ্যান মগ্ন হলেন । তাই এই স্থল হর বা শিবের দুন বা উপত্যকা। সবুজ ঘাসের উপর নানা রঙের ফুল ফুটেছে …..পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মারিন্দা নালা যার উৎ মুখে আগামীকাল যাব। তিনটি কাঠের লগ ফেলা আছে নালার উপর….পায়ে পায়ে টপকে ওপারের টিলার উপর উঠলাম। বাসিন্দারা শিবলিঙ্গম স্থাপন করেছে দেখলাম। টিলার ওপারে আর একটি উপত্যকা চলে গেছে যমদ্বার গ্লেসিয়ার এর দিকে। বয়ে এসেছে যমনালা যা মরিন্দা নালার সাথে হর-কি-দুন উপত্যকায় মিলিত হয়ে হর-কি-দুন নালা হয়ে নেমে যায় এবং নিচে গিয়ে নাম হয় টনস্ বা তমসা নদী। টিলার উপর বনদফতরের একটি ছোটো কাঠের বাড়ি আছে। আমরা ফিরে এলাম টেন্টের কাছে আমাদের রোজকার সান্ধ্য মুড়ির আড্ডা বসাতে। হঠাত্ মেঘ একটু পরিস্কার হতে গাইড বাহাত্তর সিং জী দেখালেন তিন মাথা সহ স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গ …..যে পাহাড়ের গা বেয়েই নাকি শেষ যাত্রা করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব। ছবিটা কেবল তুলেছি…..ঘন মেঘে ঢেকে গেল সমগ্র আকাশ। আমরা টেন্টের ভিতর মুড়ি ঢেলে শুরু করলাম আড্ডা।

    সকাল সাড়ে সাতটায় শিবের উপত্যকা বা হর-কি-দুন কে বিদায় জানিয়ে পাশের পর্বতগাত্র ধরে আড়াআড়ি ভাবে উঠতে শুরু করলাম। হর-কি-দুনেই ট্রি-লাইন শেষ। এবার থেকে শুধুই পাথরের রাজ্যে বিচরণ। প্রথমেই ঘন্টা খানেক তীব্র চড়াই ভাঙার পর একটা জায়গায় উঠে আসা গেল। কিন্তু শুরু হল বোল্ডার। পৌনে নটা নাগাদ দেখতে পেলাম উপর থেকে নেমে আসা জলপ্রবাহ একটি বড় পাথরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছোটো জলাশয় সৃষ্টি করেছে। এটাই বুঝলাম মারিন্দা বা মরিন্দা তাল। ছবি তুললামপাঁচটা মিনিট বসলাম। এর পর সুন্দর বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে আরো মিনিট কুড়ি হাঁটার পর মারিন্দা নালার উপর আর একটি অপেক্ষাকৃত বড় জলাশয় দেখতে পেলাম। এই জায়গাটি আরো মনোরম। সম্ভবত এটাই আসল মারিন্দা তাল। স্যাক নামিয়ে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। দলের জনাপাঁচেক এগিয়ে গেছেআমরা কয়জন শুকনো খাবার ও জল খেলাম,ছবি তুললাম। আবার এগিয়ে চলা। বুঝতে পারছি খুব ধীরে ধীরে উচ্চতা বেড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে আসা সরু সরু জলস্রোত টপকাতে হচ্ছে। ঘাস ও ঘাস ফুল মারিয়ে চলেছি। অবশেষে একগুচ্ছ বড়ো বড়ো বোল্ডার টপকে বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছালাম রাথাডোড় ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। মারিন্দা নালা এখানে বারংবার বিভাজিত হয়ে জলের জালিকা তৈরি করেছে। রাস্তায় আসার সময় দু চার ফোঁটা বৃষ্টি হলেও এখন  আকাশ পরিষ্কার। তবে ঠান্ডা বাড়ছে। মধ্যাহ্ন ভোজের পর সবাই যখন আড্ডার মেজাজেআমাদের মেজাজি দলনেতা রথীন বল্ল এক্লাইমেটাইজ‘ করতে পাশের পাহাড়ে অন্তত পাঁচশ মিটার উঠে নেমে আসতে হবে। খুব বিরক্ত হলেও দলনেতার কথায় এবং এভারেস্ট জয়ী তুলিকা রাণীর পরামর্শে সবাই খাড়াই পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম। দেড়শো মিটার উঠেছি হয়তোমুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। পাহাড়ের গায়েই পরস্পরকে ধরে দাঁড়িয়ে আছি ….প্রায় দশ মিনিট পর বৃষ্টির বেগ একটু কমতে পিচ্ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে কোন রকমে টেন্টের ভিতর। ঠান্ডায় ভিজে জামাকাপড় পাল্টে গরম চায়ে চুমুক। বর্ষন ক্লান্ত রাত কাটিয়ে পরদিন পৌনে আটটায় যাত্রা শুরু হল। প্রায় দেড় ঘন্টা অক্লান্ত চড়াই ভেঙে একটি পর্বতশিড়ায় উঠে এলাম। তারপর বড়ো বড়ো বোল্ডার ও বরফের উপর দিয়ে অতি সাবধানে নামতে আরম্ভ করলাম। আমার ডান হাঁটুর একটি পুরানো চোট তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করল। সোয়া এগারোটা নাগাদ শ্যাওড়াবিড়া বা শাওণবিড়া ক্যাম্প সাইটে পৌঁছালাম। আজ সময়ের বিচারে খুব কম হাঁটলেও  বেশ ধকল গেলো। এই জায়গাটি বেশ জল-কাদা ময়। চারিদিকে সুউচ্চ বরফাবৃত পর্বতশ্রেণী ….সেখান থেকেই জলধারা ও ঝুড়ো মাটি নেমে এসেছে। সুন্দর রোদ দেখে গতকালের ভিজে যাওয়া জামাকাপড় শুকাতে ব্যাস্ত হলাম সবাই। ঘন্টা দেড়েক পর শুকনো জামাকাপড় গুছিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে যেই টেন্টের ভিতর গেছি শুরু হল বৃষ্টি। আজ সবাই মিলে রথীনের নির্দেশ অমান্য করা হল। কেউ এক্লাইমেটাইজেসনে বেরবো না। অগত্যা একটি টেন্টে সবাই গুঁতোগুতি করে ঠুকে মুড়ি-চানাচুর সহযোগে বসল আড্ডা। বাইরে একটানা বৃষ্টি।

    গতরাতে ঘুম ভালো হল না। সমস্ত বিকেল ও সন্ধ্যা জুড়ে বৃষ্টি হয়েছে।  রাতে তাপমাত্রা শূন্যের কাছে ছিল। সকালে দেখি টেন্টের গায়ে হালকা সাদা বরফের আস্তরণ জমেছে। এই শ্যাওড়াবিড়া ক্যাম্প সাইট টি হল চারপাশের বেশ কয়েকটি ছোটো বড়ো গ্লেসিয়ারের স্নাউট বা মুখ। চারপাশ থেকে জলের ধারা নেমে এখানেই তৈরি হয়েছে মারিন্দা নালার উৎস্য। সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে ট্রেক শুরু করলাম। আজকেই সবথেকে কঠিন চড়াই ভাঙতে হবে। প্রায় দেড় ঘন্টা মোড়েন ও বোল্ডার জোনের প্রানান্ত চড়াই উঠে পৌঁছালাম একটি মোড়েন-রিজের উপর। এখান থেকে নিচে তাকালে দুটি গ্লেসিয়ার-পুল সুন্দর দেখা যায় ….তারও নিচে দেখা যায় আমাদের ফেলে আসা শাওণবিড়া বা শ্যাওড়া বিড়া ক্যাম্প সাইটতারও নিচে রাথাডোড় ক্যাম্প সাইট। রিজের উপর মিনিট দশেকের বিশ্রাম

   এর ফাঁকে সবাই পায়ে গ্রেটার ও জুতোর তলায় মাইক্রোস্পাইক লাগিয়ে নিলাম। কারণ এবার পুরোপুরি গ্লেসিয়ার বেয়ে উঠতে হবে। বেশ খাড়াই বরফের ঢাল বেয়ে উঠছি। গাইড ভীষণ তৎপরতার সাথে সবাইকে লক্ষ্য রাখছেপ্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা কখনো দুপায়েকখনো চার পায়ে (হাত ও পা মিলে) এগিয়ে চলেছি। একটি রক-ফল-জোন তাড়াতাড়ি পার হলাম। এরপর আমার একটা ছোটো বিপত্তি ঘটল। অসম বরফে পা ফেলায় বাম পা টা ঊরূ পর্যন্ত পুরোটা বরফে ঢুকে গেল আর ডান পা টা বেকায়দায় ভাঁজ হয়ে শরীরের পুরো ওজনটা পরল ডান হাঁটুর উপর। ডান হাঁটুর উপরেই ঐ অবস্থায় ভর দিয়ে বাম পা টাকে টেনে ওঠাতে হল। ফলে ডান হাঁটুর পুরাতন লিগামেন্টের ব্যথা চাগান-দিয়ে উঠলো। বয়োজ্যেষ্ঠ গাইডের কাছে হলাম ভর্ৎসিত। প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় উঠে এলাম আপারলামেজুংগা ক্যাম্প সাইট। গ্লেসিয়ার এর উপর একটু ছড়ানো জায়গায় বরফের মধ্যে টেন্ট-পিচ করা শুরু হয়ে গেছে। সামনে একটু উঠে গিয়ে আটকে আছে একটি তুষারধস। তার পাশ দিয়েই কাল উঠতে হবে বরাসু পাস….যা এখান থেকে দৃশ্যমান। জায়গাটা বেশ রোমাঞ্চকর এবং ভীতিপ্রদ। সূর্যের আলো বরফে ঝলমল করছে….তাই সবার চোখেই রোদ-চশমা। ক্যামেরায় ছবি তুলতে সবাই ব্যাস্ত। এর মধ্যেই তৈরি গরম ম্যাগি-স্যুপ। ষোল হাজার ফুটে বরফের রাজ্যে আজকের নিশিযাপন। একটা নাগাদ চারজন পোর্টারসহ কিছু মালপত্র নিয়ে গাইড উঠে গেলেন পাসের উপর অবস্থা দেখে আসতে ও লোড-ফেরি‘ করতে। তিনটে নাগাদ যখন ওরা ফিরলোতখন সবদিক হোয়াইট-আউট হয়ে শুরু হয়ে গেছে তুষার বর্ষণসাথে ঠান্ডা হাওয়া। আজকের মতো তাঁবু-বন্দী হলাম।

     গতকাল রাতে বরফের গদিতে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঘুমাতে ঘুমাতে কত যে উৎভট স্বপ্ন দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। ভোর পাঁচটায় গরম চা সহ ডাকাডাকি। ছটার মধ্যে তৈরি হয়ে নাস্তা‘ করে সোয়া ছটায় গ্রেটারমাইক্রো-স্পাইক লাগিয়ে শুরু হল যাত্রা । প্রথমে পাঁচশ মিটার মতো বরফের চড়াই ভেঙে  একটি প্রায় সমতল প্রায় কিলোমিটার খানেক লম্বা বরফ-ক্ষেত্রে উপস্থিত হলাম। ডান পাশে পুঞ্জীভূত এক তুষার-ধস্ যেন প্রকৃতির ভাস্কর্য স্বরূপ। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম। অবশেষে দেড়শো মিটার মতো উঁচু তুষারাবৃত এক খাড়াই দেওয়াল। হায় ভগবানএইটা উঠলে তবে কাঙ্খিত “বরাসু পাস”। মিনিট দুয়েক থেমে ওঠা শুরু করলাম। প্রায় সময় টিকটিকির মত চার পায়ে। শেষপর্যন্ত আটটার মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা সবাই হাজির  সূর্যালোকে উজ্জ্বল বরাসু পাসের উপর। পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে গাইড বাহাত্তর জীকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা শুরু হল। পাসের উপর পাথর ও পতাকা দিয়ে সাজানো ছোট্টো মন্দিরে চকোলেটবাদামবিস্কুট ইত্যাদি দিয়ে আমাদের রাঁধুনি রাম-ভাই সবার হয়ে পূজা দিলো ….আমরা প্রসাদ পেলাম। আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রায় চল্লিশ মিনিট পাসের উপর কাটিয়ে দিলাম। এখানেই উত্তরাখণ্ডের শেষ। এবার হিমাচলে নামতে হবে। সবার মুখ তখন শুকিয়ে গেছে। প্রায় দুশো ফুটের বেশি খাড়াই এক বরফের দেয়াল গ্লাইসেডিং‘ করে নামতে হবে…. কুড়ি তলা বাড়ির উপর থেকে ঝাঁপ দেওয়া আর কি। পোর্টাররা আগেই নেমে গেছে নিচে আমাদের ধরবে বলে। আমার সামনে সুমন একটি বরফের খাঁজে বসেগাইড তাকে কত কি বোঝাচ্ছেন। হঠাৎ দেখি সুমন নেই। এবার আমার পালা। বসলাম বরফে ….সাহস কুলাচ্ছে না….হঠা পিঠে এক ধাক্কা। আমার আর কিছু মনে নেই। দেখি দুজন পোর্টার আমার মুক্তগতি রোধ করেছে….সুমন আমার চশমাটা মুছতে মুছতে বলছে “পিনাকীদা এটা ঠিক আছে”। যাই হোকসবাই হরেক ভঙ্গিতে শেষপর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই নিচে নামলো। এরপর এক কি.মি. কি একটু বেশি লম্বা বরফ-ক্ষেত্র পেরিয়ে আবার বরফ ও বোল্ডার মিশ্রিত ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম খুব সন্তর্পণে। নেমে এলাম জুপকিয়া গ্লেসিয়ারের মোড়েন অঞ্চলে। একেবারে বাম দিক থেকে ডান দিক পর্যন্ত তিনচারটি বোল্ডার রিজ পেরিয়ে ডানদিকের প্রান্তিক রিজ এ উঠে এলাম। এর পর প্রায় দেড় ঘন্টা রিজ ধরে হেঁটে বিকেল চারটের পর বোঙ্গা ক্যাম্প সাইটে পৌঁছালাম। দশ ঘন্টার অক্লান্ত ট্রেক শেষ করে দেখি আমার ডান হাঁটু চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। কিছু খাবার খেয়ে যন্ত্রণার ওষুধ খেয়ে টেন্টে গা এলিয়ে দিলাম। পরের দিনও বোঙ্গা-নালার বা জুপকিয়া-নালার পাশ দিয়ে বোল্ডার ময় বিরক্তিকর সারে ছয় ঘন্টার ট্রেক করতে হলো দুই হাঁটুতে নী-ক্যাপ পরে। মাঝে মাঝে পাশের পাহাড় থেকে বোঙ্গা-নালায় নেমে আসা ঝোড়া অতিক্রম করতে হলো বেশ কয়েক বার। একটি সবুজ ঘাস ও রঙিন ফুলে ঢাকা পাহাড়ি টিলা টপকে ভূজানির জঙ্গলের ( ভূর্জ পত্রের গাছ) ভিতর দিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম বাস্পা নদীর ধারে জাইরি ক্যাম্প সাইটে। খরস্রোতা বাস্পা নদীর ধারে  বিকাল ও সন্ধ্যা টা কাটলো হৈ চৈ করে এবং ক্যাম্প -ফায়ার  করে। একটাই দুঃসংবাদ,পথে ইন্দো-তিব্বতিয় বাহিনীর জওয়ানদের উঠতে দেখেছি আমাদের পিছনের একটি দলের এক সদস্যের মৃতদেহ নামিয়ে আনার জন্য। পরের দিন মাত্র দেড় ঘন্টা হেঁটে রানীকান্ডায় বাস্পার উপর লোহার সেতু পার হয়ে গাড়ি ধরলাম হিমাচলের উত্তরতম গ্রাম ছিটকুলের পথে। পথে ITBP check-post এ চাআলুপকোড়া ইত্যাদি সহযোগে জওয়ানদের আতিথেয়তা ভোলবার নয়।

বাসবী দি যেই বললেন-‘না,না,হচ্ছে না অমৃতা। শোনআগে চশমা টা খোল,আর চুলটাও।’ অমনি  আশ্চর্য ম্যাজিক  ঘটে গেলো। অমৃতা চশমাটা খুলে পাশের মেয়েটির হাতে দিল।  ওর আলগোছ খোঁপাটায় একটি বেতের কাঁটা গোঁজা,তাতে অতি ছোট এক ঘুঙুরযেটি  নিঃশব্দে  ধ্বনিত অমৃতা খুলে দিতেই কালো রঙ নদী,কি আরণ্যক  ঝর্ণা -তীব্র দুপুরে যেমন গাঢ়,অথবা বিচ্ছিন্ন  একটুকরো মেঘ –একলা হয়ে আনত হয়ে কতদূর নেমে এলো!

 

সে বসেছিল মেঝেতে।  শরীর সামান্য এলিয়ে।তেমনটাই যেন বলেছিলেন বাসবী দি।  পা দুটো পিছন দিকে মোড়া,বাঁ হাতে ধরা কৃষ্ণ চূড়াটি।  সেই আপাতত লীলা কমল।

বাসবী দি বললেন-‘অমৃতা ,তুমি যে পার্বতী- উমা।  তোমার বাবার সামনে তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে সপ্ত ঋষিরা এসেছেন! অঙ্গিরা এগিয়ে এলো সামনের দিকে। হিমালয়ের সামনে। এখনতোমার আরাধ্যকে তুমি পেতে চলেছোতোমার প্রেমকে।অথচ বাবা সামনে! সেই লজ্জা আর আনন্দের মিক্স এক্সপ্রেশনটা আনো,চোখ তোল ধীরেআবার নামাও।

অমৃতা –ঠিক আছে ,’বলে এবার কেমন করে তাকালো যেন!

 

আমি জানতাম না কেবলমাত্র দুটো চোখে এতো এতো লীলা কমল একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা যায়!সে চোখে কাজল ছিল কি ছিল না,চোখ গুলি আয়ত না হরিণীর,করুণ অথবা উজ্জ্বল,  কে জানে কেমন–তবু আমার মনে হলো একমাত্র অমৃতাই সেই মেয়ে যে ঈশ্বরীর চোখ ধারণ করে।

 

 সেটা লাস্ট পিরিয়ড ছিল।  জানলার বাইরে কলেজ চবুতরা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছিল। পশ্চিমের এই ক্লাসরুমেবিভ্রান্ত এক শেষ বেলার আলো এসে থমকে গেলো অমৃতার পায়ের কাছে।  করুণ সেই আলোর স্তম্ভ পায়ের পাতা দুটিতেও কি লীলা কমল ফুটিয়ে তুললো??

 

আমার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে বললেন বাসবী দি-‘কি হলো কি রুদ্র! তোমার লাইন গুলো পড়ো এবার,তোমরা স্ক্রিপ্টের ছেলে মেয়েরা অন্তত ঠিক করে কিউ দাও। ।’

 

পড়ে গেলাম নিজের অংশটুকু,এদিকে সেই স্ক্রিপ্টের সমস্ত পাতা জুড়ে ভাসতে লাগলো লীলা কমল। ।

সোহিনী পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো-‘আতাক্যালানে,তোর হলো কি?অমৃতাদির প্রেমে পড়লি না কি?’

আমি মুচকি হাসলাম।

সে আরো ফিসফিসিয়ে বললো-‘ভুলেও ওই বোকামি  কোরো নি যেন।  ল্যাং খাবে বলে দিলুম!  ঐ যে কুর্তি পরেছে না ,ঐটের দাম তিন সাড়ে তিন হাজার মিনিমাম,আর ছেড়ে রাখা চপ্পলটি দেখিয়াছোমোচি–সাড়ে পাঁচ।  তুমি কিদুবছর জুনিয়র,বাংলা অনার্স। ওর লিপিস্টিক ইকুয়ালটু তোমার তিনমাসে   টিউশনের  মাইনে। ’

বাসবী দি-‘এতো কথা কিসের বুঝতে পারছি না-’-বলে ধমক দিতে সোহিনী চুপ করলো।

 

তখন আমাদের পুরোনো কলেজের পুরোনো ঘরটাতে একটু একটু করে সোঁদা অন্ধকার  নামছিল,স্টেজের উপর যেমন নামে যবনিকা–

-‘আবার কালবাট মোর সিরিয়াসলি’,বলে বাসবী দি পাত্তাড়ি গোটালেন।  অন্যরাও টুকিটাকি গুছিয়ে নিচ্ছে,অমৃতা হঠাৎ -‘রুদ্র হাতটা ধর্ না,পায়ে ঝি ঝি লেগেছে,উফফ-‘- বলে আমার দিকে হাত বাড়াতেই—যেন শুনতেই পাই নি,এমন ভান করে পিছনের দরজা দিয়ে করিডোরে বের হয় এলাম।

পাগল।

ঐ হাত কি ও ভাবে ধরা যায়! এমনি!এমনি!

ঐ হাত ধরার সময় বুঝি হয়েছে?

কিংশুক মুখার্জি ইউএস এ গেছে কেমিস্ট্রি তে পোস্ট ডক্টরেট করতে সেখানেই আলাপ হয় রুমিতা মিত্রর সাথে। দুজনেই কলকাতা থেকেই গেছে। কিংশুক উত্তর কলকাতার টালা পার্কের কাছে থাকে আর রুমিতা দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে থাকে। দুজনের বাড়িই কলকাতায় বলেই বোধহয় ওদের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে একই বিষয় কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে! পোস্ট ডক্টরেট শেষ করে দুজনেই রিসার্চ করতে শুরু করে এক সাথেইতারপর একসাথে থাকতে শুরু করে। কিংশুকের বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যাওয়ার খবর আসে! কাজ ফেলে যাওয়া খুবই মুশকিলরুমিতা বলে কিংশুক তুই যা তবে বেশি দেরি করিস্ না। এদিকটা আমি সামলে নেবোসেই মতো পনেরো দিনের জন্য বাড়িতে আসে। তেরো দিনে সব কাজ মিটে যায়কিংশুক ইউএস এ ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি। হঠাৎ লকডাউন শুরু হয়ে গেলফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেল। কিংশুকের মাথায় বাজ ভেঙে পরলো! ওদিকে ও লকডাউন শুরু হয়ে গেছেরুমিতা জানালো। কি যে হবে একে গবেষণার কাজতার ওপর রুমিতা কে ছেড়ে থাকা ! কিংশুক ক্রমশই ভেঙে পরতে থাকেওদিকে রুমিতা ও মনে মনে ভেঙে পরে কিন্তু কিংশুক কে বুঝতে দেয় না। দূরাভাসেই ওদের কথোপকথন চলতে থাকেদুজনে দুজনকে সান্ত্বনা দেয়। কিছুদিন পরেই লকভাউন উঠে যাবেতখন কিংশুক চলে আসতে পারবে। কিন্তু দুজনেই মনে মনে জানে  কবে যে এর শেষ কেউ বলতে পারবেনা।       

প্রতি শতাব্দীতে একটা করে মহামারী আসবেই! সারা পৃথিবী জুড়ে কতো যে প্রাণহানি হচ্ছে তার ঈয়ত্তা নেই এবং সেই নেই সংখ্যা যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে!  পৃথিবী জুড়ে রিসার্চ হয়ে যাচ্ছেএ যে কি ভাইরাস তার চরিত্র বোঝাই দায়। গিরগিটির মতো রঙ্ বদলেই যাচ্ছেকোভীদ টেস্টের জন্য পর্যাপ্ত কিট্ তৈরি করতেই চলে গেল কতোদিন। প্রথমে অনেকেই টেস্ট করাতেই চাইতো নাএর ফলে আরো ছড়িয়ে পরছিল! রাজ‍্য ও কেন্দ্র সংঘবদ্ধভাবে যেভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং কাজ করে যাচ্ছে সত্যিই প্রশংসা প্রাপ্য। দুই প্রেমিক দুই কুলে অধীর অপেক্ষায়মাঝে দুস্তর পারাবার! দুজনে ভালো মতোই জানে  এইরকম ক্ষতরনখ্ একটা ভাইরাসের প্রোটেকশন টিকার সাকসেসফুল আবিষ্কার সময় সাপেক্ষের ব‍্যাপার। তবুও আশায় বাঁচে চাষাসেই আশায় তামাম দুনিয়া!  নতুন ওষুধ বেড় হচ্ছেকিছু রোগী সেরেও উঠছে কিন্তু তারপর আর কাজ হচ্ছে না। ভারি মজার এই ভাইরাস দিনে দিনে চরিত্র বদলাচ্ছেসঙ্গে সঙ্গে সিমটনও বদলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে লকডাউন ছাড় দিচ্ছে কিছু বাস অটো চলছে সতর্কতা মেনে।           

বাড়িতে মা রয়েছে বয়স্ক মানুষদাদার মেয়ে মিঠাইয়ের সবে ছয় তাই সবরকমের প্রোটেকশন নেওয়া হয়। বাইরে থেকে কেউ আসলেই  মিঠাই ছুটে যাবে স‍্যানিটাইঝ্ করতেকিছুতেই ওকে ঠেকিয়ে রাখা যায়না। বৌদিমণি কেউ বাইরে থেকে আসলেই ওকে মাস্ক পরিয়ে দেয়ও দূর থেকে স‍্যানিটাইঝ্ করবে সারা গায়ে। হাসতে হাসতে লাফাতে লাফাতে এমন ভাবে স‍্যানিটাইঝ্ করে যেন পিচকারীতে রঙ ভরে দোল খেলছে! ওর জন‍্য স‍্যানিটাইঝ্পোশাকে দেওয়ার এন্টিজার্ম স্প্রেও বেশি লাগছেকি আর করা যায়। বাচ্চাদের জন্যও কষ্ট হয়! স্কুল বন্ধ খেলা বন্ধ বেড়াতে যাওয়া বন্ধশুধুই নিষেধের পাহাড়। তাও বাড়িটা বড়োসামনেও অনেকটা জায়গা আছে।  যেখানে একসময় দুই ভাই বন্ধুদের সাথে খেলতোএখন সেখানে মিঠাই দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে। ওর সঙ্গে বড়োদের সঙ্গ দিতেই হবেনা হলেই চিৎকারে বাড়ি মাথায় করবে‌। কাউকে না পেলে ঠাম্মাকেই টানতে টানতে নিয়ে আসবে ওর সাথে খেলার জন্যমা অবশ্য এখনো ফিট্ আছে। অনেক বছর ধরেই মা জিমে যায়এখন লকডাউনের জন্য জিম বন্ধ তবে মিঠাইএর সাথে ভালোই জিম হয়ে যায়। মা ই সামলায় ওকেসেই জন্য বাড়ির সবাই একটু শান্তিতে কাজ করতে পারে। কিংশুকদের সবাই স্বাস্থ্য সচেতনসবাই একটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে চলতে অভ‍্যস্থ। কিংশুকের বাবা প্রত‍্যেক দিন মর্নিং ওয়াক্ এ যেতোশরীর সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। লকডাউন এ মর্নিং ওয়াক্ বন্ধবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা বন্ধ। হঠাৎ লকডাউনের ধাক্কা নিতে পারলেন নাস্ট্রোক হয়ে গেলো। এখন তো বৌদিমণি কে অনেক ঝক্কি পোঁহাতে হয়সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেনে স্কুল কলেজ সব  বন্ধ। অনলাইনে ঘরে বসে ক্লাস হয়ওইটুকু বাচ্চাকে অন লাইন এ  ক্লাস করাতে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। পাকা বুড়ি মোবাইলে গেম খেলার জন্য বায়না করেতখন ওর মা বলে ঠিক আছে তুমি মোবাইল নিয়ে সারাদিন ঘরের মধ্যে একা একা খেলবে। বাবা মা ঠাম্মা কাকাই কেউ তোমার সাথে খেলবে না !  সঙ্গে সঙ্গে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে দৌড়াদৌড়ি করবে সারা বাড়িওর এক্ষুনি খেলতে ইচ্ছে করছে তাই যাকে সামনে পারবে তাকেই টানতে টানতে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায়। দুষ্টও হয়েছে খুবসবার নকল করবে! সেদিন দেখি ওর খেলার ফোন এ কথা বলছেহাই রুমি ডার্লিং কেমন আছো! কিংশুক অপ্রস্তুতকখন ওদের কথা কানে গেছে। ভাগ‍্যিস্ কেউ ধারে কাছে ছিল নাতাহলে সবাই মিলে ওকে মুরগী করে ছাড়তো। এবার খুব সাবধানে কথা বলতে হবে!  

বেলা এগারোটায় রুমির ফোন পেয়ে ভয় পেয়ে যায়এখন তো ও রিসার্চ এর কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে। ধরেই চিন্তা নিয়ে বলে তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি রুমি বলে না না আমি ঠিক আছিমা ফোন করেছিল বাবার জ্বর এসেছে। কিংশুক একদিন অন্তর গিয়ে দেখে আসেওদের একটাই মেয়ে। রুমির মামার বাড়ি সোনারপুরেমামাতো দুই দাদাই আসে  কিন্তু ঐ একটাই সমস্যা লকডাউন !  আসার পর থেকে কিংশুক যায়রুমির ফোন পেয়েই বেড়িয়ে পরলো। গিয়ে দেখে একটা আলাদা ঘরেই রয়েছেনিজেই তো ডাক্তার তাই যা প্রটেকশন নেওয়ার নিয়ে নিয়েছেন। রুমির মাকেও ঘরে ঢুকতে দেননাকিংশুক কে ভিতরে ঢুকতে দিলেন না। উনি বলেন সিজন্ চেঞ্জের জন্য ঠাণ্ডা লেগে জ্বর এসেছেতবুও সাবধানের মার নেই। তার মধ্যেও কিংশুক কে বললেন ভিটামিন সি বেশি করে খাবেগ্রিনটী তে আদা তেজপাতা দারচিনি ছোট এলাচ দিয়ে খাচ্ছো তো ?  রুমিটা কি যে করছেএমনই অবস্থা চারিপাশে যাওয়ারও উপায় নেই। ঢুকতে যখন দেবেনা কি আর করবে ! সঙ্গে আনা আঙুর আপেল কমলা লেবু মুশম্বি লেবু বাইরে থেকে দিয়ে ফিরে গেল। ওর আর ভালো লাগছেনাকতো কাজ পরে আছে ! ওদের ছয়জনের টিম্  একটা বিশেষ রিসার্চ করছেযা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু লিক আউট করা যাবে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব গভেষণা কাজটা শেষ করতেই হবেঅন‍্য দেশ যদি আগে বার করে দেয় তবে ওদের এতো দিনের পরিশ্রমে জল হয়ে যাবে! বেন স‍্যামুয়েল আর উডি রিচার্ড সবচেয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞওনাদের তত্ত্বাবধানে মারিয়াপিটাররুমিতা আর ওকে নিয়ে ছয় জনের টিম। ওদের গবেষণার ব‍্যাপারে ফোনেও কোনো কথা বলার অধিকার নেই। তাই কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানতে পারছেনা কিংশুক। ওর টিম মেটরা ওর জন্য অপেক্ষায় আছে। কি যে করবে কেমন যেন অসহায় লাগছে ! সবে একটা দুটো করে ফ্লাইট চালু হয়েছেকবে যে স্বাভাবিক হবে কে জানে ?  এমার্জেন্সী এসেছিলকিন্তু এখন যাওয়াটা আর ওর হাতে নেই। আসার সময় স্পেশাল ফ্লাইটে এসেছিলযাবার সময় ইউ এস থেকেই বিশেষ ফ্লাইটে নিয়ে যাবে।           

আর একটুও ভালো লাগছেনা কিংশুকের! ঘরে বসে বসে সবসময়ই পড়ায় ডুবে থাকেএই পড়া গুলো ওর গবেষণার কাজে আসবে কিন্তু যতক্ষণ না ওর কাজের ক্ষেত্রে ঢুকতে পারছে,ওর মন অশান্ত হয়ে আছে। রুমির কাছে খবর পায় ওখানকার অবস্থাও ভয়ংকরপ্রত‍্যেকটা দিন বেশ কিছু মানুষ মারা পরছে। যদিও রুমিরা বিশেষ প্রোটেকশনের মধ্যেই থাকেগবেষণাগারের চৌহাদ্দীতে একটা মাছিও গলতে পারেনা। ওদের বাইরে বেড়োনোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছেএমনকি বাইরে ফোন করারও পারমিশন নেই। রুমি কিংশুক আর মা বাবার সাথেই একমাত্র ফোন করতে পারেতাও ফোনের কথা বার্তা সব রেকর্ড হয়ে যায়। কোনো ভাবেই ওদের গবেষণার বিন্দু বিসর্গও যাতে বাইরে প্রকাশ না হয়ে পরে! কিংশুক জানে ইউএস এরও মাথাব্যথা ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্যতাই যাওয়া নিয়ে ওর কোনো চিন্তা নেই। একটাই চিন্তা! ওর জন্য গবেষণার কাজে দেরি হয়ে গেলোসবসময়ই ওর মাথার মধ্যে কাজ ঘুরছে। পৃথিবীতে ওর সবচেয়ে শান্তির জায়গা ওই ল‍্যাব্যেখানে ও কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। শেষ পর্যন্ত খবর আসে, 11 অক্টোবর ইউএস থেকে স্পেশাল প্রোটেকশনে ওকে নিয়ে যাবে। বাড়িতে সবার মন খারাপআর সাতদিন পর বাড়ির ছেলে কতো দূরে চলে যাবে! আবার কবে আসবে কোন ঠিক নেইবাবা তো শেষ সময়ে দেখতে পেলো না। মা তো যাবে শুনে থেকেই কাঁদতে লেগেছেওর কাছে এসে বলে হ‍্যারে কিট্টু আমি তোকে দেখতে পাবো তো শেষে ?  ও বলে তুমি ভালো ভাবে থাকোপৃথিবী সুস্থ হলে তোমাকে নিয়ে যাবো। পাশে এসে মিঠাই ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ও কাকাই তুমি শুধু ঠাম্মাকেই ভালোবাসোআমাকে ভালোবাসো না ! ওরে বাবারে পাকা বুড়ি একটাকোলে নিয়ে আদোর করতে মেয়ের মুখে হাসি ফোঁটে। আবার জিজ্ঞেস করে ঠাম্মাকেই শুধু নিয়ে যাবেআমাকে নিয়ে যাবে না এতোক্ষনে বুঝলাম ওর অভিমানের কারণ! কিংশুক কান ধরে বলেআমার ভুল হয়ে গেছে মা । শুধু ঠাম্মা নয় সব্বাই যাবেমিঠাইএর মা বাবাও যাবে। কাকাই আর ভাইজীর কথা শুনে সবাই হাহতে থাকেগুমোট পরিবেশ অনেকটা হালকা হয়ে যায় ! এবার কিংশুকের মিঠাইএর জন্য খুব মন খারাপ লাগবেপুচকিটা সবসময় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। যেমনি দুরন্ত তেমনি কথার ফুলঝুরি যেন! অনেক দিন একসঙ্গে থেকেযাওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসছে মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। রুমির মা বাবার সাথে দেখা করে এসেছেওর বাবা ঠিকই বলেছে কিছুই হয়নি।তবুও টেস্ট করেছিলরিপোর্ট  নেগেটিভ এসেছে।  রুমি খুব খুশিওর টিম মেটরাও খুব খুশি। ইউএস এ গিয়ে চোদ্দো দিন করেনটাইন এ থাকার পর টেস্ট হবেরিপোর্ট নেগেটিভ হবে তারপর ল‍্যাব্ এ জয়েন করতে পারবে। আর দুদিন পরেই চলে যাবেবাড়ির সবাইকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আবার নিজের কাজেরুমির কাছে ফিরে যাবার আনন্দও হচ্ছে। বাড়ির সবাই মিলে একদিন সকালে বেলুড় মঠ ঘুরতে গেলোঅনেক দিন পর বেলুড় মঠে এলো। বেশ ফাঁকাই আছেভয় ছিল ভীড়ের ! বাচ্চা বা বয়স্কদের নিয়ে ভীড়ের মধ্যে কখনোই যাওয়া উচিৎ নয়তাই ওরা ঠিক করেছিল ভীড় থাকলে গাড়ি থেকে নামবে না। তবে ভীড় ছিলোই না বলতেসকাল নটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল। গেটের কাছে লোক আছে বেশি লোক ঢুকতে দেয় না। ছুটি বা কোনো অকেশন ছিল না বলেই বোধহয় খুবই কম লোক ছিলঅতো বড়ো প্রার্থনা ঘরে সব মিলিয়ে বারো জন। রামকৃষ্ণ দেবের সামনে চুপ করে বসতে ভীষণ ভালোবাসে কিংশুকএতো সুন্দর শান্ত পরিবেশে মনে যেন প্রশান্তি নেমে আসে। সামনে ঠাকুরের গান হচ্ছেওরা সবাই চুপ করে গান শুনছে।  ” যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবোসে তৃষা আমার জাগায়ো না। যে ভালোবাসায় তোমারে ভুলিবোসে ভালোবাসায়,  ভুলাইও না। —–” ।  কি অপূর্ব গান! ওরা প্রশান্ত মনে ফিরে আসলো বাড়ি। পরের দিন ভোরে পাঁচটা দশে ফ্লাইটসাড়ে চারটের মধ্যে এয়ারপোর্ট এর মধ্যে ঢুকে পরতে হবে। চারটের মধ্যে বাড়ি থেকে বেড়োতে হবে। মিঠাই কে ঘুম  পাড়িয়েবৌদিমণি মা দাদার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলো । সবাই কে প্রণাম করে দাদা সৌমকের সাথে বেড়িয়ে পরলোভোরবেলা রাস্তা ফাঁকা  তাই চারটে কুড়িতে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছে গেলো‌। দুভাইয়ের চোখেই জলদুজনেই জড়িয়ে ধরলো। দাদা তোরা সবাই ভালো থাকিস বলে গেটের দিকে এগিয়ে গেলোপিছনে দাদার গলা শুনলো ভাই পৌছেই খবর দিস্।  কিংশুক দাদার দিকে তাকিয়ে আচ্ছা বলে হাত নেড়েচোখের জল মুছতে মুছতে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে গেল। এবার প্রতিক্ষায়কবে আবার কাজে ফিরবে। কবে রুমিতার কাছে পৌছবে !

আমরা প্রায় সবাই জানি আমাদের এই সুন্দর ধরিত্রীতে সবথেকে তিনটি অতি ভারি সুন্দর এবং মধুময় আকর্ষণীয় জিনিস আছে, এই তিনটি জিনিস যথাক্রমে হলো—শিশু, ফুল ও পাখি৷

এই তিনটি অর্থাৎ একটি মানব শিশু, একটি পাখি বা পাখির ছানা এবং উদ্ভিদজগতের বিভিন্ন গাছের সুন্দর রংবাহারি ফুল৷ এই তিনটি ছাড়া মহাধরিত্রী যেন একেবারে অমলিন ও ফিকে৷ শিশু-ফুল-পাখিকে ভালোবাসে না এমন কোনো মানুষ এই ধরিত্রীতে নেই এটা আমার মনের ঐকান্তিক দৃঢ় ধারণা৷ এই কথাটি আমরা সবাই এক কথায় জানি, মানি বা স্বীকার করি৷ কিন্তু এই জানি ও মানির মধ্যে আবার কিছু ব্যতিক্রম আছে—সেটা আমি অন্য কোনো গল্পে ঘটনাটা তুলে ধরবো৷

এখন আসা যাক এই তিনটির মধ্যে পাখির সম্বন্ধে একটি গল্পেগাঁথা কথায়৷ এটা কিন্তু কোনো আজগুবি গল্প নয়, সত্যিকারের আমার জীবনের একটা বড়ো উপলব্ধি বা নিজের বড়ো পাওনা৷

আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণী বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম৷ তখন আমার সবথেকে ভালো লাগত পাখিকে৷ তখন বলতে গেলে আমি যেহেতু শিশু, তাই শিশুর প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি আমার মনে তখনও খুব একটা জন্মায়নি৷ সেই সূত্রে আমাকে তখন বড়রা প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসত৷ আমি বড়ো হবার পর আমার শিশুর প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে, আর বাকি থাকে ফুল ও পাখি৷ ফুল তো সবারই মন কাড়ে বা ফুলের শোভাময় দৃশ্য চোখের তারাকে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই এবং মন ও প্রাণ মুগ্দ হবেই হবে৷ সেইরূপ আমার ফুলকে খুব ভালো লাগত এবং এখনও খুব ফুলের প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা—যা আমার মনের অলিন্দে চিরমর হয়ে আছে৷

ওরে বাব্বা, ফুলের কথা বলতে বলতে পাখির গল্পের প্রসঙ্গটা ভুলেই যাচ্ছিলাম৷ তবে বলা যাক পাখির প্রতি আমার কি অদম্য ভালোবাসা ও আকর্ষণের কথা৷ আমি ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে আমার মাথায় চেপে বসল পাখিকে ভালোবাসার এক গভীর অদম্য আত্মিক টান বা নিগূঢ় আকর্ষণ৷

শুধু আমি নয়, আমার সাথে আমার পাড়ার কয়েকজন সমবয়সী বা দু-চার বছরের বড়ো ছেলেরাও ছিল, সবাই মিলে আমরা প্রায় সাত-আটজন৷ আমরা প্রায় যে কোনো খেলাধুলা এই সাত-আটজন একসাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে বিভিন্ন খেলা খেলতাম৷ তাই পাড়ার লোকেরা আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের ন্যায় সপ্তপাণ্ডব বা অষ্টপাণ্ডব বলেও ডাকত৷ আমাদের এই সপ্তম বা অষ্টম পাণ্ডবের মধ্যে যারা ছিলাম সবাইয়ের একে অপরের প্রতি অদম্য ভালোবাসা এবং বিশ্বাসে ভরপুর ছিল বা এখনও আছে৷

আমাদের সবার মাথায় চেপে বসেছিল কোথায় কোন্ গাছে কোন্ পাখির বাসা আছে?  বিভিন্ন গাছে চোখ মেলে চিরুনিতল্লাশি মতো করে দেখে খুঁজে-খুঁজে আমরা ঠিক পাখির বাসার কাছে যাব এবং যদি পারা যায় পাখির ছানাকে নিজেদের হাতে তুলে খুব আদর করব৷ পুনরায় ওই পাখির ছানাটাকে তার বাসায় সযত্নে রেখে দেব এবং আমরা বিভিন্ন ঘাসবনে ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, ফড়িং ধরে এবং বিভিন্ন শস্যদানা ওইসব পাখির বাসায় রেখে আসতাম, তবে অবশ্য যেসব গাছের ডালে পৌঁছোনো যেত সেইসব পাখির বাসায়—কারণ যেসব পাখির বাসা একেবারে গাছের মগডালে বা শেষপ্রান্ত সীমানায় সেখানে তো আর পৌঁছানো সম্ভব নয়, কারণ ডাল ভেঙে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ভয় তো একটা আছে তাই৷

আমরা সবাই গ্রামের ছেলে, তাই এই ছোটো বেলা থেকে গাছে চড়া, সাঁতারকাটা খুব ভালো করে শিখে নিয়েছি৷ গাছে যেমন তরতর করে উঠতে পারতাম তেমনি আমাদের পাড়ার বড়ো বড়ো পুকুরেও এপার-ওপার সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে পারতাম, এটাই আমাদের কাছে গ্রামের ছেলে হওয়ার দরুন একটা বড়ো পাওনা৷

তা যাই হোক, আমরা এই সাত-আটজন পাখির বাসার সন্ধানে যেতাম৷ তবে কাক ও ফিঙে পাখির বাসা ব্যতীত, কারণ কাক ও ফিঙে খুব সাহসী ও চালাক পাখি৷ ওদের বাসায় বা নীড়ের ধারে কাছে গেলেই মাথায় ঠোঁকর লাগিয়ে মাথা ফুটো করে দেবে, তাই কোনোদিন সাহস করে কাক ও ফিঙে পাখির বাসার দিকে নজর দিতাম না, বা যেতাম না৷

আমরা যেতাম চড়াই, ছাতারে, শালিক, মৌটুসি, বুলবুলি, ঘুঘু ইত্যাদি পাখির বাসার সন্ধানে৷ আমরা ঠিক খুঁজে খুঁজে ওইসব পাখির বাসা বিভিন্ন বড়ো বৃক্ষ এবং গুল্মজাতীয় গাছ অর্থাৎ পাট গাছ, কুমলা গাছ, খড়ি ও নল গাছের বনেও চড়াই পাখির বাসার সন্ধানে যেতাম এবং হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে বেড়িয়ে ঠিক চড়াই পাখির বাসার সন্ধান পেতাম৷

তবে আমরা কোনোদিন এইসব পাখির বাসায় পাখির ছানাকে মারতাম না এবং পাখির ডিমও নষ্ট করতাম না৷ আমাদের শুধু মনের নেশা ছিল ডিমগুলিকে দেখা এবং ওইসব পাখির ছানাকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদর করে পুনরায় তাদের বাসায় রেখে দেওয়া, ওইসব পাখির ছানার মা পাখি ও বাবা পাখিরা খুব চিল চিৎকার করতো—না জানি তাদের বাচ্চাকে আমরা হয়ো মেরে ফেলবো৷

তাই আমাদের কানের কাছে এসে চিল চিৎকারে চেঁচামেঁচি করতো—কোনো কোনো সময় সাহস করে মাথার কাছে এসে যেন শোঁ করে উড়ে গিয়ে ঠোঁকর মারার চেষ্টা করতো বা আকুতি-মিনতি করতো ওদের মুখের ভাষায় বা ভাবভঙ্গিতে বোঝা যেত এই যে আমাদের ছানাকে মেরো না, আমরা খুব নিরীহ, ভেঙো না নীড়৷ তারা যেন বলতো আমরা অনেক কষ্টে খড়কুটো ছোট-ছোট ডালের পুলকি নিয়ে এসে বাসা বানিয়েছি, আমাদের আকুতি, আমাদের মিনতি তোমরা আমাদের বাসা ভেঙে দিও না৷ আমরা কখনও পাখির বাসা ভাঙতাম না, কারণ আমরা পাখির মনের কষ্ট বুঝতে পারতাম, তাছাড়া আমরা যে পাখিকে খুবই ভালোবাসতাম৷

আমরা পাখির বাসার ডিম বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতাম না, কারণ শুনেছি একাধিক মানুষের হাতে ডিম ঘাঁটঘাঁটি করলে নাকি পাখি তার ডিম থেকে পাখি আর তা দিয়ে ছানা ফোটাতে পারে না, তাই ওইসব গাছে পাখির বাসার কাছে যে যাবে শুধুমাত্র সেই হাতে তুলে নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে দেখিয়ে দিত, তাতেই আমাদের কি যে ভারি আনন্দ হত সে আর বলবার মতো নয়৷

আমরা সবাই কিন্তু গাছে উঠতাম না, যে সব থেকে সাহসী ও ভালো গাছে উঠতে পারত সেই গাছে উঠে পাখির বাসায় ক’টা ডিম আছে বা ছানা আছে আমাদের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে দেখাতো৷ এই গল্প বলার সাথে একটি কথা বলে রাখি, আমাদের সময়কালে তখন গ্রাম-গঞ্জের ছেলেরা ছোটবেলা থেকে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ইত্যাদি তাদের নিজ নিজ মনের উদ্যেমে ঐকান্তিক ইচ্ছায় খুব শীঘ্রই শিখে নিত কিন্তু এই বর্তমান আধুনিকযুগে অনেক ছেলেরা গাছে চড়তে বা সাঁতার কাটতে জানেই না বা শেখার তাদের কোনো ইচ্ছাই নেই৷ এই কথাগুলি বলার কারণ আমরা তখন খুব গাছে চড়তে পারদর্শী ছিলাম তাই বিভিন্ন গাছে উঠে পাখির বাসা খোঁজ করতাম, পাখির ডিম বা পাখির ছানাকে দেখে বা হাতে তুলে আদর-স্নেহ করতাম আবার কখনও কখনও পাখির ছানাকে বাড়িতে নিয়ে এসে পোষ মানাতাম, তাই বলে তোমরা যেন গাছে চড়তে বা উঠতে না জানলে এই সাহসিকতার কাজ কেউ করবে না, তখন দেখবে তোমার বা তোমাদের সামনে সমূহ

বিপদের হাতছানি৷ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যি কারের এই গল্পটি শুধুমাত্র তোমাদের বললাম, তা বলে তোমরা যেন এইরূপ কোনোকিছু ঘটনা ঘটাতে যেও না, যদি সাহসিকতা ও গাছের ওঠার অভিজ্ঞতা না থাকে৷

ফেরা যাক গল্পের কথায়, যে গাছে উঠতো সে একটি ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে গাছে উঠতো, যদি দেখা যেত যে পাখির বাসায় পাখির ছানা রয়েছে তাহলে ওই ছোট্ট ব্যাগে ওই ছানাগুলিকে ব্যাগে ভরে ব্যাগটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নামিয়ে দিত এবং ব্যাগ থেকে ছানাগলিকে বের করে আমরা সবাই নিজ হাতে নিয়ে আদর করে পুনরায় ব্যাগে রেখে দিতাম, তারপর গাছে থাকা ছেলেটি ব্যাগটিকে দড়ি গুটিয়ে গুটিয়ে উপরে টেনে নেওয়ার পর ছানাগুলিকে পুনরায় বাসায় রেখে দিত৷ কোনো কোনো সময় ছানাগুলি মোটামুটি বড়ো হলে কেউ কেউ পাখির ছানাকে বাড়িতে নিয়ে এসে বাড়িতে পোষ মানাতাম এবং বিভিন্ন ফড়িং, পোকামাকড় ঘাসবন থেকে ধরে এনে ওই ছানাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড়ো করতাম, এবং ওই ছানাটিও তখন বাড়ির একজন সদস্য হয়ে যেতো৷ যখন ওই ছানাটি বড়ো হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পাখির রূপ ধারণ তখন ভারি সুন্দর দেখতে লাগত৷

পাখিটিকে ধীরে ধীরে আমাদের অনেক ভাষা শেখানো হত, যার ফলে পরবর্তীসময়ে আমাদের অনেক কথা বুঝতে পারত এবং কি সুন্দর তার সুমধুর কলতানে আমাদের বাড়ির সবার মন-প্রাণ ভরিয়ে তুলতো৷আমাদের নিজের মনের সাথে পাখির মনের মিল ঘটে যেতো৷

আমি প্রায় এইরকম চার-পাঁচটি পাখি পুষে বড়ো করেছি, ওইসব পাখিদের অতি আদর স্নেহ-যত্ন দিতাম, বিভিন্ন জায়গায় ঘাসবন থেকে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, ফড়িং (তবে কোনো বিষাক্ত পোকামাকড় বা ফড়িং কোনোমতে নয়, কারণ ওইসব বিষাক্ত পোকামাকড় বা ফড়িং ফেলে পাখি মারা যাবে৷ আমরা গ্রামের ছেলেপুলে হওয়ার কারণে ছোটোবেলা থেকে চিনতে বা জানতে পেরেছিলাম বা আমাদের অভিভাবকরা জানিয়ে দিতেন কোন্টা বিষাক্ত আর কোন্টা বিষাক্ত পোকামাকড় নয়) ধরে নিয়ে এসে পাখিকে যখন খাওয়াতাম তখন সে তিড়িং-তিড়িং করে লাফিয়ে কি যে আনন্দের সহিত ফড়িং ও পোকামাকড়গুলিকে খেত এবং নেচে বেড়াত সারা উঠোন, তখন তার যেন আনন্দের কোনো সীমা থাকত না৷

আমার মতো আমার দু’চারজন বন্ধুও পাখির বাসা থেকে পাখির ছানা পেড়ে এনে তারাও পাখি পুষে বড়ো করে তুলে বাড়িতে পোষ মানিয়ে খুবই আনন্দ উপভোগ করত৷ তার সাথে সাথে বাড়ির সবাইকে পাখি তার কলতানে সুরেলা ডাকে সবার মন মাতিয়ে তুলতো৷ পাখি বাড়িতে পোষ মানালে বাড়ির সব সদস্যকে এক গভীর ভালোবাসার সূত্রে বেঁধে সবার হৃদয়ের ভালোবাসা কেড়ে নেয়৷

সত্যিই পাখি যে এতো প্রিয় তা অকল্পনীয় ব্যাপার৷ পাখিকে আমরা না ভালোবেসে কেউ থাকতে পারি না৷ পাখি এত সুন্দর, এত চঞ্চল, এত প্রাণবন্ত যে আমাদের সবার মন কাড়বেই কাড়বে এবং ভালোবাসা আদায় করে নেবেই নেবে৷

যেমন নদী আছে তাই সাগর আছে, পথ আছে তাই পথিকও আছে, মন আছে তাই ভালোবাসাও আছে, সেইরূপ গাছ থাকলে পাখি থাকবে বা পাখি থাকলে অবশ্যই গাছ থাকবে এবং আমরা চিরটিকাল পাখিকে ভালোবেসে যাব৷

পাখি বেঁচে থাকুক চিরস্থায়ী হয়ে এই মহাধরিত্রীর বুকে, এবং প্রকৃতির রূপ-রস- সুগন্ধ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তুলুক৷ এটাই মনের একান্ত কামনা৷ তাই আমাদের এই মহাধরিত্রীতে শিশু ও ফুলের সাথে সাথে পাখিও আমাদের সবার মনের অলিন্দে ভালোবাসার হৃদয়গহ্বরে চিরটিকাল চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে৷

তৃতীয় পর্ব

(মার্চ সংখ্যার পর)

রাত হয়ে গেছেসেই সকালের পর থেকে এই পাঁচজন দাঁতে কিচ্ছু কাটে নি। দেবিপ্রোর চিন্তায় আর ওকে নিয়ে অজানা আশঙ্কায় সবাই আতঙ্কিত। রাতুল মনে মনে নিজেকেই দোষ দিচ্ছে। নিজের দোষে ও এরকম একটা বিপদ ডেকে আনলো। মনে মনে ভাবতে থাকেকি হোলো দেবিপ্রোর কিডন্যাপ কি সাংঘাতিক ! ওরা পাঁচজনই ওর ফোনে দফায় দফায় চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ফোন নট রিচেবল বলছে বারে বারে। এদিকে দেবিপ্রোর বাবা মাও রওনা দিয়ে দিয়েছেন। কলকাতা থেকে ফ্লাইটে বাগডোগরাআর সেখান থেকে গাড়িতে সান্দাকফু আসছেন ওনারা। সমস্ত থানায় ইনফর্ম করা হয়েছেপুলিশও এসে পরবে। রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা কিন্তু তবু সবাই দেবিপ্রোর অপেক্ষায় আর উৎকন্ঠায় বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

                রাতুল ঠায় বারান্দায় বসে। ঠান্ডায়ক্ষিদেয়টেনশনে ওর শরীর অস্হির করছেতবু সামনের হোটেলটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। রাতুলের নির্দেশেই কেউ কোনো কথা বলছে না। সোলার সিস্টেমের অপ্রতুলতার জন্য রাতে কেউ কোনো আলো জ্বালায় নি ঘরের। কাল পুলিশ এসে পড়বে। রাতুলের বাবা মাও। আজ সারা রাত শুধুই যেন অপেক্ষার প্রহর গোনা। সবাইকে হোটেলে থাকার কড়া নির্দেশ দিয়ে রাতুল আর অগ্নিভ বেরিয়ে পড়ে। শঙ্খসায়ন আর শুভেন্দু কোনো অবস্হাতেই হোটেলের দরজা খুলবে না এমনটাই ঠিক হয়।

           সারাদিন না খাওয়াটেনশনবাইরে তিনচার টেম্পারেচার। এই  ছেলেরা তখন এগুলো উপেক্ষা করতে পারছে। খালি হাতে নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে পুরো সান্দাকফু টপটায় ওরা হন্যে  বন্ধুকে খুঁজে যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে দেবিপ্রোর বড়ো রকমের কোনো বিপদ হয়েছেএভাবে খুঁজেও কোনো লাভই নেইতবু মন মানছে না ওদের। হঠাৎ  রাতুল যেতে যেতে অগ্নিভকে বলে,

—— যেখানে আমরা বস্তাগুলো রাখা অবস্হায় দেখেছিলামসেখানে নিশ্চয়ই কেউ রেখে গেছে ওগুলো। কিন্তু অগ্নিভ প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে ওগুলো তোলা দেখে মনে হচ্ছিলবস্তাগুলো বেশ ভারী ছিল। তাই সেগুলো কাছাকাছি কোথাও থেকে এনে রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই। চল সেই জায়গাটায় যাই একবার।

——- হ্যাঁ চল ওইদিকটায় যাওয়া যাক রাতুল।

          ওরা সেই জায়গাটায় পৌঁছে দেখলো জায়গাটা ঢালের দিকেকিন্তু তার খুব কাছে কোনো হোটেল বা বাড়ি নেই । তবে সামনে একটা জায়গা খাঁড়াইসেখানে একটা পুরানো পরিত্যক্ত বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেই বাড়িটাতে গাড়ি যাবার কোনো রাস্তা দেখা যাচ্ছে নাএদিক থেকে।

—— বস্তাগুলো মনে হয় ওইখান থেকে গড়িয়ে ফেলা হয়েছেবেশ দৃঢ়তার সাথে রাতুল বলে।

—— কিন্তু তুই বলছিসখুব ভারী বস্তাঅতো উঁচু থেকে আনবে কি করে ?

——- তোর কথা ঠিক অগ্নিভকিন্তু যদি গড়িয়ে দেয় ওখান থেকে তাহলে দেখ এখানেই এসে পড়বে।

——- বাড়িটাতে লোক থাকে বলে মনে হচ্ছে কি চাঁদের আলোয় যতটুকু বোঝা যাচ্ছেতাতে মনে হচ্ছে পোড়ো বাড়ি। আর প্লাস ওই বস্তাগুলো যদি ওখান থেকে আসেতাহলে ওই বস্তায় যা আছেসেটা ওখানেই তৈরী হচ্ছেতাই না অগ্নিভর যুক্তিতে দম আছে।

—— লোকে থাকে নাযাওয়া আসা অসুবিধাজনকআর ঠিক এই কারণেই কোনো অপরাধের সাথে ওই জায়গাটার যোগসূত্র থাকাটা বেশ স্বাভাবিক।

——- সেটা নয় ঠিক আছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছি না কি দেবিপ্রোকে খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা ! অগ্নিভ বলে।

——- এই বস্তার সাথেআর ফ্রাঙ্কলি বলছিআমি জেনে ফেলেছি এমন সন্দেহেই দেবিপ্রো বিপদে পড়েছে। এটা আমি নিশ্চিত। রাতুল বলে।

 

          এদিকে হোটেলের ঘরের মধ্যেও বাকি তিনজন খুব অস্হির হচ্ছে। দেবিপ্রো তো ছিলইবাকি দুজন হোটেলের বাইরে বেরোনোয় চিন্তাও হচ্ছে ওদের।

—— ইস দেবিপ্রোকে মোবাইলে যদি পাওয়া যেত ! শুভেন্দু বলে।

—–দেবিপ্রো সত্যি বড়ো কোনো বিপদে পড়েছেআর ও সেটা আগেভাগে বুঝতেও পারে নি ! না হলে ও নিশ্চয়ই আমাদের মেসেজ দিত বা ফোন করতো। শঙ্খর ভয়ার্ত উত্তর।

——— এক কাজ করলে হয় না আমরা হোটেলের লোকেদের সব জানাই ! সায়ন বলে।

—–কাকে জানাবি ওই খাবার দিতে আসা লোকটাকে ওই কেয়ারটেকারটাকে দুটো লোক তো সাকুল্যে হোটেলে আছে । আর আমরা ছাড়া দু তিনটে  রুমের টুরিস্ট । শুভেন্দু বলে।

——- অগ্নিভ বা রাতুলের কোনো বিপদ হবে না তো ওরা এই রাতের অন্ধকারেঅজানা অচেনা জায়গায় বেরোলো ! শঙ্খর ভীতু জিজ্ঞাসা।

               এদিকে রাতুল আর অগ্নিভ হঠাৎ করেই পাহাড়ের খাঁড়াই চড়ে ওপরে উঠতে লাগলোওই পোড়ো পরিত্যক্ত বাড়িটার উদ্দেশ্যে। পূর্ণিমা থাকায় চাঁদের আলোয় দিক নির্দেশ করে ওরা ওপরে ওঠে। কিন্তু বাড়িটা একেবারেই ভাঙাচোরা নিচের থেকে অতটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না।

——– কোনো সময় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িটার এরকম অবস্হা মনে হচ্ছেঅগ্নিভ বলে।

——- এখানে কোনো লোকজন আসাযাওয়া করে বলে মনে হচ্ছে না। দেখ অগ্নিভবাড়ির চারিদিকে এতো জঙ্গল হয়ে আছেআর কেউ আসা যাওয়া করলে ঝোপঝাড় সরানোর একটা চিহ্ন থাকতো।

——-রাতুল দেখ,  দরজাটাও কেমন ভাঙা। এলামই যখন এতো কষ্ট করে একবার চল দেখেই আসি ভেতরটা।

 —— কিন্তু আমি ভাবছি ঢুকবো কেমন করে রাতুল বলে।

        অগ্নিভ ওর মোবাইলে সায়নকে ফোন করে জানায়ওরা কোথায় আছে সেই মুহূর্তে। আসলে যদি কোনো বিপদ হয় ওদের তাহলে বাকিরা কোনো ব্যবস্হা নিতে পারবে। ঘরের দরজাটা ভাঙা আর ঘরের ছাদের একদিকটা বেশ ভালো ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে। দরজাটা এমনভাবে এঁটে গেছে যে খোলাই যাচ্ছে না। তবে এখানে যে জনপ্রাণীর পায়ের ছাপ পড়ে না দীর্ঘদিন সেটা বোঝা যাচ্ছে।

 যাই হোক চারিদিকটা একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে রাতুল আর অগ্নিভ নেমে এলো পাহাড়ের ওপর থেকে। সেখান থেকে নেমে বাকি সান্দাকফু টপটা ঘুরে দেখতে লাগলো। রাতের অন্ধকারে হিমালয় নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য নিয়ে হাজির কিন্তু বেড়াতে আসা এই কিশোরদের সেদিকে তাকাবার অবসর নেই। তবে এই বিপদের দিনে আদরে যত্নে মানুষ হওয়া এই ছেলেদের মধ্যেও কষ্ট সহিষ্ণুতা ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছে। ওরা কোথাও কোনো সুরাহা দেখতে না পেয়ে ফিরে আসতে যাবে এমনসময় অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা  চিরে একটি জিপের আওয়াজ পেল। কোনোমতে অগ্নিভ আর রাতুল একটা হোটেলের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। আর ওই জিপটা

এগিয়ে গেল সামনের দিকে। জিপটা ওদের পার করে গিয়েই বাঁহাতে একটা বাড়ির সামনে থামলো। ওরা দুজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। জিপটা থেকে চারপাঁচজন লোক বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেল। জিপ থেকে অনেক মালপত্র নামিয়ে লোকগুলো বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।

সেই বাড়িটা রাতের অন্ধকারে বেশ জমজমাট হয়ে গেল। বাড়িটার ভেতর থেকে অনেক লোকের স্বাভাবিক কথাবার্তার আওয়াজ আসতে লাগলো। ওরকম ঠান্ডার মধ্যেও দুএকজন  লোক বাড়ির বাইরে এসে কথাবার্তা বলতে লাগলোকিন্তু কোনো কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। আড়াল থেকে রাতুল বা অগ্নিভ কেউই বেরোনোর সাহস করতে পারছিল না। বাড়ির ভেতর থেকে নারীকন্ঠের আওয়াজও শোনা গেল। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হওয়ায় ওরা দুজন আড়াল থেকে বেরোলো।

               এতো রাতে এতো লোক বাড়িটাতে এলো কেন প্রশ্নটা দুজনার মাথাতেই ঘুরছিল। রাতে তারমানে এইরকম খারাপ পাহাড়ি রাস্তায়ও গাড়ি যাতাযাত করেগাড়ি মানেই এখানে ল্যান্ডরোভার। এতো রাতে ওদের দুজনের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়তাই ওরা হোটেলের দিকে পা বাড়ালো। আগামীকাল পুলিশ এসে পড়লে তবেই বাড়িটা পুলিশ সার্চ করে দেখতে পারে। আপাততঃ ওদের করার কিছু নেই। হোটেলে ফিরে এসেই রাতুলের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

—— দেবিপ্রোকে যদি কেউ কিডন্যাপ করে থাকে তাহলে তারা আজকে রাতেই সান্দাকফু ছাড়বে। আমরা যেমন ভাবছিলাম যেরাতে এই রাস্তায় গাড়ি চলে নাসেই ধারণাটা ভুল। যারাই এটা থাকুক তারা জানে একজন টুরিস্ট যখন নিখোঁজ হয়েছে তখন পুলিশ চুপ করে বসে থাকবে না। রাতুল বলে।

—- তাহলে উপায় কি করা যায় বল তো সায়ন বলে।

     অবশেষে ওরা পাঁচজন মিলে পরামর্শ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায় রাতের অন্ধকারেই। তারপর শুরু হয়ে অভিযান। প্রথম অভিযানের টার্গেট পাশের হোটেলটা। প্রথমেই চারজনই হোটেলটি ঘিরে থাকে আর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে  সায়ন।

          হোটেলের সামনের দরজাটা বন্ধ। অগ্নিভ আগেই দেখে রেখেছিল হোটেলের পেছনের দিকে একটা দরজা আছে আর  বাইরের দিক থেকে আছে একটা সিঁড়ি। সামনের দরজাটা শুভেন্দু ধাক্কা দেয় কিন্তু সেটা খোলে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। তারপর হোটেলের পেছন দিকের দরজাটায় ধাক্কা মারে সায়ন। না সেটাও ভেতর থেকে বন্ধ। দরজাটা ভাঙাও সম্ভব নয়। অবশেষে সায়ন পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখে সেখানে একটা দরজা আছে বাইরে থেকে তালা বন্ধ । শুভেন্দু সায়নের পেছনেই ছিল। খুব দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে শুভেন্দু চারিদিকে ইতস্ততঃভাবে পড়ে থাকা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আসে। দরজাটায় তালাটিও বেশ পুরানো ছিলতাই ধাক্কা দিতেই খুব সহজেই ভেঙে যায় তালা। শুভেন্দু সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে আর সায়ন দরজা দিয়ে হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করে। সামনের দিকে হোটেলকে ঘিরে তখন রাতুলদেবিপ্রো আর শঙ্খ ।

          দরজার তালাটা খোলার পরে খুব সন্তর্পণে সায়ন হোটেলের  ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দরজা দিয়ে ঢোকার পরই সায়ন মোবাইলের আলো জ্বালাতেই বুঝতে পারে এটা হোটেলের গোডাউন। এখনে পুরোনো বালিশতোষকভাঙা খাটভাঙা চেয়ার ইতস্ততঃ ভাবে ছড়ানো। এখানে যে লোকজন খুব একটা ঢোকে না সেটা বোঝা যাচ্ছে। পুরো ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখার পর সায়ন দেখতে পায় ঘরের ভেতরেনু তত্ত্ব  একটা কাঠের সিঁড়ি আছে। সিঁড়ির ওপরে যে দরজাটা আছে সেটা ঘরের ভেতর থেকেই ছিটকিনি দেওয়া। ছিটকিনিটা খুলতেই সায়ন হোটেলের কড়িডর দেখতে পেয়ে গেল। এবার সায়নের বেশ ভয় ভয় লাগতে শুরু করলোধরা পড়ে যাবার ভয়। কিন্তু পরক্ষণেই দেবিপ্রোর কথা মনে হতেই মনে সাহস চলে এলো। মোবাইলের আলো একটু জ্বেলে দেখে নিল সায়ন হোটেলের কড়িডরটা। পর পর দশটা ঘরসবই ভেতর থেকে বন্ধতিনটি ঘরে তালা দেওয়া বাইরে থেকে।  কড়িডর পেরিয়ে সিঁড়ি দেখতে পায়এখানে সবই কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখতে পায় রিসেপশন রুমকোনো লোক নেই। রিসেপশনে মাত্র দুটি চাবি রাখা আছে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে রান্নাঘর ও খাবার ঘর দেখতে পায় । খুব সন্তর্পণে চাবি রাখার জায়গা থেকে চাবি নেবে বলে হাত বাড়াতে যায়ঠিক তখনই একটা ঘরের আলো জ্বলে ওঠে।  খুব ভয় পেয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না সায়ন। সামনে দরজা দেখতে পায় ছিটকিনি দেওয়া। খুব তাড়াতাড়ি দরজা খুলে সায়ন বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ওর বন্ধুরা সবাই উৎকন্ঠিত মুখে অপেক্ষা করছে। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই রাতুল প্রশ্ন করে,

—– কি দেখলি ভেতরে সন্দেহজনক কিছু ?

——- পুরো হোটেলটাই ঘুরে দেখলামদোতলায় দশটা রুম। আটটা রুমে লোক আছেরুমগুলো ভেতর থেকে বন্ধ। বাকি দুটো রুম বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দুটো না তিনটে কি জানি যাই হোক।

——দেখমনে কররাতুল বলে।

——– তাড়াতাড়ি এখান থেকে কেটে পড়ি। হোটেলের লোক উঠে পড়েছে। লাইট জ্বালিয়েছে কেউওরা মনে হয় টের পেয়ে গেছে। সায়ন মনে মনে বিপদের আশঙ্কা করে।

          হঠাৎ একটা দুষ্টু  বুদ্ধি খেলে যায় অগ্নিভর সেই মতো সবাইকে ও পরামর্শ দেয়। আর পাঁচ মূর্তি বেরিয়ে পড়ে দ্বিতীয় অভিযানে। দ্বিতীয় অভিযানে এই পাঁচজন মিলে পুরো সান্দাকফু ঘুরে যে কাজটা করে সেটা এই সদ্য কলেজ পাশ আউট যুবকদের মাথা থেকেই বেরোনো সম্ভব। একটা ব্যাপারে সবাই নিশ্চিন্ত হয় যে দেবিপ্রোকে যদি কেউ কিডন্যাপ করেই থাকেতাহলেও এই রাতে ওকে সান্দাকফু থেকে বার  করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

সমস্ত কাজ শেষ করে ওরা পাঁচজনই ভোরের অালো ফোটার অপেক্ষা করতে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সবাই ভিউপয়েন্টে সানরাইজ দেখতে যেতে থাকে। এই পাঁচজনের সেখানে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও রাতুলের পরামর্শে সবাই বেরিয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে আজকে অার কম্বলম্যানকে দেখতে পাওয়া গেল না। ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে রিম্বি ওদের পাকড়াও করে। রিম্বিকে দেখে ওরা হাসার চেষ্টা করে।

—– কোথায় যাচ্ছো তোমরা সানরাইজ দেখা হয়ে গেলো তো রিম্বি বলে।

——-  হ্যাঁদেখা হয়ে গেছেহোটেলে ফিরবো।

——— সেই ভালো হোটেলে ফিরে যাও। ভালো ঘুরেছো তো এখানেআকাশ তো দুদিন ধরে পরিষ্কার। তোমাদের কপাল ভালো। রিম্বি বলে।

——– হ্যাঁ আকাশ পরিষ্কার। অগ্নিভ বলে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে রিম্বি বলেতোমরা হোটেলে যাও।  দরকার আছে তোমাদের সাথে,  আমি যাচ্ছি একটু পরেই।

     ওদের পিছু পিছু একটু পরে রিম্বি ওদের  হোটেলে আসে। ওদের পাঁচজনের সাথে রিম্বি কথা বলে হোটেলের বদ্ধ ঘরে। তারপর হোটেল থেকে খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে যায়। দেবিপ্রোর বাবা ফোন করে জানায় ওনাদের সান্দাকফু পৌঁছাতে এগারোটে বারোটা বাজবে। উনিই জানানপুলিশও সেই সময়ের মধ্যে এসে পড়বে। দেবিপ্রোর কোনো খোঁজ পেল কিনা সেটাও জানতে চায়।

            রাতুল আর ওর টিমের কাছে এখন একটাই চাওয়া দেবিপ্রো ! ওর যেন কিছু না হয়সুস্হভাবে ওকে যেন সবাই ফিরে পায় এর বাইরে আর কিছু নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই এই মুহূর্তে। তবু মনে মনে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে যে দেবিপ্রোকে কিডন্যাপ করলেও ওকে সান্দাকফু থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু ওর যেন কোনো বিপদ না হয় সেটাই এখন প্রার্থনা। রিম্বির পরামর্শ ও সহায়তায় ওরা একটা মোক্ষম কাজ করে ফেলেছে। দেখা যাক দেবিপ্রো যদি কিডন্যাপড হয়ে থাকেতবে ওর কিডন্যাপাররা কি ভুমিকা পালন করে সেটাই দেখার। খুব শিগগির ওদের প্রয়োজন পড়বে বিজুং ভুটিয়াকে। আর বিজুং ভুটিয়া ……. (এরপর পরের সংখ্যায়)

১.                              

 

কালো থালার মাঝে চন্দন রঙের চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। খেলা শেষ হলে মুচকি হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই এক চিলতে হাসি কার্নিশে গোত্তা খেয়ে পড়ার টেবিলে এসে পড়েছে। চাঁদের লুকোচুরি খেলায় সামিল হতে ঘরের আলো নিভিয়ে  একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে এক কিশোরি। কতক্ষণ যে এইভাবে আলো নিভিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার মনে নেই। কীরে তোর না পরীক্ষা! পড়ছিস না যে! হঠাৎ মায়ের কথা শুনে চন্দ্রার ঘোর ভাঙে। দেখো মা আজকে চাঁদকে কী মিঠা দেখাচ্ছে। মা একবার চাঁদের দিকে তাকায়একবার মেয়ের দিকে। মেয়েকেও তাঁর চাঁদ  মনে হয়। তবে তার জানলার ধারে বসে চাঁদ দেখার মতো সময় নেই। হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে এসব দেখতে সে অনেকদিন ভুলে গেছে। তবে মেয়ে কাঁধ ছাড়ানোর পর থেকে মেয়ের চোখ দিয়েই সে এখন অনেক কিছু দেখে। মেয়ের জন্যই কখনো সখনো চাঁদ দেখাও হয়ে যায়। মেয়ের বড়ো হওয়া যেন তার জন্যও বিশ্রামের পলকা বাতাস এনে দিচ্ছে। চাঁদ দেখে তার ভালো লাগলেও মুখে কপট শাসন নিয়ে বলেনে নে পড়। সামনে পরীক্ষা। শুধু বসে বসে এসব দেখলে আর পরীক্ষায় পাশ করতে হবে না। এই বলে সে রান্না করতে চলে যায়।

চন্দ্রা। নবম শ্রেণির ছাত্র। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। খুব ফর্সা নয় আবার কালোও নয়। মাঝারি গড়ন। পানপাতা মুখে কালো আর ভাষা ভাষা দুটো চোখ। সেই চোখে রয়েছে অজস্র কৌতুহল। কত কিছু সে জানতে চায়বলতে চায়। তবে সেভাবে কিছুই জানা বা বলা হয়ে ওঠে না তার। নিজের  মধ্যেই সব ইচ্ছে চেপে রাখে। বাবার সাদা-মাঠা চাকরি। তাতে প্রয়োজনটুকু কোনো রকমে পূরণ হয়। তার বাইরে আর কিছুই করা হয়ে ওঠে না। হয়তো এটাই চন্দ্রাকে সব কিছু প্রকাশ করতে বাধা দেয়। চন্দ্রার বাবার কাছে কোন কিছু চাইতে কুন্ঠা হয়। সে খুব মন দিয়ে পড়ে। একটা ভালো চাকরি তাকে পেতেই হবে। তারপর সে তার সব শখ কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে নেবে। শুধু নিজের নয়মারও সব সখ আহ্লাদ সে পূরণ করবে। স্কুলে সে মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত। সেই সুবাদে স্কুলের ম্যামদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। স্কুল চন্দ্রার খুব প্রিয় জায়গা। এখানে সে পারলে চব্বিশ ঘন্টা থাকে। স্কুল তো শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়। বন্ধু-বান্ধবগল্প-আড্ডাখেলাধূলো দেদার মজা। তাই সে কখনো স্কুল মিস করে না। ঝড় হোক বা বৃষ্টি বা হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা  সব সময় সে স্কুলে হাজির। স্কুলের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে দারোয়ান সবার সঙ্গেই তার সখ্যতা।

চন্দ্রার দুই অতি প্রিয় বন্ধু মৌমিতা আর মীনা। মৌমিতা শান্ত ধীর স্থির। পড়াশোনা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। আসে পাশে কী হচ্ছে সে নিয়ে অত মাথা ব্যথা নেই। ধ্যান-জ্ঞান শুধুমাত্র পড়াশোনা। মৌমিতা আর চন্দ্রা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ছোট্ট বয়স থেকে তাদের বন্ধুত্ব। আর মীনা ঠিক মৌমিতার উল্টো।  খুব কথা বলে। পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। কোন রকমে পাশ করলেই হল। এই স্কুলে সে নতুন। নতুন হলেও কে কার সঙ্গে প্রেম করছেশুধু ক্লাসের নয়গোটা স্কুলের খবর তার নখ দর্পণে। স্কুলের গণ্ডির বাইরে কোন ছেলে হ্যাণ্ডসাম সেই খবরও সে জানে।  নিজে সুন্দরী হওয়ায় ছেলেদের স্কুলেও বেশ পরিচিত। শুধু ক্লাসে কী পড়ানো হচ্ছে সেই বিষয়ে উদাসীন। ক্লাসের পড়া  জানতে মাঝে মাঝেই চন্দ্রার স্মরণাপন্ন হতে হয়। মৌমিতা এ সব কারণে মীনাকে একদম পছন্দ করে না। সেটা জানা সত্ত্বেও মীনা সেধে মৌমিতার সঙ্গে কথা বলে। উল্টোদিকে চন্দ্রার সঙ্গে মীনার বেশ ভাব। স্কুলে নতুন হওয়ায় চন্দ্রার ওর প্রতি একটা মমত্ব আছে। সবার সঙ্গে  আলাপ করাতে চায়। তাছাড়া ওর মীনাকে ভালোই লাগে। চঞ্চলহাসিখুশি মেয়ে মীনা। তাছাড়া সবাই তো এক হয় না। হাতের পাঁচটা আঙুল পাঁচ রকম। এটা বারবার চন্দ্রা মৌমিতাকে বোঝায় কিন্তু মৌমিতা কিছুতেই মীনাকে মেনে নিতে পারে না। মৌমিতা পইপই করে মিশতে বারণ করে। তারপরেও চন্দ্রা মীনার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে। মীনা একদিন তাকে সমস্যায় ফেলবে একথা বারংবার সে বলে। চন্দ্রা হেসে উড়িয়ে দেয়। কিছুতেই ভেবে পায় না মীনা কী করে তাকে সমস্যায় ফেলবে!

 

.

 

রাস্তার দুধারে এই অঞ্চলের দুটি প্রধান হাই স্কুল। একটি ছেলেদের,  অপরটি মেয়েদের। মেয়েদের স্কুল কিছুটা ছাড়িয়ে গেলেই ছেলেদের স্কুল।  রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে বইয়ের দোকান। এছাড়া কিছু খাবারের দোকানও রয়েছে। টিফিনের সময় ঠেলা গাড়ি নিয়ে ছোট ছোট দোকানিরা ঘুগনিআচারের পসরা সাজিয়ে বসে। টিফিনের সময় এই ঠেলা গাড়ির সামনে ভিড় উপচে পড়ে।

স্কুল শুরু হওয়ার সময় এই রাস্তার ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। সাইকেলের পাশাপাশি বাসের হর্ণের শব্দ স্কুল পাড়ার আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ায়। পাশাপাশি আরেকটি জিনিসও বেশ চোখে পড়ার মতো। স্কুল শুরু হওয়ার আগে গেটের বাইরে একটু দূর থেকে অল্প বয়সী ছেলেদের ভিড় দেখা যায়। এই চিত্র প্রায় প্রতিদিনের।

রোজ সারে দশটা নাগাদ বাস স্কুলের সামনে থামে। চন্দ্রা আর মীনা রোজ একসঙ্গে স্কুলে আসে। পাশাপাশি বাড়ি না হলেও একই রুটে ওদের বাড়ি। সারা রাস্তা মীনার বকবকে যখন চন্দ্রার কান ঝালাপালা হয়ে ওঠে ঠিক তখনই বাস স্কুলে এসে পৌঁছায়। চন্দ্রা হাফ ছেড়ে বাঁচে। তবে ইদানিং মীনার কথা শুনতে ভালোই লাগছে চন্দ্রার। আগের মতো বোর হয় না। অনেক সময় নিজেও আলোচনায় অংশ নেয়। আগের থেকে অনেক খোলামেলা হয়েছে চন্দ্রা।

বেশ কয়েকদিন ধরে একটি ছেলে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। চন্দ্রা সেটা লক্ষ্য করেছিল। তবে এতদিন  ছেলেটি হাসে নি। আজ প্রথম হাসল। মীনাও ছেলেটিকে দেখে হাসল। মীনাকে হাসতে দেখে চন্দ্রা রেগে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে যায়। “ছেলেটাকে তুই চিনিসনা। তাহলে দেখে হাসলি কেন?” মীনার সপাট উত্তর, “ছেলেটা কী হ্যাণ্ডসাম! ওরকম হ্যাণ্ডসাম ছেলে হাসলে আমি হাসব না?” “এই জন্যই মৌমিতা তোর উপর রেগে যায় জানিস তো। ধুর! ও এমনিই আমাকে পছন্দ করে না। ভাবে আমি তোকে কেড়ে নিচ্ছি। এইসব কোন কারণ নয়। চুপ কর! এবার ক্লাসে চল। নাহলে প্রেয়ার শুরু হয়ে যাবে।”

ক্লাসে ঢুকে দেখলো পিছনের বেঞ্চে সব জটলা হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ব্যাগ রেখে সব আড্ডায় মেতে উঠল।  প্রেয়ারের বেল বাজল ঢং ঢং। লাইন দিয়ে সব বারান্দায়। প্রেয়ার শেষে ক্লাসে ফিরে আবার হইচই। আজ প্রথম ক্লাস সাহানা ম্যামের। অর্থাৎ অঙ্কের ক্লাস। ম্যাথের নাম শুনলেই মীনার ঘুম পায়। ক্লাসে ঢুকেই ম্যাম প্রথমেই মীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হোমওয়ার্ক করেছিস?” মীনা “না” বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। “পড়াশোনায় একটুও মন নেই। সারাক্ষণ গল্প।”

সাড়ে চারটে নাগাদ ঢং ঢং করে  ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো। হই হই করে সব স্কুল থেকে বেরচ্ছে। চন্দ্রামীনা আর মৌমিতা রোজ একটু হেলেদুলে স্কুল থেকে বেরয়। আজও তাই অন্যথা হল না। বেরিয়েই চন্দ্রার চোখে পড়ল সকালের ছেলেটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে স্কুল শুরু হওয়ার সময় দেখা গেলেও ছুটির সময় ছেলেটিকে দেখা যায় নি। আজই প্রথম স্কুল ছুটির সময়ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। চন্দ্রা না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মৌমিতার বাড়ি স্কুলের পাশে হওয়ায় রোড ক্রস করে চলে যায়। মৌমিতাকে সি অফ করে মীনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চন্দ্রা দেখে মীনা ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছে।  বিরক্ত হয়ে ওকে একা রেখেই বাসে করে চলে যায় চন্দ্রা। পরের দিন চন্দ্রা একাই স্কুলে আসে। স্কুলে ঢুকেই মীনার মুখোমুখি। “তোর সঙ্গে কথা আছে। ব্যাগ রেখে বাইরে আয়।”

 

.

 

একটু দাঁড়াও প্লিজ!

আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?

তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আমার আপনার সঙ্গে কোন কথা নেই।

একটিবার শুধু কথা বলতে চাই।

আমার যা বলার আমি অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি। এইভাবে রাস্তার মাঝে পিছু নেওয়ার কী অর্থ! আপনি দয়া করে এখানে থেকে চলে যান।”

বাড়ি থেকে বেরতে দেরি হওয়ায় চন্দ্রা একটুর জন্য বাসটা মিস করেছে। মাঝপথে অন্য কোন বাস পেয়ে যাবে সেই আশায় পায়ের ওপর ভরসা রেখে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তায় হঠাৎ দেখা অরূপের সঙ্গে। অরূপ সেই ছেলেটিযে স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। চন্দ্রা ভেবেছিল মীনার জন্য সে দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন মীনা  জানায় ছেলেটির নাকি চন্দ্রাকে ভালো লাগে। সেই কথা মীনা মারফত ওকে জানিয়েছে। মীনার মুখেই জেনেছে ছেলেটির নাম অরূপ। চাটার্ড অ্যাকাউন্ট সেকেণ্ড ইয়ার। চন্দ্রা বিষয়টা শুনে তৎখনা না বলে দেয়। মীনা অনেকবার চন্দ্রাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ছেলেটি শুধু পড়াশোনায় ভালো নাভদ্র ও সভ্য। তাতে চন্দ্রার কী! চন্দ্রার এইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর একদম সময় নেই। তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান পড়াশোনা। তাকে মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। এইসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে কোনভাবেই সে সময় নষ্ট করতে চায় না।

কীভাবে যেন ছেলেটি তার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছে। রোজ বিকেলে চন্দ্রা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বারান্দায় বসে। আকাশ দেখে।  ঠিক সেই সময় ছেলেটি সাইকেল নিয়ে বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করে। একদিন-দুদিন নয়গত একমাস ধরে এই ঘটনা ঘটে চলেছে।  মীনা কে বিষয়টা জানিয়েছে। মীনা বলেছে সে বাড়ির ঠিকানা দেয় নি। তাহলে কী করে পেলএই প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা ভয় চন্দ্রার মনে কাজ করছে। বাবা-মার চোখে পড়ে নি তোবাবার চোখে পড়লে কীভাবে বিষয়টা নেবে সেই চিন্তায় চন্দ্রা কুঁকড়ে রয়েছে। তবে ছেলেটির সঙ্গে এ বিষয়ে একটি কথাও সে বলবে না। ছেলেটির  অস্তিত্ব যে চন্দ্রার কাছে নেই সেটা সে বুঝিয়ে দিতে চায়।

বিগত কয়েক মাস ধরে ছেলেটি বাড়ির সামনে ঘুরলেও চন্দ্রার সঙ্গে কোনদিন কথা বলে নি। আজ প্রথম কথা। অরূপের এইভাবে কথা বলায় চন্দ্রা একটু হলেও ভয় পেয়েছে। তবে ভয়কে কোনরকমে চেপে রেখেছে। অরূপের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না। সেটা স্পষ্ট করে জানালেও অরূপ নাছোড়বান্দা। সে কথা বলবেই। কোনভাবেই তাকে নিরস্ত্র করা যাচ্ছে না। চন্দ্রা দ্রুত  হাঁটতে থাকে। কোন বাস আসছে কিনা বারবার তাকিয়ে দেখে। একসময় অরূপ তার পাশে চলে আসে। চন্দ্রার হাত ধরে। চন্দ্রা হাত ছাড়িয়ে দৌড় দেয়। শাড়ি পরে দৌড়ানো সহজ নয়। তবুও একটু জোরে দৌড়ে একজন অপরিচিত মহিলাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যায়। তাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলে চন্দ্রা। অরূপ সামনে এলে দেখিয়ে বলে, “কাকীমা এই ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে আমায় বিরক্ত করছে। আমার হাত ধরে টানছে।” এই কথা শুনে ভদ্র মহিলা অরূপের দিকে এগিয়ে যায়। চন্দ্রাকে আড়াল করে দাঁড়ায়। সেই মহিলা আর অরূপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর চন্দ্রা ভদ্রমহিলার পিছনে। মহিলা বেশ জোড়ে ধমক দিয়ে অরূপকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। অরূপ একটি কথা না বলে চলে যায়। তবে চলে যাওয়ার আগে চন্দ্রার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। (পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়

♦ সম্পাদকের কথা ♦

পৃথিবীতে যখনই সংকট এসেছে তখনই সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এসেছে নতুন মোড়। আজকের এই অতিমারির সময়ে অঙ্কুরোদ্গমও চেষ্টা করছে নতুন কিছু করার। সময়ের দাবী মেনে আমরা দীর্ঘদিন অঙ্কুরোদ্গমের পেজে অনলাইন অনুষ্ঠান করেছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা শুরু করেছি অঙ্কুরোদ্গমের ম্যাগ – ভিস্যুয়াল। এখানে কবি ও সাহিত্যিকদের লেখাই শুধু নয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভিডিও আমরা সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু করেছি ক্যাম্পাস অঙ্কুরোদ্গম। প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নাট্যব্যক্তিত্বের পাশাপাশি অঙ্কুরোদ্গম চায় নবীনদেরও। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতকে একটি মঞ্চে আনতে চায় অঙ্কুরোদ্গম। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে সবাই সমস্বরে বলতে পারে “আমরা অঙ্কুরোদ্গম।”

সম্পাদক : নমিতা দাশ

সহযোগী সম্পাদক : চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়

কবিতা

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

অজিতেশ নাগ

অমিত কুমার দে

ইন্দ্রাণী বিশ্বাস মন্ডল

লিপিকা চট্টোপাধ্যায়

নাজমুল হালদার

আল্পনা মিত্র

রূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়

তরুণ কুমার ইন্দু

অতীশ দীপঙ্কর

মৌসুমী লাহিড়ী

রণেশ কুমার রায়

আইভি দত্ত

সোমনাথ চক্রবর্তী

 

মুক্তগদ্য

আলো চৌধুরী

মৃন্ময়ী রায় চৌধুরী

পিনাকী কাঁড়ার

 

গল্প

অলোক কুমার মাঝি

 

ধারাবাহিক গল্প

নমিতা দাশ (দ্বিতীয় পর্ব)

 

ভিডিও

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

গীতিকা দাশ

কাকলি ভট্টাচার্য

তাপসী ব্যানার্জী

জয়ন্ত মুখার্জী

একুশ তো জ্বলজ্বলে নক্ষত্র  দিয়ে ছায়াপথের মহাকালে বিনির্মিত অমোঘ পতাকা আমাদের।

 

অমোন আদরের পতাকায় কী কোমল গানের বিকেল সাজিয়ে বিমোহিত করো আমাকে, আর সবিস্ময়ে দেখি তখন সমস্ত ভুগোল ছাপিয়ে একুশ  তুমি পৃথিবীর পথে পথে ঈগলের ডানা হতে করেছো এক ছায়ার বিস্তার,- 

একুশ তুমি এক সুউচ্চ মিনারের ওপর থেকে ধরিত্রী কাঁপিয়ে করো মানুষের মুক্তির সুতীব্র ঘোষণা  ভালোবাসো বলে!

 

শত নদী স্রোত ছুঁয়ে ছুঁয়ে একুশ তুমি আমার মায়ের কোমল কোল, দুধের ঋণ আর বেহেস্তি মমতা – তুমি তো এক পাখি ডাকা আমার অলস সুখের বিনম্র প্রভাত!

একুশ তুমি তো বাবার দৃঢ় আলিঙ্গন জুড়ে শপথে শপথে দৃঢ়চেতা ডাক বিশ্ব মানবতার, “তুমিও যেনো থাকো দুধে-ভাতে। ”

 

কত ঋণ একুশ তোমার মতো  এক মহাপুরুষের  কাছে। তুমি বায়ান্নতে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছো গুলির কর্কশময় আগুন চিৎকার।

সে ঋণ…

আমার কিশোরী বান্ধবী আজ যাবে আপনার প্রাসাদে,

ওর নিশিন্দা পাতার চোখ, ওর বাল্যপ্রেমের গন্ধটুকু সুরক্ষিত।  

জানেন, দ্বিতীয় উচ্ছ্বাসে ও গত রাত থেকেই উদ্বেল হয়েছিলো,

জানি, কাল গোধূলি টলে গেলে আপনি ওকে নানান স্বপ্ন বিক্রি করেছেন।

আমি জানি এসব আপনার সার্বভৌমত্বের মিথ্যা।

আপনার গল্পের শেষের প্লাবন-অগ্নির ছলনাটুকুও আমিই ধরেছি।

সেসময়, আপনি ততটা গভীরভাবে আমার দিকে তাকান নি।

নয়তো ধরে ফেলতে পারতেন যে, আমি আপনাকে ধরে ফেলেছি।

আপনি জানেন না, আপনি তুষারে আগুন দিয়েছেন,

মোরগের মত গলা উঁচু করে ডাকাটাই সকাল নয়।

আমি চিনি আমার কিশোরী বান্ধবীটিকে।

ও আপনার সোনায় মোড়া প্রাসাদে ঢুকে গেলে আর বেরোবে না,

যেমন চিবুকের পাশ দিয়ে ঢলে যায় আশ্চর্য নদী।

আপনি ভালো থাকবেন আর প্রাসাদের দরজা বন্ধ রাখবেন।

আপনি আমার কিশোরী বান্ধবী’র নিশিন্দা পাতার চোখ যেই দেখবেন,

বুনো গোলাপের সুগন্ধে বুঁদ হয়ে আপনি সেইমাত্র একটি পাপ করবেন।

উচ্ছ্বল চরাচরে উত্তাল ছন্দ

শীতকাল মাঠঘাট ধোঁয়াশায় স্তব্ধ,

রাতভোর চারদিক মায়াবী নৈঃশব্দ

শুঁকে দেখো, পাচ্ছ কি বারুদের গন্ধ ?

 

চুপিচুপি কানে ঢোকে ফিসফিস শব্দ

ধুপধুপ বুট ছোটে খোঁজখোঁজ জব্দ,

ঘুমচোখে লোকজন ভয়ার্ত ধন্দে

চিকচিক টর্চ ঘোরে ফুঁড়ে খানাখন্দে

 

সেই যারা ধুয়েছিল নামহীন রক্ত

মুছেছিল ন্যাকড়াতে সাবলীল ছন্দ,

ক্ষুরধার ছুরি হাতে ভয়ানক ধন্দ

বাতাসেতে শুঁকেছ কি বারুদের গন্ধ ?

 

সন্ধ্যার নির্জনে পাহাড়ী উপান্তে

বাঁশিহাতে ঝুঁকিহীন কান্নার প্রান্তে,

কবিদের চোখ ছিল কুয়াশায় বন্ধ

বাতাসেতে মিশে ছিল বারুদের গন্ধ !

 

জোৎস্নাতে শিশুগণ কলরবে মত্ত

ঘুম নেই, ভাত চাই, অতীব ক্ষুধার্ত,

ঝুঁকি আছে যদি নাও শপথ উদাত্ত,

রক্তের বিনিময়ে নেওয়া চাই রক্ত।

 

ভাত ছিল, সেই ভাতে মিশেছিল রক্ত

বুঝে নেব কেন ভাতে হাড়মাস রক্ত,

ঝুঁকি থাক তবু নেব শপথ উদাত্ত

শোষণের প্রতিবাদী হাত করো শক্ত।

পূর্বদিকের আকাশ উঠছে রাঙা হয়ে

       তোমাকে দেখিনি কতদিন

             তোমাকে দেখিনি এক বসন্ত, এক শীত

      একেবেকেঁ চলেছে সিঙ্গারণ 

 তুমিও কি তাদের মত নিরিবিলি নির্জন

 

    তোমাকে পাইনি কতকাল

         বর্ষার জলে কানায় কানায় ভরেছে দিঘি

              ভাঙা কয়েকটা ইটের পাঁজর

        চোখ মেলেছে সবুজ নতুন পাতা

 

    থৈ থৈ পলাশবনের সুখ

          হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁকর- ধুলো মেখে

                পথের দিকে তাকিয়ে আড়াল চোখে

         ছিন্ন মেঘের একতারাতেই ভরে নিলাম সুখ।

সখা : নিষিদ্ধ স্পর্শের রেণু লেগে আছে পোশাকে তোমার৷

সে : এসব উচ্চারণ  বুঝি কাছে টানবার ?

সখা : যদি যাই ? করে দিই ছন্ন ছাড়া কাজ ?

সে : তুমি তো জানোই , আমাকে হতেই হবে সাবধানী আজ !

সখা : একটা গোলাপ তবে নিবেদন করি ?

সে : এসেছ বাজার থেকে ! স্নাত আর শুদ্ধ হও যাও, তাড়াতাড়ি৷

সখা : ভালোবাসা অশুদ্ধ বুঝি ?

অসুস্থ পৃথিবীর বুকে শুধুই রক্তের ছড়াছড়ি ?

সে : রোমকূপে রন্ধ্রে রন্ধ্রে তৃষ্ণা জেগে থাক৷

আজ নয়, প্রতিচ্ছবি গড়ি ?

সখা : সময়ের সীমানা বোঝে, হৃদয়ের আর্তির ভাষা ?

সে : ছিঁড়ে খুঁড়ে সময়ের নাড়ি, হৃৎপিন্ডে বিঁধে আছে ধ্বংসমত্ত ছুরি৷

সখা : এ সময় সত্য নয়, ছুঁতে চাই তোমাকে, এবং মানুষ প্রতিক্ষণ

সে : শরীরে সমাজ মিশে গেছে , দূরত্বের অনিবার্য যাপন।

সখা : রক্ত স্পন্দনের স্রোতে জাগবে উচ্ছ্বাস

সে : এই নাও, বুকে রাখো আমারও বিশ্বাস।

কত যে অভিশাপ, তিরস্কার, কবরের মাটি ভরে চলেছি রোজ এই জীবন নামক চৌবাচ্চার ভিতরে–

 

এ-সবই আগেভাবে জানতেন তিনি; তাই মুখের ওপরে গেঁথে দিয়েছেন শানবাঁধানো জোড়া পুকুর!

 

রাতেরবেলা গোটা শরীরে পরিচিত ছুরির আলপনা আর সকালবেলা বাধ্যতামূলক বত্রিশ পাটির ঝাড়বাতি!

 

আর ভালো লাগে না এই অবৈতনিক অভিনয়! নকল জায়নামাজ!

 

আমার নামে বরং মালাকুল মউতের কাছে দড়ি টানাটানির ফরমান জারি হোক মওলা…।

হাতধরার ভয়ে জোরে ধরলে না সে হাত

ভাত-কাপড়ের দিনে ঝড় তোলে  অজুহাত

বুঝিনি হাত ধরেছে সে এক শামুক নেহাত

খুলে ফুলো সাজ ভাবনারা খোঁজে  সওগাত।

 

শিকড় বাকড়ে ঘুন, জ্বলে কথার উনুন

ভালবাসার সে ধুন,পূর্বাভাসে টাইফুন

শুরুতে মরলো ভ্রূণ, ঝড় শেষে গুনগুন

তুচ্ছ নিয়মকানুন, ক্ষতে জ্বললো আগুন।

 

যার অপেক্ষায় রাত প্রেম  হতে চায় নদী

শরীর পোহায় তাপ সরাইখানায় হৃদি

বিষবাষ্প জমিয়ে স্বপ্নের রঙ হয় হলদী

কাজলা দীঘির ঢেউয়ে বঞ্চনার সুগন্ধী।

 

ডিঙিখানি এগিয়ে দেখি উষ্ণতা খোঁজে খালবিল

হাঁটতে হাঁটতে যাই যেখানেই সব গোঁজামিল

হলফ করে বলতে পারি প্রেম শব্দটাই গড়মিল

অন্তর্দৃষ্টি বলে স্বচ্ছ প্রেমে নেই কোনো অন্ত্যমিল।

নতুন করে লিখতে গেলে তোমার কথা,

ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃষ্টির সুর, ভিজছে শরীর,

অথচ ফোন বেজেই চলে, পালাই কোথায়?

আমার দুটি শূন্য হাতেই, সরাচ্ছি ভীড়।

 

ভারী হচ্ছে চোখের পাতা, ঘুমের ওষুধ,

সকাল হলেই পৌঁছে যাবো অফিস-বাড়ি,

সন্ধ্যেবেলায় শাঁখের আওয়াজ, পুরোনো সুর,

হারিয়ে গেছে মেঘের নীচে, সুখের বাড়ি।

 

আজকাল খুব অন্যরকম অসুখ করে।

অন্যরকম ক্লান্তি ধোয়া শরীরে মন,

গঙ্গার জল আনলো হাওয়া পবিত্রতার,

এ প্রেমিকের সাধ্যি কোথায়, তোমাকে ছোঁন?

 

এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে ভাবনা হয়,

আসছি নিয়ে অন্যদিনের বসন্তটা,

সারাটাদিন, আমার দুচোখ, আমারই নয়,

তোমার ঘরেই বৃষ্টি আনুক কয়েক ফোঁটা।

 

ভিজতে ভিজতে জুড়িয়ে নিও শরীর ও মন,

আদর কোরো নতুন কোনো সমস্যাকে,

এই ছেলেটির অন্যরকম নিয়ম-কানুন,

কয়েকশোবার কষ্ট পেয়েও, তোমায় ডাকে?

একটা আঘাত মন কাঁদাবার,

বৃষ্টি ছুটে আসে,

একটা শালুক পাঁপড়ি ঢাকা

তাকেই ভালোবাসে।

একটা নদী এপার ওপার,

কাজল জলে ডুব,

একটা ঢেউয়ে উথাল পাথাল 

শ্রাবণমাসী খুব।

একটা প্রহর দাম নিতে চায়

ঠোঁট ছোয়ানো রাত,

একটা আদল তোমার মতন

মিথ্যে অজুহাত।

একটা বাঁশির সুরের ভেতর

কান্না ঢাকা মুখ,

একটা প্রেমে সর্বনাশী

জ্বলছে পুরো বুক।

একটা অসুখ তোমার মত,

রাত নামলেই আসে,

একটা কিসসা খেরো খাতায়

আমার উপন্যাসে।

একটা সোহাগ জ্যোৎস্না মেখে

নিয়ে আসে ঋণ,

একটা মৃত্যু আমার মত

মরছে প্রতিদিন ।

একটা আঁধি-উপত্যকার

দিন ফুরানো গান,

একটা শব্দ লিখে রাখে

আমার অভিধান।

একটা আঘাত মন কাঁদাবার

বৃষ্টি ছুটে আসে,

একটা নদী আবার ভাসে

আমার শ্রাবণ মাসে ।

একটা তুমি ভুলে আছো

অজ্ঞাত এক বাসে,

একটা শালুক পাপড়ি ঢাকা

তাকেই ভালবাসে।

পৃথিবীর কোলে ঢলে পড়ে যখন রক্তিম সূর্য্য

ছেড়ে যায় নির্বাক দিনলিপির বেশ কিছু ক্ষত;

অবাক চোখে তারারা জ্বেলে রাখে অন্তিম শৌর্য্য

এ প্রাণ ধীরে ধীরে, গোপনে হতে থাকে বিক্ষত।

 

কিছু সুরে রিক্ততায় স্মিত আজ সন্ধ্যা-রাগিনী

রুদ্ধ আবেশে মেশে বিবেকহীন মৌন দিগন্ত;

অপূর্ব রূপে সেজে ওঠে কোমল সে হৃদ-পদ্মিনী

সুবাস ছড়িয়ে, যায় ভরিয়ে এ মনের প্রান্ত।

 

অবহেলার আঁচড়ে জমে দাগ  মনের আয়নায়

কিছু ব্যাথা ঝরে জ্বলন্ত মোমের চিবুক বেয়ে;

অবুঝ রূপকথা চেয়ে থাকে অলীক মুগ্ধতায়

মনের উপত্যকায় চুপকথারা থাকে ছেয়ে।

 

অস্থির এ সময়, যেন দিয়ে যায় কিসের বার্তা

প্রকৃতি ঘোমটা টানে, ঋতু ছুঁয়ে থাকে লজ্জায়;

এ ধরনীতলে অমর কে আছে, ফিরে যায় ত্রাতা

গভীর মননে, অভিমান রয় নীরব শয্যায়।

 

ঘর্মাক্ত মাটি শুষে নেয়, শিশির ভেজা যত স্বপ্ন

আকাশ মেলে ধরে ডানা, মেঘেদের বাঁধা আঁচলে;…

আজও আবার বসন্ত এসেছে 

আলগোছ মন হঠাৎই প্রেমের কবিতা লিখছে।

শিমুল আকাশে অগ্রিম পেঁজা মন আগুনে পলাশ

তাই পড়শি স্বজনের মুখে এতো চলে কানাঘুসো;

ভরে উঠছে শত আষাঢ়ে গল্পে

কানাকানি ফিসফিস হাওয়ার মতো।

কেউ সাহসী তাই এগিয়ে যাবে কয়েক কদম,

কাহন কাহন গল্প আগের মতোই রবে মশলা মেখে।

শাখায় শাখায় রুদ্ধশ্বাস আজো বসন্তের নিয়ম মেনে;

কোকিলের উদাস আকাশ আনমনা সুখে

ছড়াবে আগুন হৃদয় ভাঙার খেলা কিছু কবিতায়।

আর কবে সুস্থ হবে দেশ ও দেশবাসী

বলুন না কবিরাজ মশাই

আর যে ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।

কতদিন বেরোইনি বাড়ি থেকে,

কতদিন দেখিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য্য,

সবুজ সবুজ গাছ, কচি কচি পাতা,

রঙিন রঙিন লাল হলুদ গোলাপী ফুল।

আচ্ছা কবিরাজ মশাই

গাছে গাছে পাখিরা কি এখনও

আগের মতোই বাসা বেঁধে আছে

সবসময় কিচির মিচির করে?

যেদিন বাইরে যাবো সেদিন ওদের দেখতে পাবো?

ঝিলের ধারে বেড়াতে বেড়াতে দেখেছি

কত মাছ পারের কাছে এসে খেলা করতো।

মাছেরা হয়তো এখনো পারের কাছে আসে

আমিই শুধু দেখতে পাই না।

অতিমারীর আগে এক দিদি বলেছিল

আমাকে নিয়ে জল ফড়িং ধরতে যাবে

কি জানি সেসব কি আর হবে?

কতদিন খেলিনি কুমির ডাঙা, কানামাছি,

লুকোচুরি, চু কিত কিত, কবাডি।

আচ্ছা অতিমারী কেন আসে?

কেন সব কিছু এলোমেলো করে দেয়?

বলুন না কবিরাজ মশাই।

মা, তোমাকে আর ভালো থাকতে দেখতে চাই না

এবার তুমি একটু খারাপ থাক,

এই ধর নিজের ইচ্ছেতে খাওয়া পরা থাকা

নিজের কিছু ভালো লাগা,

ভালো লাগার জায়গায় বেড়াতে যাওয়া

নিজের দিকে একটু নজর দেওয়া

তোমার ভালো লাগার সঙ্গে

সবার ভালো লাগা মিলিয়ে দেওয়া

সংসার বাগানে সবার সঙ্গে নিজেরও ফুটে ওঠা।

 

তুমি তো ভালো গান গাও

সন্ধ্যে হলে গান নিয়ে বসা

নিজেকে নিজের মত গড়ে তোলা,

নিজের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করা।

মা, নিজের জন্য একটু সময় দেওয়া

মা, তুমিও যে একটা স্বাধীন সত্তা!

তুমি যদি একটু খারাপ থাক

আমি যে আরও ভালো থাকব,

তাই আমার ইচ্ছে তুমি একটু খারাপ থাক

সেটাই যে ভালো থাকা তোমার

ভালো থাকা আমাদের সবার

একটু ভেবে দেখ একটু খারাপ থাক

এস গড়ে তুলি সবাই মিলে এ সংসার।

আজকে ইচ্ছে হচ্ছে না কথা বলতে।

শুধু ভাবতে চাইছি ভাবনা গুলোকে ভাবতে।

মনের ভিতরে যত কথা লুকিয়ে আছে,

ডানা মেলতে চাইছে উড়ে যেতে।

নীল আকাশটা আমার কাছে

রঙিন হতে চাইছে নানা রঙে।

আমার মনের গভীরে আছে যত ক্ষত,

স্বপ্নের দেশে লুকিয়ে থাকতে চায়।

কি পেলাম আর নাইবা পেলাম

 হিসেব কষতে গিয়ে হারিয়ে

ফেলি নিজেকে।

ভালো খারাপের ভেদাভেদ থাকনা নিজের কাছে।

যেখানে অস্তিত্বের নেই কোনো সম্মান,

 সেই পথে হাঁটতে নাইবা গেলাম।

পরিচয় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের দোরগোড়ায়,

সময় ভেঙে দেয় আগাছার শিকল।

প্রতি মুহূর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে খায় অপমানের দগ্ধ ঘা।

সিঁড়ি বেয়ে ওঠে মন আকাশকে ছুঁতে।

এসেছি যে পথ ধরে ফিরবো ঠিক সময়কে সাথে করে।

নিঃসঙ্গতা  প্রশ্ন  করে,

জানিস  ওরে,  দুঃখ  কোথায়  থাকে ?

চোখের  জল  কখন  স্বপ্ন  মোছায়,

বিষন্নতার  বাঁকে ?

মানুষ  কতই  বদলে  যায়,

শুধু  স্মৃতির  পাতায়  নাকি  অনেক

ইচ্ছে  লেগে  থাকে।

 

বিষন্নতা  উত্তর  দেয়,

ইচ্ছে  গুলোও  নিষ্ঠুর   কত

পূরন  না  হয়েই  পালায়

পিছন  ফিরেই  সাজায়  জীবন,

গোলাপ  কাঁটার  মালায়।

মানুষ  কতই  বদলে  যায়

মন  খারাপের  জ্বালায়,

 

মন  বলে  ওরে  পাগল,

সবার  কাছেই  অমন  কিছু

একটু-আধটু  থাকে।

সবাই  তাই  স্মৃতির  ঘরে

folder  করে  রাখে,

মানুষ  কতই  বদলে  গেছে,

সবাই  কেমন  মনের  কোনে  দুঃখ  লুকিয়ে  রাখে।

আমি অনুরাগ বিশ্বাস৷ আমি এখন বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারং-এ উচ্চ ডিগ্রী লাভের আশায় বি. টেক কমপ্লিট করে এম. টেক-এ প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়েও আমার ফেলে আসা শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলি একেবারে ভুলতে পারছি না৷

ওই শৈশব বা কৈশোর বয়েসে আমি খুব দুষ্টু বা বিচ্ছু ছিলাম, এতো চঞ্চল মস্তিষ্ক ছিল যে আমি স্থির হয়ে থাকতে পারতাম না, কত দৌড়ঝাঁপ, ছোটাছুটি-খেলাধুলো করতাম৷ আমি গ্রামের ছেলে, সেই সূত্রে বিভিন খেলাধুলোয় মেতে থাকতাম৷ আমাদের গ্রামের মধ্যেই তিনটি খুব বড় খেলার মাঠ আছে, সেইসব মাঠে গিয়ে অতি দুরন্তপনার সহিত দৌড়ঝাঁপ করতাম বিভিন্ন খেলার মধ্যে দিয়ে৷

আমার সমবয়সী বিভিন্ন ছেলে-মেয়েরা ওইসব খেলার মাঠে আসত, একসাথে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতাম, যেমন—রামলাঠি, হা-ডু-ডু, গুলি বা পিলগুটির তিন-চার ধরনের খেলা, লুকোচুরি, বর-বউ, চোর-চৌকিদার এবং সর্বোপরি খেলাটি আমাদের সবথেকে বেশী মন কাড়তো সেটা হলো চাষাবাদের পরে ফাঁকা শুকনো ক্ষেতে এবং আহা কি ভারি সুন্দর সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছিয়ে রাখা মেঠো পথের পরে গিয়ে ঘুড়ি ও লাটিম নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো খেলায় মেতে থাকতাম৷

যেসময় চাষযোগ্য মাঠে চাষের সময় নয়, ফসল তোলা হয়ে গিয়েছে, বিস্তার জমিনগুলি একেবারে শুকনো ফাঁকা খাঁ-খাঁ করে, তখন ওইসব জমিনে গিয়ে আমি এবং আমার সমবয়সী ছেলেরা গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতাম৷

ঘুড়ি বানাতাম তিন-চার ধরনের, যেমন—সাধারণ আয়তাকার ঘুড়ি, চাঁদা ঘুড়ি এবং বাক্স ঘুড়ি৷ আমি আমার পাড়ার একজন কাকার কাছ থেকে ঘুড়ি বানানো শিখেছিলাম৷ তিনি যখন ওইসব ঘুড়ি বানাতেন তখন আমি মন দিয়ে ঘুড়ি বানানো দেখতাম, তাতেই প্রায় আমার ঘুড়ি বানানো শেখা হয়ে গিয়েছিল৷ তা যাই হোক, এই যে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি, এইসব ঘুড়ি যখন ওড়াতাম তখন ঘুড়িতে নিচের দিকে একটি বড়ো দড়ি জুড়ে দিয়ে তা প্রায় সাত-আট হাত হবে৷ ওই দড়ির শেষ প্রান্তসীমানায় কোনো এক ধরনের একটা ছোট্টো ডাল অবশ্যই পাতা সমতে হওয়া চাই, ওই ডালটাকে বেঁধে দিতাম, তারপর ঘুড়ি ছেড়ে দিতাম৷ লাটিম থেকে সুতো পটাপট ছাড়তে থাকতাম এবং ঘুড়িটি তরতরিয়ে হেলেদুলে শন-শন করে উপর উঠে যেতো ঘাড় দুলিয়ে সাপের মতো কিছুটা এঁকেবেঁকে, যতই সুঁতো ছাড়তাম ততই উপরে উঠে যেত, কতো বড় বড় গাছের দশগুন-বারোগুন উপরে উঠে যেত, যেন মনে হতো আমাদের গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে পাশের গ্রামের আকাশ সীমানায় ঢুকে তার কেরামতি হেলেদুলে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভারি সুন্দর মিষ্টিভাবে তার শোভা প্রদর্শন করছে৷ বাক্স ঘুড়ি লম্বাটে ধরনের বানানো হতো অর্থাৎ দু’দিকে দুটি ছোটো বাক্সের আকারে বাঁশের কাঠি দিয়ে বানানো হতো, মাঝখানে বেশ কিছুটা ফাঁকা থাকতো এবং ওই দুটি বাক্সের ছয়টি তলের মধ্যে পাঁচটি তলে কাগজ দিয়ে সম্পূর্ণ ভালো করে আঁঠার সাহায্য নিয়ে ঢেকে দিতাম এবং ভেতরের দিকে একটি তল ফাঁকা রাখা হতো কারণ ওই দুটি বাক্সের ভেতরে হাওয়া ঢুকে বাক্স ঘুড়িটিকে উড়তে সাহায্য করতো৷ আবার কখনও কখনও চাঁদা ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ানো হতো অর্থাৎ চাঁদা মাছের মতো দেখতে বলে এই ঘুড়িকে চাঁদা ঘুড়ি বলা হয়, এই ঘুড়ি সাধারণত শহরের ছেলেরা বিশেষ করে কলকাতায় এই ঘুড়ির ওড়ানোর প্রচলন খুব বেশী দেখা যায়৷

ঘুড়ি যখন ছেড়ে দিতাম আর হাতের লাটিম থেকে যখন সুঁতো ছাড়তাম, সুঁতো ছাড়তে-ছাড়তে ঘুড়িতে টান মারতাম এবং ঘুড়ির সুঁতো টান-টান করে ধরে ছুটতাম যাতে ঘুড়িটি আরও-আরও উপরে ওঠে সেইজন্য, তখন যেন দিক্বিদিক শূন্য আনন্দে-আত্মহারা হয়ে যেতাম৷

এইসব বিভিন্ন ঘুড়ি উড়িয়ে আমি এবং আমার সমবয়সী ছেলেরা খুবই আনন্দ উপভোগ করতাম, কতো হইচই, কতো হুল্লোড় মহানন্দে সবার মন ভরে উঠতো, সে যেন এক অকল্পনীয় ঘন-আনন্দময় ওই সময়গুলির প্রতিটি মুহূর্ত ছিল যা এখনও মনে হয় মনের স্মৃতির আয়নায় অতি টাটকা৷

সত্যিই সেইসব ফেলে আসা অতীব আনন্দময়ম ঘনঘটা দিনগুলি মনের স্মৃতিগহ্বরে আজও বারে-বারে উঁকি মারে, কারণ আমি শৈশব ও কিশোর বয়েসে যত খেলা খেলতাম সব থেকে আমার প্রিয় খেলা ছিল এই বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি ওড়ানো, এইসব ঘুড়ি উড়িয়ে সবথেকে বেশী আনন্দ উপভোগ করতাম৷ সেইসব আবেশমাখা দিনগুলি আজ আমি এত বড় হয়েও এখন এম. টেক-এর প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়েও আমি আমার গ্রামের বাড়িতে যখন যাই তখন আমার পাড়ার অনেক কিশোর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াই, যেন আমি এখনও সেই শৈশব ও কিশোর বয়েসের আনন্দ একইভাবে উপভোগ করি, তেমন আমার সাথে যেসব ছেলেরা যায় তারাও সমানভাবে এই ঘুড়ি ওড়ানোয় যে কি ভারি সুন্দর মনের আনন্দে মজে গিয়ে মুক্ত নীলাকাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দৃশ্যায়িত করে উপভোগ করে, সে যেন কত আনন্দ হয় তা মুখে বলেও বোঝানো যাবে না৷

আমি আজ শৈশব-কিশোর বয়েসের গণ্ডি ছাড়িয়ে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এম. টেক-এর প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়েও আমার ওই শৈশব ও কিশোর বয়েসের বিভিন্ন খেলার মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর যে অতি গভীর আনন্দ, আমি আজও একটুকুনও ভুলতে পারি নাই৷ তাইতো ঘুড়ির টানে আজও আমার মন নিদারুণভাবে বিগলিত হয়, আমার মন যেন এখনও ওই ফেলে আসা শৈশব ও কৈশোরের গণ্ডীসীমানার আবেশে আবদ্ধ আছে৷ আমি চাই আমার মনের অন্তস্থল সদাসর্বদা ওই শিশুসুলভেই ভরে থাকুক৷

কুয়াশা মানেই কিছুটা স্বচ্ছতা আর অনেক খানি অস্বচ্ছতা।কুয়াশা আর মানব জন্ম তো ওতপ্রোত ভাবেই জড়িয়ে আছে তাদের জন্মলগ্ন থেকেই তো ! কুয়াশারও কতো রকমভেদ।কলকাতার কুয়াশা নিত্য নৈমিত্তিক কাজের ব্যাঘাত ঘটায়।আর এই কুয়াশাই দার্জিলিং এ এলে অনেক অভিমান ছড়ায়।তাই তো কলকাতার কুয়াশার আড়াল নিয়ে একদিন ঠিক পালিয়ে যাব কোনো এক পাহাড়ের খাঁজে ঝুলন্ত কোনো এক নাম না জানা গ্রামের বাড়িতে।

পাহাড় যে আমার বড্ড  প্রিয়… ।

এই কুয়াশাই অনেক সময় একটা আস্ত পাহাড়কে লুকিয়ে ফেলে। সকলের আড়ালে নিজের বুকের ভিতরে উষ্ণ আদর দেয়। যে পাহাড়ের মধ্যে থাকে কতো ভাঁজের সমাহার, কতো রঙের মেলবন্ধন আবার না চেনা ভয় ও লুকিয়ে থাকে….ঠিক যেন একটা আস্ত জীবন।

কুয়াশার কতো রকমভেদ ! কুয়াশার পরত হাল্কা হলে দৃশ্যত হয় সামান্য আর বাকিটা কল্পনার তুলিতে রং মিশিয়ে মনের মতো করে এঁকে নিই ঠিক যেমন ভাবে জীবনের সব ভালো না লাগা অনুভূতি কে সঠিক করার চেষ্টা চালাই অনবরত।

পাকদন্ডী বেয়ে পাহাড়চূড়ার দিকে যতই এগোতে থাকি ততই কুয়াশার সঙ্গে চলতে থাকে।একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছানোর পর আর কুয়াশা পিছু নিতে পারে না….ঠিক যেমন জীবনের পরিনত অবস্থিতি।তখন কল্পনার তুলিতে সাদা-কালো ছাড়া আর যে অন্য রঙেরা তাদের রঙ হারায়। তাই তো কুয়াশা আর জীবনের রং যে এক।

 কর্মমুখর জীবন থেকে একঘেয়েমি কাটাতে মানুষকে চেনা সংসারের বাইরে পা ফেলতে হয়। সব মানুষ তো একরকম হয় না। তাই কেউ কেউ ছুটি পেলে নিশ্চিত সুখের প্রমোদভ্রমণ ছেড়ে পাহাড়-জঙ্গলের নির্জন গহীনে অনিশ্চিত ও কষ্টকর পথে বা পথহীন প্রকৃতিতে ঝাঁপ দেন। মানবসমাজ ও জীবজগতের বাইরে এসব জায়গায় ট্রেকিং এ কেনো যেতে চাই, এ নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না।

    কিন্তু যেটা বলতে চাই, হিমালয়ের কোলে প্রতিটা ট্রেক ( হ্যাঁ, প্রত্যেকটি ট্রেক ) আলাদা করে কিছু অনুভূতি উপহার দেয়; যা ঐ ট্রেকেই আবার গেলে হয়তো সেটা আর পাওয়া যাবে না।

     নিজের চিন্তাকে কোনো সংকীর্ণতায় বাঁধতে আমি রাজি নই। তাই বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে মনে হয়, ধর্ম-আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত। কিন্তু এই দর্শন নিয়ে চলতে গিয়ে বারে বারে হোঁচট খাই। মনে হয়েছে, বিজ্ঞান তো মানুষের জানা প্রকৃতি বা বিশ্বব্রম্ভাণ্ডের কিছু সীমিত অংশমাত্র।  তার বাইরে অসীম যে সত্তা, তাকে অনুভব করবো কি করে?

     কলকাতা পি.জি.হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক-শিক্ষক ডাঃ অরুণাভ সেনগুপ্তের এক লেখা আমার এই চিন্তার নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে। বয়স্ক এই মানুষটি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের চার-শয্যা কেবিনের আই.টি.ইউ. ( বিশেষ চিকিৎসা কক্ষ ) তে ভর্তি হন। একে একে জীবন্ত কক্ষ-সাথি রুগীরা যখন ঢলে পড়ছেন অনন্ত অন্ধকারে, তিনি বিশিষ্ট প্রবীণ চিকিৎসক হয়েও মৃত্যুকে তাঁর শয্যার পাশে দন্ডায়মান দেখতে পান। তিনি ভাগ্যবান, মৃত্যু তাঁকে রেহাই দিয়েছে। যুদ্ধ শেষে তাঁর উপলব্ধি,”ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখুন”। এই ঈশ্বর কি বা কে, আমি জানি না।

         প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় মাঝ রাতের কনকনে ঠান্ডায় মাথায় “হেড-টর্চ” বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। আগেপিছে সহযাত্রীদের মাথার আলো ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ঠাওর করতে পারছিনা। সঙ্গী স্থানীয় গাইড সাঞ্চামন-কে অনুরোধ করি সাথে সাথে হাঁটতে । সহযাত্রীরা ততক্ষণে আগেপিছে অন্ধকারে বিলীন হয়েছে। সাঞ্চামন “ডাইনা তরফ চলিয়ে” বলেই অদৃশ্য। তার মাথার আলোটাও বোধহয় নিভিয়ে দিয়েছে। আমি তো অন্ধকার হাতরে পাথরের বোল্ডার টপকে “ডাইনা তরফ” চলেছি; কারন অনুমানে ও হালকা নৈশ-গগনের আভায় বুঝেছি বাঁয়ে একটি জলাশয় আছে। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট বোল্ডার ও চড়াই ভেঙে ওঠার পর সাঞ্চামনের ডাক,” আপ কাঁহা যা রহা হ্যায় স্যারজি, নিচে উতারিয়ে”। বোঝ ঠ্যালা, আবার নিচে নামা। আধা ঘন্টার বৃথা শ্রম।

      গোয়েচালা ভিউ-পয়েন্ট ( ১ম টি ছাড়িয়ে ২য়ের কিছুটা আগে পর্যন্ত ) থেকে ফেরার পথে রাতের সেই জলাশয়ের সামনে এলাম। অতি পরিচিত সমিতি-হ্রদ। দিনের আলোয় চারিদিক এখন পরিস্কার দৃশ্যমান। পথশোভা দেখতে দেখতে হ্রদের বাম তীর ধরে এগোচ্ছি। হঠাৎ দেখি সাঞ্চামন হ্রদের ডানতীর ধরে কিছুটা এগিয়ে হ্রদের জল স্পর্শ করে বসে পড়লো। একটি পাথরের টুকরো দিয়ে বালির উপর কি সব আঁকিবুকি কাটলো। তারপর ধ্যানস্থ হয়ে বিরবির করে কি যেন বলতে থাকলো। আমি ধীর পায়ে তার পিছনে উপস্থিত, কিন্তু তার যেন কোনো হুঁস নেই। প্রায় কুড়ি মিনিটের উপর কেটে গেলো। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে আমায় দেখে বললো, ” আপ চলিয়ে না স্যারজি”!

      প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর, বিশ-বাইশ বছরের একটি যুবা; সমস্ত রাস্তা যে কেবল আধুনিক হিন্দি সিনেমার গান শুনিয়েছে; সেই ছটফটে মানুষটির এই অবাস্তব রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। এই পথের (ইউকসামের) অনেক গাইড-পোর্টার ও ট্রেকারদের জিজ্ঞাসা করেছি। সমিতি-লেক কে পবিত্র মানা হয়, কিন্তু এরূপ আচরণের কোনো ব্যাখ্যা কেউ দেন নি। বলাই বাহুল্য, সাঞ্চামন নিজেও না। না না, তার আচরণে কোথাও এতটুকু কৃত্রিমতা আছে বলে আমার মনে হয় নি।

        কোন মানুষ কোথায় তাঁর ঈশ্বরকে খুঁজে পান, তা চিরকালই রহস্যময়।

       হে ঈশ্বর, ( শিব, কালি, আল্লাহ্, যিশু, বুদ্ধ ….যেই নামেই তুমি স্মরিত হও ); এই অসুস্থ পৃথিবীকে সুস্থ করে তোলো।

এক

মা হওয়া কী মুখের কথা ! শুধু জন্ম দিলেই মা হয়ে যায় না। মা, দিদিমার কাছ থেকে শোনা এই আপ্তবাক্যের সুন্দর প্রতিফলন দেখা যায় সাহিত্যে। ‘বিন্দুর ছেলে’-র বিন্দুবাসিনীকে মনে পড়ে?  ‘রামের সুমতি’-র নারায়ণীকে ? পরের সন্তানকে আপন করে নেওয়ার এক আশ্চর্য শক্তি ছিল তাঁদের। হাল আমলে এমন উদারতা খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু যখন কমলা হ্যারিসের কথা শুনি। পড়ি কিছু কিছু তাঁর সম্পর্কে। সত্যি অবাক লাগে। মনে হয়, সুদূর মার্কিন মুলুকে যেন এক আটপৌরে বাঙালী। বড়ো আশ্চর্য এক মহিলা। বড়ো মায়াময় লাগে। অথচ তিনি আমেরিকার দণ্ডমুণ্ডের দ্বিতীয় ব্যক্তি। শক্তিশালী কর্ত্রী।

কমলা শব্দের অর্থ লক্ষ্মী। বাস্তবিকই লক্ষ্মীমতি তিনি। মাতৃত্ব পরতে পরতে। সন্তানের জন্ম না দিয়েও আদ্যপান্ত একজন মা। আপন করে নেওয়ার গুণেই সৎ ছেলেমেয়েরা তাঁর খুব কাছের। হ্যাঁ, তাঁদের তিনি স্টেপ মম নন। শুধুই ‘মমালা’। 

স্বামী ডাগ এনহফ ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী কারস্টিন এনহফের দুই ছেলেমেয়ে কোল আর এলা। কমলার উজাড় করা ভালোবাসায় ওদের কাছে কমলা হ্যারিস হয়ে গিয়েছেন মমালা। কমলার সঙ্গে এলা মিশিয়ে এই শব্দবন্ধ ‘মমালা’, এনহফের সন্তানদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এই ডাকের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে সন্তানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার প্রিয়ভাবনা। কমলা সানন্দে লুফে নিয়েছিলেন তাঁদের ‘মমালা’ ডাক।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের রক্তে রয়েছে একাত্মতার সংস্কৃতি। কাউকে দুঃখ না দেওয়ার, সংসার প্রাণবন্ত রাখার ভাবনা। এনহফের সংসারে পা দিয়ে তা পাখনা মেলেছিল। ছোটোবেলায় জামাইকান আমেরিকান বাবা ডোনাল্ড এনহফের সঙ্গে মা শ্যামলা গোপালনের ডিভোর্স সাত বছরের কমলার বুককে ফাঁকা করে দিয়েছিল। তাই ডাগ এনহফের সঙ্গে তাঁর ডেটিং পূর্ণতা পাওয়া না পর্যন্ত কমলা তাঁদের ভালোবাসাকে সঙ্গোপনে রেখেছিলেন। ডিভোর্সি এনহফের সন্তানরা যেন বাবার পাশাপাশি মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত না হয় এটাই ছিল কমলার চিন্তার বিষয়।

প্রায় ছোট থেকে একক মায়ের পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা কমলা সন্তানের স্থিতিশীলতায় মা ও বাবা দু’জনের ভূমিকার সমান বোধে আবিষ্ট। কোনও একজনের শূন্যতা অপরজনের শত সাহচর্যেও পূর্ণ হয় না। অভিজ্ঞতার আলোয় আলোকিত তিনি। মা-বাবার সাহচর্যবঞ্চিত সন্তানের গুমরে থাকা মনের কষ্ট নিজে পেয়েছেন বলেই ডাগের সংসারে ঢুকেই সন্তানদের দু’হাতে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। জড়িয়ে গিয়েছিলেন ওদের প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে।

দুই

কোল এখন ২৬ বছরের। পোশাকি নাম জন কোলট্রেন। এলার বয়স ২১। পুরো নাম এলা ফিটজার্যাল্ডে। কমলা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এলাদের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল। বিনোদন জগতের আইনজীবি ছিলেন তাঁর ফিঁয়াসে ডাগ এনহফ। কমলাকে প্রথম দেখে কেমন লেগেছিল হাইস্কুলে পড়া ডাগের ছেলে কোলের ? চটজলদি স্বীকারোক্তি ‘দারুণ’। বাদামি বর্ণের গ্ল্যামারাস মহিলা সম্পর্কে ডাগ (বাবা) তাদের তেমন কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, উনি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল। কোল আর কমলার মধ্যে শব্দ বিনিময় হয়েছিল যার অর্থ আচ্ছা, আচ্ছা।

সাল ২০১৩। এনহফের ছোটো মেয়ে এলা তখনও শৈশবের চৌকাঠ পেরোয়নি। এলার স্পষ্ট মনে আছে—কমলাকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন তার মনে হয়েছিল ‘এ যেন কতদিনের চেনা’। পরকে আপন করার সহজাত গুণ বা চৌম্বকীয় শক্তি কমলাকে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করেছে যা প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলেন ডাগ এনহাফ। ডাগের প্রথম বিয়ে ১৯৯২ সালে। কমলাকে বিয়ে করেন ২০১৪ সালে।  

বিশ্বে সৎ মায়েদের শ্রেণিবিভাগ করা হলে ‘তুমি হবে শ্রেষ্ঠ’ বলেছিল এলা। ‘আমাদের কাছে তুমি মমালা’। আর কমলা ?  ‘এনহফের দুই সন্তান তাঁর যাবতীয় আনন্দের উৎস। ওদের ছাড়া জীবন বিস্বাদ।’ পরিবার মানে ছোট ছোট আনন্দ। একটি মুহূর্তের আনন্দ, একটি দিনের খুশি সমৃদ্ধ করে আগামী দিনকে। আনন্দে থাকা ও ছেলেমেয়েদের আনন্দে রাখা কমলার পারিবারিক জীবনের ইউএসপি। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসে ভুলতে পারছেন না সেই দিনটির কথা। ‘ভীষণ অস্বস্তিতে ছিলাম কীভাবে ওদের সঙ্গে মিশবো, কী বলবো প্রথমে। কী ভীষণ প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সেদিন, মনে পড়লে হাসি পায়।’ প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের রেস্তোরাঁ। এনহফের দুই সন্তান পৌঁছে গিয়েছে। ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কমলা। কুকিজের প্যাকেট সুন্দর করে রিবন দিয়ে বেঁধেছিলেন। এলা আর কোল দু’জনেই ব্রিলিয়ান্ট। তারাই তাঁকে ঘিরে রাখবে, কমলার এই বোধের সঙ্গে জড়িয়ে রিয়েছে একাত্মতা।

রবিবার মানেই একরাশ আনন্দ নিয়ে সুন্দর সুন্দর রান্না করা। ওইদিন কিচেনের দায়িত্ব নিজের হাতে নেন কমলা। সেদিন স্বামী তাঁর হেল্পার। টেবিল সাজানো আর মিউজিক সিসটেম চালানোর দায়িত্ব কোলের। ডের্জার্টের ডিশ সাজায় এলা। উইকএন্ডে ছেলেমেয়ে কাছে না থাকলে জুম আছে ইন্সটাগ্রাম আছে।

একটি পুরুষকে ভালবাসলে তার সবকিছুকেই আপন করতে হয়। এই জায়গায় কমলা ১০০-য় ১০০।

দ্বিতীয় পর্ব

(জানুয়ারি সংখ্যার পর)

 

সুখিয়া, রিম্বি আর দিবাং সান্দাকফু যাবে। মালপত্র নিয়ে ওই লোকটা কালপোখরিতে নেমে যাওয়ায় পেছনের সিটে ওরা ভালোভাবে বসতে পারছে। ওদের গাড়ি এগোতে থাকে। কালিপোখরির ঘটনাটা  কাউকে বলে না,  ভেতরে একটা চাপা টেনশন হলেও বাইরে রাতুল স্বাভাবিক থাকে। প্রচন্ড খাঁড়াই আর এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে সবার হাড়গোড়ে যেন ব্যথা হয়ে যায়। অবশেষে ওদের গাড়ি সান্দাকফু পৌঁছায়। চারিদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দেখে সবার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ভিউ পয়েন্ট হোটেলে ওদের বুকিং থাকায় ওরা আগে সেখানে যায়, বাকি যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে নেমে যায়।

              সারা রাস্তা, বিশেষতঃ শেষ চার কিলোমিটার এতোটা চড়াইয়ের পর সান্দাকফু টপটা ছোট আর প্রায় সমতল জায়গা। হোটেল ও বাড়ি সব মিলিয়ে সাকুল্যে ১৫- ২০ টি হবে। চারিদিকে তাকালেই সুউচ্চ সব শৃঙ্গ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে খানিকটা ক্লান্তি মেটে, বাকিটা চা আর গরম গরম চিকেন পকোড়ায়। চনমনে ছয়জন তারপরই বেরিয়ে যায় হোটেলে মালপত্র রেখে । প্রথমেই ১০- ১৫ মিনিট পায়ে হেঁটে ভিউ পয়েন্ট। পরিষ্কার আকাশে সাদা তুষারাবৃত কাঞ্জনজঙ্ঘা। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার অপেক্ষায়, তার মায়াবী আলোয় রোমান্টিকতা উপচে পড়ছে।

শুভেন্দু বলে, ওয়েদার থাকলে কাল মাউন্ট এভারেস্ট দেখা যাবে ।

—- যদি তোর কথা সত্যি হয়, তাহলে আমাদের সান্দকফুতে আসা সার্থক হয়ে যাবে রে! শঙ্খ বলে।

        চতুর্দিকে যতদূর চোখ যাচ্ছে বিস্তৃত হিমালয়, পাহাড়ের কোলে অস্তগামী সূর্য, ক্রমশ গাঢ় হতে থাকা অন্ধকার, আর মন কেমনের নির্জনতা। প্রকৃতির এই আদি অমোঘ রূপে এই সদ্য যুবকেরা ডুব দিচ্ছে।

—– হ্যাঁরে রাতুল লোকটাকে লক্ষ্য করেছিস ? সায়নের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি !

——সত্যি লোকটা অদ্ভুত না ? একটা কম্বল গায়ে দিয়ে কেউ সানসেট দেখতে আসে ? দেবিপ্রো প্রশ্ন করে।

    সন্ধ্যের অন্ধকার হয়ে আসছে বলে ওরা ছয়জনই সানসেট দেখে ভিউ পয়েন্ট থেকে নামতে থাকে। রাতুল লক্ষ্য করে ওই লোকটাও ঠিক ওদের পিছু পিছু নামতে থাকছে। ব্যাপারটায় একটু খটকা লাগে। যেমন করে মানুষ চাদর মুড়ি দেয়, ঠিক তেমন করেই লোকটা কম্বল মুড়ি দিয়েছে । আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকা, মাঝখানে শুধু চোখ আর মুখটা উঁকি দিচ্ছে।

——- কম্বলম্যান মনে হয় ! শীতের জায়গায় এসেছে, কিন্তু সাথে মনে হয় বেশী একটা শীতের জামাকাপড় নিয়ে আসে নি। অগ্নিভর স্বাভাবিক ফোড়ন !

—– ওয়াও কম্বলম্যান ! উফ তোর মাথায় আসেও মাইরি, শঙ্খ বলে।

—–বেশ ঠান্ডা পড়েছে, চল হোটেলে ফেরা যাক, শুভেন্দু বলে।

—— একটু চারিদিকে ঘুরে দেখলে কেমন হয় ? এতো তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে ফ্রিজড হয়ে যাবো ? অগ্নিভর ছটফটে জিজ্ঞাসা।

—– প্লিজ হোটেলে চল, সবাই একসাথে চল। এখন কোথাও যাবি না, সব সকালে হবে । আমরা আছি

তো ! রাতুল অভিভাবকের সুরে বলে।

       রাতুলের কথা শুনে ওরা ছয়জনই হোটেলে ফিরে আসে। দেবিপ্রো গান ধরে। সায়ন টেবিল বাজায়, জমে যায় পরিবেশ। এখানে সোলার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, হোটেলগুলোতে সোলার সিস্টেমের মাধ্যমেই আলো জ্বলে। হোটেলের সুপারভাইজার ছেলেটি আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়তে হবে। হোটেলের আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে, যাতে রাতে খুব প্রয়োজন পড়লে আলো জ্বালতে পাড়ে। সান্দাকফুর কোথাও তখনো বিদ্যুতের ব্যবস্হা করা সম্ভব হয় নি, সোলারই ভরসা সব জায়গায়। এখানে  বাড়ি ও হোটেল সবই কাঠের , ছাদটা বেশী রকমের ঢালু। আসলে প্রকৃতির কথা মাথায় রেখেই এরকম ব্যবস্হা, অনেক সময়ই এখানে বরফ পড়ে । অার বরফ পড়লে যাতে গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে পারে তাই ছাদের এই ঢাল।

             অন্ধকার, সারাদিনের ক্লান্তি, তাড়াতাড়ি ডিনার করা ও সর্বোপরি প্রচন্ড ঠান্ডা, তাই ছয়জনাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো। সেই কারণে ভোর হবার অনেক আগেই উঠেও পড়লো সবাই। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখলো জলে হাত দেওয়া যাচ্ছে না, জল তো নয় যেন বরফ গলা তরল! হোটেলের ছেলেটিকে বলে মিললো অবশেষে এক বালতি গরম জল। তাই দিয়েই ফ্রেস হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো ছয়জনাই। বাইরে তখন অপূর্ব প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে নিজের আবরণ উন্মোচন করছে। ওরা ছয়জন ভিউপয়েন্টে এসে দেখলো, অনেক টুরিস্টই ওদের আগেই সেখানে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই ক্যামেরা বা মোবইল তাক করে ছবি তুলতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে ভোর হচ্ছে। আকাশের বুক চিরে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে । সবার চিৎকারে  ওরা  তাকিয়ে দেখে, আকাশের মাথায় হীরের মুকুটের  মতো মাউন্ট এভারেস্ট চকচক করছে। একদিকে মাউন্ট এভারেস্ট আর অন্যদিকে পূবাকাশে  লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে সূর্য্যিমামা। কিছুক্ষণ যেন কোনো কথা না বলে সবার সাথে বিহ্বল হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে এই নবীন যুবকের দল।

       ছটফটে অগ্নিভ আকাশের থেকে চোখ নামাতেই ফিসফিস করে বলে

ওঠে, —— কম্বলম্যান !

—– কোথায় ? রাতুল জিজ্ঞাসা করে ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই চোখ চলে যায়, বলে ওঠে, হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি !

——just গুরুত্ব নিতে চাইছে। A type of psycological problem, attention create করা। থাকে কিছু মানুষের মধ্যে, শঙ্খ বলে।

——– পাগল টাগলও হতে পারে, সায়ন বলে।

রাতুল চিন্তান্বিত স্বরে উত্তর দেয়, আমার কিন্তু সন্দেহজনক লাগছে লোকটাকে ।

       যাই হোক ওরা খানিকক্ষন ভিউপয়েন্টে ছবিটবি তোলে, তারপর নামতে থাকে। আর অদ্ভুতভাবে সবাই লক্ষ্য করে কম্বলম্যানও ওদের সাথে ভিউপয়েন্ট থেকে নামতে থাকে। রাতুলের ব্যাপারটা ভালো ঠেকে না। সবাই হোটেলে ফিরে আসে, রাহুল হোটেলের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে লক্ষ্য করে কম্বলম্যান পাশের হোটেলের একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের হোটেলর দিকে চোখ রাখছে।

বেশ চিন্তায় পড়ে যায় রাতুল, বন্ধুদের জানাবে কিনা ভাবে। এটা সেই বস্তার জের নয় তো !!! কি ছিল আসলে বস্তায় ???

          এভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর একটা ল্যান্ডরোভার নামে ওই হোটেলের সামনে।  ল্যান্ডরোভারের ড্রাইভার নেমে সেই কম্বলম্যানের কাঁধে হাত দিয়ে, পাশের হোটেলের ভিতর ঢুকে যায় দুজনাই। রাতুল একবারের জন্যও হোটেল থেকে চোখ সরায় না। ১০ – ১৫ মিনিট বাদে সেই ড্রাইভারের সাথে আরো তিনজন এসে ওঠে ল্যান্ডরোভারে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওরা ল্যান্ডরোভার নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। এই দুইদিনে কম্বলম্যানের চোখ আর মুখের সামান্যই রাতুল দেখেছে। অার এতো দ্রুত ওই চারজন গাড়িতে উঠে চলে গেল যে কারুর মুখই ভালো করে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সব ব্যাপাটাই একটু রহস্যজনক মনে হয়, সব বন্ধুদের সবটা জানানো উচিত মনে হওয়ায় রাতুল রুমে ঢোকে, বাকিরা সেখানে আড্ডা দিচ্ছিল। রাতুল সবাইকে সান্দাকফু আসার সময় কালিপোখরিতে গাড়ির বস্তারহস্যের ঘটনাটা সবিস্তারে জানায়। রাতুল যখন ঘটনাটা বলছে তখনই শুভেন্দু গুগল সার্চ করতে থাকে। তারপর জানায়—

 সান্দাকফুতে তো কোনো ঝামেলা বা পুলিশি রিপোর্ট নেই তো দেখছি। এমনিতেই এলাকার মানুষ খুব শান্তিপ্রিয়। স্হানীয় অধিবাসীর সংখ্যাও খুব কমই। তবে এখানে দেখছি, শিলিগুড়ি পাচার চক্রের কড়িডর হিসাবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হচ্ছে।

—– কি পাচার হয় ? সায়ন জিজ্ঞাসা করে।

——mainly drugs. এছাড়া কিছু বিদেশী মালপত্র। শুভেন্দু বলে।

——-সাপ ? ময়াল বা অজগর এরকম কিছু ? বা কচ্ছপ ? রাতুল জিজ্ঞাসা করে।

—– প্রাণী ? তোর কি বস্তার ভেতরের জিনিষকে প্রাণী বলে মনে হয়েছে? তোর ধারণা আছে ? একটা ময়াল বা অজগর কত ভারী হয় ! বস্তায় করে এদের পাচার কখনোই সম্ভব নয় ।শুভেন্দু বলে।

—— দেখ তেমন কিছুই নয় হয়তো। বেকারই ভয় পাচ্ছিস। অগ্নিভ বলে।

——– দেখ অগ্নিভ, তেমন কিছু না হলে লোকটা আমার গলা টিপে ধরে ভয় দেখাতো না। রাতুল বলে।

——-শোন, কোনো ঝুটঝামেলায় জড়াবি না। দুটোদিন থেকে আমরা চলে যাবো এখান থেকে। বেড়াতে এসেছি আমরা সবাই, ঘুরবো ফিরবো ব্যাস। নো কৌতুহল !!! শঙ্খর সতর্কবাণী।

—— একবার কি বাবাকে জানিয়ে রাখবো? যদি লোকাল থানায় ইনফর্ম করে রাখে, দেবিপ্রো জিজ্ঞাসা করে  সবাইকেই। দেবিপ্রোর বাবা পুলিশের উচ্চপদস্হ আধিকারিক।

——- না না কাকুকে জানানোর দরকার নেই, কাকু বেকার চিন্তা করবেন। সায়ন বলে।

—– জানালে হয় না ? কে জানে যদি কোনো বিপদ আপদ হয় !! অগ্নিভ বলে।

——- বেশ ভয়ই লাগছে, শঙ্খ জানায়।

——- জানালে কি জানাবো ? কি জানি আমরা ? আন্দাজে কিছু বলা ঠিক হবে কি ? রাতুলের চিন্তান্বিত স্বর।

——- কেন, আমার কম্বলম্যান আবিস্কার ? অগ্নিভর কথায় একসাথে সবাই হেসে ওঠে।

—— মনে হচ্ছে কম্বলম্যান সান্ডাকফু ছেড়ে চলে গেছে। রাতুল বলে।

—– তোকে কে বললো ? জানলি কি করে ? সায়ন বলে।

—— একটু আগে কম্বলম্যানকে ফলো করছিলাম বারান্দা থেকে। একটা ল্যান্ডরোভারে করে পাশের হোটেল থেকে চারজন বেরিয়ে গেল, ওদের মধ্যে কম্বলম্যানও ছিল বলে মনে হোলো, রাতুলের দৃঢ় উত্তর।

—— যাক গেলেই ভালো, লোকটাকে ভালো ঠেকছিল না মোটেই। কেমন যেন সন্দেহজনক চালচলন। তারপর তোর ওই বস্তার কাহিনী, নিঃসন্দেহে স্মাগলিং এর জিনিষপত্র ছিল, অগ্নিভ বলে।

——- কি ঝামেলা রে বাবা , শঙ্খ বিরক্তিতে বলে। কেন যে তুই বস্তাটা দেখতে গেলি ? কোনো কি দরকার ছিল ? বেশী ওস্তাদি !

—— যাক যা হয়ে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবে না ! সামনের দিকে কি হয় সেটা দেখা যাক। শুভেন্দু বলে।

—— আর তো কালকের দিনটা শুধু, তারপর তো নেমেই যাচ্ছি । দেবিপ্রো বলে।

ইতিমধ্যে হোটেল থেকে ব্রেকফাস্টের ডাক পড়লো, আর ওদের আলোচনাও থামলো তখনকার মতো। ব্রেকফাস্ট করে ওরা একটু হাঁটাহাটি করতে বেরোলো। সান্দাকফু টপটা খুব একটা বড়ো না, মনে হয় হেঁটেই পুরোটা ঘোরা হয়ে যাবে। এই সময়ে অনেক টুরিস্ট আসে এখানে, সবাই ঘোরাঘুরি করছে এদিকে সেদিকে। এরকমই ঘুরতে ঘুরতে রিম্বির সাথে দেখা হয়ে গেল। সেও মনে হয়, এখানকার কোনো হোটেলে কাজ করে। দেখা হতেই হেসে কুশল বিনিময় হয়ে গেল। ঘোরাঘুরি করতে করতে একটা নিরিবিলি জায়গায় রাতুল দেখলো চার পাঁচটা বস্তা রাখা। দেখতে শুনতে এই বস্তাগুলির সাথে কালিপোখরিতে নেমে যাওয়া বস্তাগুলির মিল আছে। বস্তাগুলি দেখে রাতুলের বেশ সন্দেহই হোলো। সবাইকে ওদিকে যেতে নিষেধ করলো। ওরা ফিরে যেতে যাবে এমন সময় একটা ল্যান্ডরোভারকে বস্তাগুলোর কাছে দাঁড়াতে দেখলো ওরা। গাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে ল্যান্ডরোভারে বস্তাগুলি তুললো। ওদের বস্তা তোলা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, বস্তাগুলি বেশ ভারী।  কাউকে পাত্তা না দিয়ে ল্যান্ডরোভার নিজের মতো করে বেরিয়ে গেল। ওরা আরো এদিকে ওদিকে ঘুরতে লাগলো। ইচ্ছে করেই রাতুল ওদের থেকে দলছুট হয়ে গেল। রাতুল একা এলো ওইজায়গায়  যেখানে বস্তাগুলি রাখা ছিল। খুব মন দিয়ে খেয়াল করলো জায়গাটা। এমনি বস্তা রাখার দাগ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। এর থেকে কিছু বোঝা যায় না, কি আছে বস্তায় ?  রাতুল মনে মনে ভাবতে লাগলো, কালিপোখরিতে যে বস্তা নামল, সেই বস্তা আর এই বস্তা কি এক ? কি ছিল বস্তায় ? খোঁচা খোঁচা, শক্ত কাঁটাওয়ালা কিছু ! বোঁটকা গন্ধ নাকে এসেছিল তখন বস্তা থেকে। মনে হাজারো প্রশ্ন ভীড় করতে থাকে। দুপুরে লাঞ্চ করতে হবে, তাই হোটেলের দিকে পা বাড়ায় রাতুল।

        হোটেলের বাইরে সবাই অপেক্ষা করছিল, ওকে দেখেই আস্বস্ত হলো, কি চিন্তা হচ্ছিল তোদেরকে নিয়ে ! সায়ন বললো, দেবিপ্রো কোথায় ?

—- দেবিপ্রো ? কই ও আমার সাথে ছিল না তো ? রাতুল স্বাভাবিকভাবেই বলে।

—– সেকিরে ? তোকে আর দেবিপ্রোকেই তো খুঁজে পাচ্ছিলাম না! শুভেন্দুর ভীতু প্রশ্ন।

—— তোর সাথে দেবিপ্রো ছিল না ? শঙ্খ জিজ্ঞাসা করে।

—– না, আমি তো একাই ছিলাম, আমার সাথে কেউই ছিল না। রাতুল বলে।

——- হয়তো এদিক ওদিক ঘুরছে, চলে আসবে এক্ষুণি হয়তো, সায়ন বলে।

——হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস , বাচ্চা ছেলে তো নয়, যে হারিয়ে যাবে ? বেকারও আমরা টেনশন করছি। শুভেন্দু বলে।

        এক একটা মুহূর্ত যেন কাটতে চাইছিল না। এরকম করে হোটেলের বাইরে একঘন্টারও ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও দেবিপ্রো এলো না। ওরা পাঁচজন তখন ভাগ করে করে পুরো সান্দাকফুতে দেবিপ্রোকে খুঁজতে লাগলো। ফোনে নট রিচেবল দেখাচ্ছে। সবার লাঞ্চ করা মাথায় উঠলো।

             দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো, কোথাও দেবিপ্রোকে পাওয়া গেল না। শঙ্খ ভয়ে, আতঙ্কে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।

 আর কোনো উপায় না দেখে বাধ্য হয়েই ওরা দেবিপ্রোর বাবাকে খবর দিলো। ওপার থেকে ফোনে উৎকন্ঠিত, সন্ত্রস্ত, ভীত কন্ঠস্বর শুনে ওদেরও ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।

কি হোলো দেবিপ্রোর ? কোনো সাংঘাতিক বিপদ !! ঠিক আছে তো ও ? বেঁচে আছে তো !! এই সব কু চিন্তায় সবার তখন সাংঘাতিক অবস্হা।

(এরপর  পরের সংখ্যায়)

♦ সম্পাদকের কথা ♦

একটা সাংঘাতিক সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। কবে এর থেকে নিস্তার পাবো তারও নিশ্চয়তা নেই। এর জন্যে অঙ্কুরোদ্গমের বহু কাজ আটকে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সে সব কাজ করা যাচ্ছে না বলে বিকল্প পন্থা হিসেবে শুরু হল কলকাতা অঙ্কুরোদ্গম-এর এই ওয়েব ম্যাগাজিন। এবার থেকে নিয়মিত এই পত্রিকা চলতে থাকবে। এবং ক্রমেই রূপায়িত হবে আমাদের নির্ধারিত পরিকল্পনাগুলি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা নিশ্চয়ই ফিরবো আমাদের বকেয়া সমস্ত কর্মসূচিতে। পুরোনো বছরগুলিতে আমরা যে ভাবে উদ্যোগী হয়েছি তার সঙ্গে যুক্ত হবে আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে আমাদের আদর্শ মেনে নতুন প্রতিভার অনুসন্ধান চলতে থাকবে। আশাকরি, অঙ্কুরোদ্গম-এর সদস্যদের সহযোগিতা পাবো।

সম্পাদক : নমিতা দাশ

সহযোগী সম্পাদক : চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়

সম্পাদকের কথা

সুসম্পর্কই অঙ্কুরোদ্গম-এর আকর তাপস মহাপাত্র

গুচ্ছকবিতা সৈয়দ হাসমত জালাল

প্রবন্ধ অরিন্দম দেব

ধারাবাহিক উপন্যাস নমিতা দাশ

কবিতা
…………

আর্যতীর্থ
দিশা চট্টোপাধ্যায়
মিঠুন চক্রবর্তী
লিপিকা চট্টোপাধ্যায়
প্রতাপ সিংহ
দীপান্বিতা হক
দীপশিখা চক্রবর্তী
সুদিন বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রাবণী বসু
ইলা কারকাট্টা
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

গল্প

দেবদাস কুণ্ডু

কবিতা
………
প্রবীর কুমার দত্ত
মধুমিতা ঘোষ
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
অমিত চৌধুরী
আলো চৌধুরী
চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়
মৈত্রী বড়ুয়া
অনুশ্রী রায়
দেবন্বিতা চক্রবর্তী
সোমা বৈদ্য
সুস্মিতা দাস

গল্প 

পারমিতা চ্যাটার্জী
এবং আইভি দত্ত

সবাইকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় আগলে রেখে অঙ্কুরোদ্গম-এর এগিয়ে চলার আসল রসদই হল  আন্তরিকতা। আমরা মনে করি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অঞ্চলভিত্তিক দূরত্ব ও বৈষম্য থাকা উচিত নয়। কারণ, মননশীলতার ক্ষেত্রে এটা প্রকৃতি ও আদর্শ বিরোধী। যার ফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হয় একটি জাতির ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি এবং সময়ের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা।আমাদের এই বোধ সর্বজনীন।তাই আমরা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছি প্রতিদিন।

     এই সত্যকে মাথায় রেখে- বস্তুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ও নগর কলকাতার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে বাঁধতে চাই এক সূত্রে। এই সমন্বয়ের মঞ্চের পরিচিত নাম- অঙ্কুরোদ্গম। আমরা চাইছি, এমন একটি একত্রিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক শক্তি, যাতে বাংলা সাহিত্যের প্রসার মসৃণ হয়। ভাবনার আদানপ্রদান এবং তার গতিধারা সময়োপযোগী হলে এই দুই ক্ষেত্রে আমরা উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারি।

      এই ভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি আমাদের জাতিসত্ত্বার গর্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। কারণ, বাংলাভাষা ও তার সংস্কৃতি আটকে পড়েছে এক সংকটকালে। অথচ অস্বীকার করা যায় না যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি  ছাড়া ভাষার যেমন উৎকর্ষতা বাড়ে না বা অবনমন রোধ করা যায় না তেমনি একটি জাতির সামাজিক আচরণও বিপথগামী হয়।

বাংলার উন্নত সাহিত্য ও সংস্কৃতি এই দুই ক্ষেত্রে যে কোনো বিরুদ্ধ অনুপ্রবেশকে রুখতে পারে। বিশ্বায়নের হাত ধরে যে বহিরাগত রুচি ও আর্থ-সামাজিক জীবনধারা বাঙালির ঐতিহ্যকে টলিয়ে দিতে চাইছে তাতে বাংলার সুশীল সমাজকে অনেক বেশী সচেতন হতে হবে। কারণ, তাদের হাতেই সমগ্র বাঙালী জাতির রক্ষাকবচ। বিশ্বায়নের হাত ধরে যে  পণ্যসংস্কৃতি আমাদের ধ্রুপদী সত্ত্বাকে বিবশ করতে চাইছে, তা আধুনিকতার নামে লোভনীয়। কিন্তু বাজার দখলের নামে বাঙালীর জাতির সত্ত্বাকে বিপন্ন করার যে কৌশল চলছে তাকে রোখা দরকার।

আধুনিকতা মানে নিজেদের অস্তিত্ত্ব বদলে দেওয়া নয়। যা নিজেদের উপযোগী তা অটুট রাখা, যা পরিমার্জনীয় তাকে অন্যের ভালোর সঙ্গে যোগ্যভাবে মিলিয়ে এক সামঞ্জস্য বজায় রাখাই প্রকৃত আধুনিকতা। তা না হলে সাংস্কৃতিক পরাধীনতার মধ্য দিয়ে একটি জাতিসত্ত্বা তার স্বাধীন আদর্শ হারায়। একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বে বছরে অন্তত ১২০০ জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হচ্ছে, কারণ সময়ের সঙ্গে তারা তাল মেলাতে পারছে না। এই লড়াইয়ে একটি জাতির কাছে প্রধান অস্ত্র হল তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। আমাদের জাত্যভিমান টিকিয়ে রাখতে গেলে এই দুই অস্ত্রে ধার দিতে হবে। তা না হলে গতির মুখোমুখি হওয়া যায় না।

     তাই অঙ্কুরোদ্গম চায়, বাংলাভাষীদের মধ্য থেকে যোগ্য লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তুলে আনতে, কারণ তাঁদের হাতেই বাংলার ভবিষ্যৎ। তিনি যেখানেই সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতিক চর্চা করুন না কেন তাঁদের কীর্তি সকলের সামনে তুলে ধরা এবং যোগ্য মর্যাদা দেওয়া দরকার। অঙ্কুরোদ্গম-এর লক্ষ্য- উন্নত সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ও তার প্রসার।

ইদানিং সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে একটা হাস্যকর প্রবণতা খুব চোখে পড়ে। দেখা যাচ্ছে, যে কোনো ভাবেই হোক  সাহিত্য রচনায় নিজেদের শিক্ষিত ও আধুনিক প্রমাণের জন্য কিছু বিদেশি শব্দ ব্যবহার করছেন অনেকেই। তাঁরা বোঝেন না, এটা কতটা তাঁদের ভাষাগত দৈন্যতার প্রকাশ। 

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং পরবর্তীকালে- বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ দাশ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্য-মনীষীদের মধ্যে কি আমরা কখনো এই  প্রবণতা দেখেছি ? নাকি বাংলা ছাড়া তাঁদের আর কোনো ভাষায় দখল ছিল না  বাংলা সাহিত্যের প্রাণ ও ঐতিহ্য তার ভাষার ভান্ডারে যথেষ্টই। যার জন্য পৃথিবীর ভাষা মানচিত্রে বাংলার স্থান মর্যাদার নিরিখে অন্য যে কোনো জাতির কাছে একটি দৃষ্টান্ত। পৃথিবীতে অন্তত ৩০ কোটি বাংলাভাষী রয়েছেন। যা সমগ্র আমেরিকার জনসংখ্যার প্রায় সমান। অথচ বাংলা ভাষায় সাহিত্য করতে এসে বাংলা ভাষাকেই যাঁরা যথেষ্ট মনে করছেন না তাঁদের কাছে বাঙালীর জাত্যভিমান আশা করা ঠিক নয়।

অঙ্কুরোদ্গম মনে করে, প্রচলিত আঞ্চলিক বাংলা ভাষার মধ্যে আছে বাংলার প্রকৃত প্রাণ। তার মধ্যে রয়েছে বাংলার অকৃত্রিম সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক চিত্র। এই সব শব্দকে আঞ্চলিক গন্ডিতে বেঁধে না রেখে মান্য বাংলার মূল স্রোতে আনলে বাংলার সাহিত্য ও তার শব্দ ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলা জাতির প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। বিভূতি-মানিক-তারাশংকর- এই তিন বন্দ্যোপাধায়ের সাহিত্য কর্মে যে ধ্রুপদী বাংলা আমরা দেখেছি এবং সাম্প্রতিক কালে যা দেখছি নলিনী বেরার কলমে তা সমগ্র বাংলা জাতির কাছে গৌরবময়। তাই মান্য বাংলার নামে যে পন্য বাংলাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার থেকে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিকে রক্ষা করার বেশী সময় আর নেই। এই সচেতনতা তুলে ধরার জন্য সারা বাংলা জুড়ে কাজ করে চলেছে অঙ্কুরোদ্গম।

এ জন্যই প্রতিটি আঞ্চলিক বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেবে অঙ্কুরোদ্গম। এবং বাংলা ভাষার ভিন্নতার মধ্যে সামঞ্জস্য তুলে এনে একটি সর্বজনীন বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করা হবে। যাতে এই নতুন ঘরানায় লিখিত বাংলা সাহিত্য ভবিষ্যতে ঔপনিবেশিক দাসত্বমুক্ত হতে পারে। এই জন্য সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অঞ্চলভিত্তিক দূরত্ব ও বৈষম্য দূর করা উচিত। কারণ, মননশীলতার ক্ষেত্রে এটা প্রকৃতি ও আদর্শ বিরোধী। যার ফলে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতি হয় একটি জাতির ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি এবং সময়ের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা। 

এই লক্ষ্যে অঙ্কুরোদ্গম সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সকলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি এবং একটি সম্মিলিত মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে অঙ্কুরোদ্গম। যার নাম ‘বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সমন্বয় মঞ্চ’। আমাদের আশা,  অঙ্কুরোদ্গমে, প্রচলিত বাংলা ভাষার মাধ্যমে একদিন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সামগ্রিক বাংলার স্পন্দন উঠে আসবে। 

        অঙ্কুরোদ্গম মনে করে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অঞ্চল ভিত্তিক দূরত্ব ও বৈষম্য থাকা উচিত নয়। কারণ, মননশীলতার ক্ষেত্রে এটা প্রকৃতি ও আদর্শ বিরোধী। যার ফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হয় একটি জাতির ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি এবং সময়ের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা।

দায়মুক্ত বা ফরমায়েসি বাংলা সাহিত্য চর্চা থেকে প্রকৃত বাংলা সাহিত্যকে বাঁচাতে লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে আরও  দায়িত্বশীল হওয়ার আবেদন জানাচ্ছে অঙ্কুরোদ্গম। কোনো প্রতিষ্ঠানিক বাংলা পত্রপত্রিকার পক্ষে মুনাফার কারণে এই দায়িত্ব মেনে চলা সম্ভব নয়। লিটল ম্যাগাজিনের অন্যান্য আদর্শের মধ্যে বানিজ্যধর্মী না হওয়াটা একটা বড়ো কারণ। তাই লেখা ছেপে পত্রিকা বিক্রির চেষ্টা থেকে বেরিয়ে এসে ছাপার যোগ্য লেখা মনোনয়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত। যে কোনো ভাবে একটি পত্রিকা বের করে সম্পাদক হওয়ার বাসনা পূরণ করতে চাইলে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র হারায়।

লেখা সম্পাদনা করার দক্ষতা যেমন সম্পাদকের থাকা চাই, তেমনি বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিগত ধারণাও। বাংলা ভাষায় লিটিল ম্যাগাজিনের অভাব নেই। এই সব পত্রিকার সম্পাদক যদি তাঁর পত্রিকায় অন্তত একজন উপযুক্ত সাহিত্যিক তৈরি করার দায়িত্ব নেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের গৌরব কখনোই ম্লান হয় না। কিন্তু এত পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও আমরা হাতে গোনা কয়েকজন দক্ষ সাহিত্যিক খুঁজে পাই। আমরা মনে করি, যে কয়েকজন সাহিত্যিককের পরিচয় আমরা পাই সেটাই প্রকৃত নয়। এর বাইরে অনেক শক্তিশালী লেখক আছেন যাঁরা প্রচারের আলোয় আসতে পারছেন না। অনেকক্ষেত্রে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই যাঁরা সত্যিকারের ভালো লিখছেন তাঁদের যেমন তুলে আনা দরকার তেমনি আগামী প্রজন্মের কাজটিও চালিয়ে যেতে হবে। আগ্রহী লেখকদের উৎসাহ ও পরিণত হওয়ার সঠিক পথ দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনগুলিরই সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। সেই সঙ্গে অঙ্কুরোদ্গম-এর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সদস্যরা যাতে তাঁদের লেখায় এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতার বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেন সে ব্যাপারেও অনুপ্রাণিত করা হবে।

প্রতিটি জেলাকেন্দ্রে বাংলা সাহিত্যের সব ধরণের লিটল ম্যাগাজিন রাখার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। যাতে দূর দূরান্তের পত্রিকাগুলি সহজলভ্য হয়। লেখকরা যেমন সংগ্রহ করতে পারবেন, তেমনি উৎসাহীরা হাতের কাছে পাবেন তাঁর প্রয়োজনীয় পত্রিকাটি। এর ফলে পত্রিকাগুলি যেমন প্রচার পাবে, সেই সঙ্গে লেখকরাও পত্রিকার খোঁজ পাবেন। সে জন্য অঙ্কুরোদ্গম লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালায় নিয়মিত পত্রিকা পাঠানোর আবেদন জানানো হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের।

যাঁরা অন্তর থেকে সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায় চর্চা করতে চান, যাঁদের ভাবনা আছে, লক্ষ্য আছে, দার্শনিক অনুসন্ধান আছে, অথচ ধরণধারণের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রকাশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তাঁদের উপযুক্ত তালিম দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চায় অঙ্কুরোদ্গম। আমাদের যাঁরা সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞ আছেন তাঁরা নিয়মিত কর্মশালা করবেন জেলায় জেলায়। এতে উপকৃত হবেন আগ্রহী সাহিত্যানুরাগীরা।

সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ধারাগুলি কেউ কারুর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং এগুলি সামগ্রিক মননশীলতার এক একটি অংশ। একে অপরের সঙ্গে জড়িত। তাই এগুলির মধ্যে সামন্বয় থাকলে উপকৃত হবেন প্রত্যেকে। অঙ্কুরোদ্গম চায়, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে যে পক্ষপাত এবং পৃথক পৃথক অস্তিত্বের যে রক্ষণশীল মনোভাব দেখা দিচ্ছে তার থকে বেরিয়ে এসে একটি যৌথ সুশীল সমাজ গড়তে।

          অঙ্কুরোদ্গম চায় সুসম্পর্ক, যাতে গড়ে উঠতে পারে একটি দৃষ্টান্তমূলক বাংলাভাষী সুশীল সমাজ। সেখানে বিভেদ নয়, স্বার্থপরতা নয়, তোষামোদ নয়। মুক্ত মন আর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চেতনাই হবে এই সম্পর্কের সেতু। আগেই আমরা জানিয়েছি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদর্শই হল সম্পর্ক। আমরা বাংলা ও বাংলার বাইরে সমস্ত বিচ্ছিন্ন লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, যাতে আগামী দিনে একটি সুস্থ সৃষ্টিশীল আবহ গড়ে ওঠে। এজন্যই অঙ্কুরোদ্গম-এর এই মিলন সভার নাম- বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সমন্বয় মঞ্চ।

এই মঞ্চকে সবদিক থকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আমরা চাইছি একটি সম্মিলিত ভাবনা। তাই আহ্বান জানাচ্ছি  বাংলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে সমস্ত গোষ্ঠী এবং সংগঠকদের। অঙ্কুরোদ্গম-এর সদস্যদের মধ্যে লেখক সংযোগ উন্নত করতে সংগঠনের সাময়িক মুখপত্র শুরু হল। আমরা চাইছি পত্রিকাটিতে পেশাদারী ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করতে, কিন্তু তা কোনো ভাবেই বাণিজ্যিক নয়। যদি পত্রিকা থেকে আয় হয় তাহলে তা খরচ করা হবে দুঃস্থ এবং সম্ভাবনাময় লেখকের জন্য। সেই সঙ্গে  নবীন লেখক ও শিল্পীরা যাতে দুষ্টচক্রের দ্বারা প্ররোচিত না হন সেদিকে নজর রাখবে ‘অঙ্কুরোদ্গম’  আমরা কিছুতেই নবীন লেখক এবং শিল্পীদের আবেগকে প্ররোচিত হতে দেব না। বরং তাঁদের আগ্রহকে পরিণত করতে চাই।  শুধু এই নয়, ছোটোবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চায় অঙ্কুরোদ্গম। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক বই বিনামূল্যে বিতরণ করবে। এর জন্য প্রতিটি জেলায়, যেখানে অঙ্কুরোদ্গম সাংগঠনিক ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করবে সেখানে নির্দিষ্ট ‘বই ব্যাঙ্ক’ গড়ে তুলবে। এই উদ্যোগে প্রকাশক ও লেখকদের আহ্বান জানানো হচ্ছে। যাতে তাঁদের প্রকাশিত একটি করে বই দিয়ে এই ‘বই ব্যাঙ্ক’ তৈরিতে সহযোগিতা করেন।

আমাদের আহ্ববানে বাংলার চর্চিত সুশীল সমাজ এগিয়ে আসবে এই বিশ্বাস রাখে ‘অঙ্কুরোদ্গম।

সৈয়দ হাসমত জালাল-এর কবিতা

১.

কস্তুরীগন্ধ

কবিতার উৎসব-প্রাঙ্গণে বসে আছি অবেলায়

পাশে এক সোনার হরিণ

কস্তুরীগন্ধে ম-ম করছে চারপাশ

আমার না-লেখা পঙক্তিগুলির ভেতর

গড়িয়ে নামছে অঘ্রাণ-গোধূলির আলো

               মর্মছেঁড়া স্বগত উচ্চারণ

একেই কি রক্তক্ষরণ বলে জেনেছি এতকাল!

আমাকে ডাকছে এক রোগা আনমনা নদী

চরে তার মৃত কাশফুল ঝরে পড়ে আছে

এক ক্ষুধাতুর ধূসরতা ক্রমশ ব্যাপ্ত হচ্ছে

                         মানচিত্র জুড়ে

অন্ধকারের কলহাস্য কাঁপিয়ে দিচ্ছে পায়ের তলার মাটি


আর আমি স্তব্ধ পাথর, বসে আছি কবিতার

                          উৎসব-প্রাঙ্গণে

পাশে এক সোনার হরিণ

কস্তুরীগন্ধে ম-ম করছে চারপাশ

২.

অন্ধকার

আমি অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলছি

খুব নিচুস্বরে

চিৎকারহীন অশ্রুফোঁটার শব্দের মতো,

আমার শিরদাঁড়ার ভেতর বয়ে যাওয়া

           ফিসফাস বাতাসের মতো

আমি কথা বলছি অন্ধকারের সঙ্গে

একটি শব্দের বীজ কবে ঢুকে গিয়েছিল

আমার মাথার ভেতর

তা-ই আজ রাশি রাশি মৌমাছির মতো অক্ষরগুঞ্জন

কোটি কোটি কথার ডানা ঝাপটানি

তার শাখা-প্রশাখায় আগুনশিখার নাচ,

সন্ত্রস্ত পাখিজন্মের প্রাণিজন্মের মতো

                   কত দৃশ্যের জন্ম দেখেছি

পৃথিবীর সব উপাসনাগৃহে জটলা করছে অন্ধের দল

পথে পথে মানুষের সমবেত কণ্ঠ ক্রমে

                           মূক হয়ে আসে

ঘুমের ভেতর উঠে আসে নিকষ অন্ধকার

আমি অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলছি

ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তের নিবিষ্ট ভাষায়

আর গ্রীষ্মরাত্রির বাতাসে দুলছে স্তব্ধ গমক্ষেত

শুধু এই আজন্ম ভূমিটুকু ছাড়া

                    আর কী স্বপ্ন আছে আমাদের

তির্যক বল্লমের মতো একফালি ভোরের

                                আলোটুকু ছাড়া!

৩.

ভারত


অনাহারে কেটে যায় আমাদের দিন, সুদীর্ঘ রাত

অন্তহীন ঘরে ফেরবার পথও,

কিছু কি চেয়েছি!

তবু আমাদের শুধু তাড়া করে ফেরো

             তোমাদের হাতে হাতে লাঠিও সমুদ্যত


 কি আমাদের দেশ নয়?

কেন এত ভয়?  কোন খেয়াল

                      তোমাদের রাজা-উজিরের?

সন্ধ্যা নামলে তুলে দাও নিষেধের আঁধার-দেয়াল!

দেশের ভেতরে জমছে নিকষ অন্ধকার

দেখে না তা তোমাদের অন্ধ দু-চোখ

আমরাই গড়ি ইতিহাস

এইবার তবে ভাঙবার খেলা শুরু হোক!


 রাজা, মন্ত্রীমশাই,

তোমাদের দেহে কাকতাড়ুয়ার সাজ,

কী আর কেড়ে নেবে আজ?

লক্ষ বছর হেঁটে চলা দুটি পা, আর আছে

                  রোদপোড়া এই দুটি হাত

অনাহারে কেটে যায় আমাদের দিন, সুদীর্ঘ রাত

তবুও বেঁচে থাকি ঠিক, হাজার পরাজয়ে তবু

বেঁচে উঠি রোজ

আমরাই প্রকৃত ভারত, প্রভু

আমাদের মুছে ফেলা এতই সহজ!

৪.

শুশ্রূষা


মাঝে মাঝে চুপ করে থাকি

 অবস্থান বস্তুত বাহ্যিক,

ভেতরে সহস্র কথার স্রোত ঢেকে রাখি

 দূরতা, জেনো, শুধু শারীরিক


দেশে দেশে মৃত্যুর ছায়াপাত

অসুখের বীজ শ্বাস-প্রশ্বাসে,

আমাদেরও গ্রাস করে নেবে ভয়?

আমাদের মাঝখানে ত্রস্ত শূন্যতা ভাসে?

মানি না,  দূরতা সামাজিক নয়

রাতশেষে যেমন দাঁড়ায় নিঃশঙ্ক ঊষা

তেমনি দাঁড়াও এসে আমার হৃদয়ের কাছে

যেখানে সহস্র মানুষ আছে, আনন্দ-শুশ্রূষা!

রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।  তার স্বীয় গীতাঞ্জলির অনুবাদের, নিজস্ব বাছাই করা ১০৩ টি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ তিনি নিজেই করেন, যা তাঁর মোট নয়টি পত্রিকা থেকে সংকলিত হয়। গীতাঞ্জলির অনুবাদ ( Song Offerings) প্রকাশকাল ১৯১২ সাল।তার পূর্বে অন্য অনুবাদকের দ্বারা রবীন্দ্রনাথের রচনার ইংরেজি অনুবাদ, কেবলমাত্র “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য  থেকে, কিছু প্রবন্ধ আজ পাওয়া যায়, যা ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়।

এরপর, প্রায় একযুগ ধরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের রচনা একাই অনুবাদ করতে থাকেন। কেবল ১৯২২ সালের পরেই, অন্যের অনুদিত রবীন্দ্ররচনা ও কবিতা একের পর এক বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২২ থেকে ১৯৪৭ অবধি, মোট বারোটি অনুবাদ গ্রন্থ, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়, যার মাঝে কবিগুরুর নিজস্ব অনুবাদ কেবলমাত্র ছয়টি!

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে, ১৯৪৭ থেকে ২০১২ সাল অবধি অনুদিত রবীন্দ্র রচনার মোট ৫৫টি গ্রন্থ, বিভিন্ন অনুবাদক দ্বারা প্রকাশ পায়। এর মাঝে আছে কিছু রবীন্দ্রগ্রন্থ সমালোচনা এবং তাঁর নিজস্ব সাহিত্য গ্রন্থ পর্যালোচনার ইংরেজি অনুবাদ ।

একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা, কোনো কবির কবিতার অনুবাদে,যে ব্যক্তি ভাষান্তরটি করেন, রবীন্দ্রকাব্য অনুবাদেই ,তাঁকে সর্বাপেক্ষা কাঠিন্য অনুভব করতে হয়। অনুবাদকের ভাষাজ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের গভীরতা, যতই থাকুক না কেন, কবির শব্দচয়ন ও ছন্দে ভাবপ্রকাশ, অনুবাদ বা ভাষান্তরে একেবারে অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে যায় বলা চলে।

একজন অনুবাদক তাঁর রবীন্দ্রকবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে কবিগুরুর কাব্যের অনুবাদ প্রয়াসে, মূল কবিতার ভাবের অনিচ্ছাকৃত অদল বদল হওয়াতে, তাঁর এ প্রয়াসটা কবির কাব্যমর্যাদা ক্ষুণ্ণই করেছে, এক প্রকার বলা চলে।

প্রায় আট দশক ধরে তাঁর কাব্য ও রচনা অনুদিত হয়ে চলেছে। কোনো কোনো ভাষান্তরবিদ তথা অনুবাদক স্বীকার করেন, তারা কবির ভাবধারা ধরে রাখতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হতে ব্যর্থ হয়েছেন, আবার অন্য কেউ, তাঁদের স্বীয় অনুবাদ প্রয়াস নিয়ে বলেছেন যে তাঁদের কাজ, কবির মূল রচনার সমস্ত উৎকৃষ্টতা, যথাযথ মর্যাদাতেই ব্যক্ত করতে পেরেছেন বটে!

অঁদ্রে লফেভেয়্যর নামক এক ফরাসী ভাষাবিদের মতে, কবির সে সকল অনুবাদই সমগ্র পৃথিবীর পাঠককূলে গৃহীত হতে পেরেছে ( অর্থাৎ কালজয়ী হতে পেরেছে), যা কবির বানীকে সুস্পষ্টরূপে দেশ  কাল  সীমা  সংস্কৃতি  সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বেড়াজাল টপকে পাঠকহৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে।

তাই, যে কোনো কবিতাই, বা যে কোনো কাব্যসৃষ্টার রচনাই হোক না কেন, কাব্যিক উৎকর্ষ ক্ষুণ্ন হলে, কবির ভাবধারার বা ভাবাধারের সঠিক মূল্যায়নে কিন্তু বিশ্বপাঠক বঞ্চিত হন, তাই অনুবাদককে কবির মূল রচনার মান ও উৎকৃষ্টতা অবশ্যই মাথাতে রাখতে হবে।

১৯১২ থেকে ১৯২১, এ সময়কালে কবিগুরু, তাঁর নিজস্ব অনুদিত ছয়টি কাব্যগ্রন্থের সংকলন প্রকাশ করেন।

১] GITANJALI – SONG OFFERINGS (1912)

২] THE GARDENER (1913)

৩] THE CRESCENT MOON (1913)

৪] FRUIT GATHERING (1916)

৫] THE LOVER’S GIFTS AND CROSSINGS (1918)

৬] THE FUGITIVE (1921)

৭] GITANJALI ( SONG OFFERINGS) প্রসঙ্গেঃ-

১৯১২ সালে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হবার পরপরই জনপ্রিয়তার সার্থকতায় সমগ্র বিশ্বে এতটাই সাড়া ফেলে দেয় যে এক বছরের মধ্যেই এটির ১৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে, নিঃশেষ হয়। এর ফলস্বরূপ ১৯১৩ সালে, প্রথম এশিয়াবাসীরূপে কবিগুরু সাহিত্যে নোবেল প্রাপকের সম্মান লাভ করেন।

গীতাঞ্জলির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর আরো কাব্য অনুবাদ করতে শুরু করেন কিন্তু তাঁর ১৯১২ সালের পরবর্তী অনুবাদসমূহ তীব্র সমালোচিত হতে থাকে এবং পাশ্চাত্য পাঠকদের কাছে রবীন্দ্রনাথের অনুদিত রচনার চাহিদা উল্লেখযোগ্যরূপে হ্রাস পায়!

১৯৯০ সালে ডঃ মহাশ্বেতা সেনগুপ্ত তার পি.এইচ. ডি. থিসিসে – [COLONIAL POETICS: RABINDRANATH TAGORE IN TWO WORLDS (1990).] এর মূল কারণটি ব্যাখ্যার প্রয়াস করেন।

মহাশ্বেতা দেবী বলেন যে  কবিগুরু তাঁর গীতাঞ্জলির নিজস্ব কবিতার প্রতিটি অনুবাদেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতায় তৎকালীন ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় সমাজে, আধ্যাত্মিক ভারতবাসী এবং ধার্মিক ইউরোপীয় মনোভাবাপন্ন মানুষের সমাজচেতনায় এক সমতা ছুঁতে সফল হন । পাশ্চাত্যের ঈশ্বরচেতনা এবং কবির পূজা পর্যায়ের গানের/ কবিতার অনুবাদে এক সামঞ্জস্য থাকায়, তা ইউরোপীয় কবি  সাহিত্যিকদের মন স্পর্শ করে ও কবির কাব্যের মর্মবানী হৃদয়ঙ্গম করতে প্রভূত সাহায্য করে।। স্থান  কাল  ভৌগোলিক সীমানা  সংস্কারের ঊর্ধ্বে, ঈশ্বরের প্রতি কবির যে প্রার্থিত আবেদন ও আকুতি, তা অচিরেই মুগ্ধ করে সকল পাঠকমন।

অনুবাদে, রবীন্দ্রনাথের সমস্যা মূলতঃ দেখা যায় যখন তিনি তাঁর পরবর্তী অনুবাদসমূহে, তাঁর মূল আধ্যাত্মচেতনা থেকে সরে গিয়ে, সাধারণ ভারতবাসী, আপন দেশবাসী ও তাদের জীবনবোধ  জীবনধারণ পদ্ধতি, তাদের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচার ওপর রচিত কাব্য, তথা সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন। তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে তাঁর এই স্বদেশী ভারতবাসীর সচেতন, বাস্তব রূপ এতটাই অপরিচিত তথা “গর্হিত” ছিলো, যে এসব অনুবাদ, তখনকার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বা প্রেক্ষাপটে সাধারণ পাশ্চাত্য নাগরিক মনে একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।

২] THE GARDENER (1913) প্রকাশিত গ্রন্থের মুখবন্ধে কবি স্বীকার করেন, যে তাঁর বাংলা কবিতা, সকলই প্রায় পূর্ণ আক্ষরিক অনুবাদই বটে, যা হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংক্ষেপায়িতও বটে।

রবীন্দ্রনাথ অনুদিত THE GARDENER প্রসঙ্গে, শ্রী সুজিত মুখোপাধ্যায়ের আলোচনায় আমরা পড়ি, THE GARDENER-এ, কবির অন্যান্য অনুবাদের তুলনায় গভীরতার ও সারবস্তুর অভাববোধে খানিক যেন জীর্ণ ও সাহিত্যরসচ্যুত, যাতে মূল বক্তব্যের স্বচ্ছতার অভাববোধ প্রকট। বহু স্থানে কবি,তাঁর চেতনা ও বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে, সামান্য সরলীকরণে, তাঁর নিজের কবিতারই কাঠামোগত বিকৃতি উল্লেখপূর্ণভাবে প্রকট করে ছেড়েছেন।

শ্রী সুজিত মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে আরো ব্যক্ত করেন যে রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছতা ও ভাবের ভারসাম্য রক্ষার্থে আক্ষরিক অনুবাদেই জোর দেন বলে তাঁর রচনার উৎকৃষ্টতায় প্রভাব পড়ে। কিছু শব্দ ও বাক্যবিন্যাস ব্যতীত, সেই নিখুঁত বুনন,যা যে কোনো ভালো কাব্য কবিতার আঙ্গিক তা যেন হারিয়ে যায় তাঁর অনুবাদে।

৩] THE CRESCENT MOON (1913), কবির নিজস্ব অনুদিত কবিতার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এটি কবির অনুদিত চল্লিশটি নিজস্ব কবিতার কাব্যসংকলন। শিশু কাব্যগ্রন্থ (১৯০৩) থেকে এই কবিতাগুচ্ছ সংকলিত এবং মূলতঃ শিশুদের জন্য রচিত। কিন্তু এর অনুবাদে কবি তাঁর রচিত মূল বাংলার ছন্দ ও তার উৎকর্ষতার কথা একেবারেই চিন্তা না করে, শব্দ বাক্য বিন্যাসে, তাঁর ইংরেজির জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হতে দিয়েছেন, যা শিশুমনকে হয়তো আদৌ নাড়া দিতে পারেনি।

৪] FRUIT GATHERING (1916) তাঁর চতুর্থ অনুবাদ গ্রন্থ, ১৯১৬ সালে কবি প্রকাশ করেন । যদিও ১৯১৩ তে এটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন THE CRESCENT MOON এর গ্রহণ ও বিক্রয়ের রেখচিত্র নিম্নমুখী,   বলাকা  কাব্যগ্রন্থ থেকে চয়ন করা কিছু কবিতার অনুবাদ এতে স্থান পায়। কবির স্বয়ং নিজস্ব ভাষান্তরের প্রয়াসেও বাংলাতে সে কবিতাগুচ্ছের সারানুবাদ, দৃষ্টিকটুভাবে মূল কবিতাগুচ্ছের তুলনায় মর্যাদাহীন হয় (যদিও সে গ্রন্থ হতে, কবি জটিল ভাবাপন্ন কাব্যচয়ন সন্তর্পণে এড়িয়ে যান)।

৫] THE LOVER’S GIFT AND CROSSING (1918) – তাঁর পঞ্চম গ্রন্থ, তাতেও কবিকে একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়  আক্ষরিক সারানুবাদ কাব্যের মাধুর্য্য অনেকাংশেই ম্লান করে দেয়।

এ গ্রন্থে মোট ১৩৮টি অনুদিত কবিতা স্থান পায়। গ্রন্থটির প্রথম কবিতা শাজাহান ( Shah – Jehan), মূল কবিতায় ছয়টি পর্বের ১৫১ পংক্তির, কিন্তু অনুদিত হয়ে, তা ছয়টি গদ্যস্তবকে । এক-একটি মোট ১৭ পংক্তির ৭৭৭ টি হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কবিতার অনুবাদ এতটাই ভিন্নরূপ নেয়, যে মূল বাংলা কবিতার সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে পাঠক/ গবেষকের কাছে।।

৬] THE FUGITIVE (1922) কবির অনুদিত কাব্যের অন্তিম সঙ্কলন। কবি “সোনার তরী”   বলাকা  কবিতাদুটি অনুবাদে এতটাই সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত করে দেন, যে পড়ে মনে হয়, যেন মূল কবিতার এই দুটি কেবল ‘অপভ্রংশ মাত্র’। এ দুটি কবিতা অনুবাদে, এমনই ভ্রান্ত ধারণা, পাঠকমনে ধন্দ্বস্বরূপে যেন দেখা দেয়।।

 ঊর্বশী  কবিতাটির ভালো অনুবাদ হলেও, তার শেষ দুটি পংক্তি অননুদিতই থেকে যায়, যদিও এমনটা বলা যায় যে “পলাতকার”কতিপয় কবিতার অনুবাদ, কবিমর্যাদাকে অমলিন রাখে ।

১৯২২ এ THE FUGITIVE প্রকাশিত হবার পরে, কবি নিজস্ব অনুবাদ থেকে সরে আসেন। হয়তো তিনি উপলব্ধি করেন অনুবাদের আপন ব্যর্থতা।

১৯১৫ সালে উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে  কবি পত্রে লেখেন – “ আমার কাব্য আজ সকলই গদ্যরূপেই অনুদিত। আমার লক্ষ্য ছিলো, সরলভাষায়, সহজ অনুবাদে ছন্দ ও গীতি বজায় রেখে, কাব্যে ব্যবহৃত অলঙ্কার এবং সংরক্ষণশীলতা বর্জন করে, আমার কাব্যবক্তব্যকে পাঠকমনে জায়গা দেওয়া “।

( My translations are frankly pros – my aim to make them simple, with just a suggestion of rhythm to give them a touch of the lyric, avoiding all archaisms and poetical conventions)

আবার অন্যত্র, কবি এই বক্তব্য একটু অন্যরূপে ব্যক্ত করেন। তিনি লেখেন যে তাঁর দেশে, কেউই একথা মানেন না, যে কবিতাগুলো কবিদ্বারাই অনুদিত। তাঁর পাঠকদের মতে, মূল কবিতাগুলো, অনুদিত কবিতার তুলনায় অনেক উচ্চমানের রচনা। কবি তাদের ধারণাটি কখনোই হালকাভাবে নিতে পারেননি বা চাননি। তাঁর মতে, একজন কবি , তাঁর নিজস্ব রচনার, সঠিকরূপে সু -অনুবাদ করতে হয়তো অক্ষম! কবিগুরুর নিজস্ব রচনাসত্ত্ব, সাধারণ বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীভূত বলেই তাঁর অনুবাদকে, একপ্রকার আক্ষরিক অনুবাদই বলা চলে, যা ইংরেজি ভাষান্তরে ভিন্নরূপ না নিলেও এক বৃহৎ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে তার স্ব  অনুবাদ সাহিত্যশৈলীতে। না ধরিয়ে দিলে, কোন কবিতাটি অনুবাদ করা হয়েছে, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর বটে!!


( Nobody in this country would accept that these were translations – everyone says that they are much better in their original form. I cannot just disapprove of their opinion as entirely false. In fact, one cannot just translate one’s own works. Because my right regarding my own works is not of an adventitious kind – I try to represent in English the essential meaning of the poem. That creates a gulf of difference. You would not be able to identity a poem, unless I tell you which is it.)



তথ্যপঞ্জী/ তথ্যসূত্র

…………………
A] Echoes From East & West, Roby Dutta, ( Cambridge : Gateway and Porter, 1909)

B] Rabindranath Tagore, Lover’s Gift & Crossings, ( New York : McMillan 1918)

C] Rabindranath Tagore, The Fugitive, ( New York : McMillan 1921)

D] Mahashweta Sengupta, “ Colonial Poetics: Rabindranath Tagore in Two Worlds “,( Ph.D. Dissertation, University of Massachusetts, 1990,p 117 )

E] Andrey Lefebvre, Translation Rewriting & Manipulation of Literary Fame ( London and New York : Routledge, 1992, p 39)

F] Sujit Mukherjee, Translation as Discoverer & Other Essays, p109,112

G] I am deeply indebted to Prof.Abu Zafor, Associate Professor of English, Jagannath College of Dhaka for his outstanding research works on Literature, whose works have truly enriched me. Thank you sir, my deepest salutations to you from India.

ওরা মানে রাতুল, শঙ্খ, দেবিপ্রো, শুভেন্দু, সায়ন আর অগ্নিভ। দার্জিলিং থেকে রওনা দিচ্ছে সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। সুখিয়াপোখরীর পর মানেভঞ্জনে ওরা থামে, আর এখানেই ওরা একটা সমস্যায় পড়ে। বেশ কিছু স্হানীয় লোক অনেক মালপত্র নিয়ে ওদের গাড়িতে ওঠে। এই নিয়ে বংশীলেপচার সাথে ওরা বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে রাতুল কোনো বিপদ ডেকে আনলো না তো ? নিজের সাথে সাথে বাকিদেরও। বস্তায় কি ছিল ? খোঁচা খোঁচা শক্ত মতো। ওকে বস্তায় হাত দিতে ওরা দেখে ফেলে নি তো ?

 

ওরা ছয়জন। পড়াশুনার জীবন শেষ করে সবে চাকরি জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে। অনেক কষ্টে প্রত্যেকে বাড়িতে রাজী করিয়েছে, একসাথে বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবে। সেই মতো ওরা দার্জিলিং এসেছে। সেখান থেকে যাবে সান্দাকফু। ওরা মানে রাতুল, শঙ্খ, সায়ন, অগ্নিভ, দেবিপ্রো আর শুভেন্দু।

দার্জিলিং  আসার পর টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখে ওদের সবার মন ভরে গেছে। এখন তারা রওনা দেবে সান্দকফুর উদ্দেশ্যে। এই মুহুর্তে এই বাইশ তেইশের টগবগে যুবকেরা খুবই উত্তেজিত পশ্চিমবঙ্গের এই উচ্চতম শৃঙ্গ সান্দকফুর নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দেখার অপেক্ষায়। অনেক গল্প শুনেছে, নেটে দেখেছে ছবি , তাই তা চাক্ষুষ করার জন্য স্বভাবতই ওরা ছয়জন খুবই ব্যাকুল।

এই ছয়জনের মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান রাতুল। সেই সঙ্গে ওর বিচক্ষণতা আর নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে। তাই যে কোনো ব্যাপারে বিনাবাক্যব্যয়ে বাকি পাঁচজন ওকে লিডার হিসাবে মেনে নেয়।

এই বয়সী বেশীর ভাগ ছেলেরাই যখন ইন্টারনেটকে গেমস আর অন্যান্য বিনোদনের কাজে ব্যবহার করে সেখানে শুভেন্দু ওয়েব দুনিয়াকে ব্যবহার করে নিজের জ্ঞান বাড়াতে। ছোট থেকে বাবামায়ের সাথে বেড়াতে বেড়িয়ে শুভেন্দুর বেড়ানোটা নেশার মতো হয়ে গেছে। ওর এই বেড়ানোর শখের জন্য সব সময়ই  নেট ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করে। তাই পুরো বেড়াতে যাবার টিমের  হচ্ছে গাইড।

দেবিপ্রো, পুরো টিমকে গানে মাতিয়ে রাখে। ওরা কখনো বোর ফিল করে না দেবিপ্রোর জন্য। অসাধারণ ওর গানের গলা। গায়ে অসম্ভব জোর। বাবা পুলিশের পদস্হ অফিসার। হয়তো বাবাকে দেখেই ছোট থেকে  ভীষণ সাহসী  বেপরোয়া।

দেবিপ্রোর সাহস যেমন বেশী ঠিক ততটাই ভীতু শঙ্খ। এই বয়সী ছেলেরা যেখানে একটু সাহসী আর বেপরোয়া হয় সেখানে শঙ্খ ভীষণ সাবধানী  দায়িত্ববান। শান্ত  ভীতু প্রকৃতির শঙ্খ থাকা মানে কোনোরকম রিস্ক  বন্ধুদেরও নিতে দেবে না। এই কারণে ওর প্রতি সবাই বিরক্ত হলেও মনে মনে স্বীকার করে, শঙ্খ থাকা মানে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকলেই  সতর্ক করে দেবে আর তাতে সবাই সুরক্ষিত থাকবে।

সায়নের বাবা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্হ চাকুরে, তাই উনি সুযোগ সুবিধা অনেক বেশী পান। ওদের এই ট্যুরটার সমস্ত বুকিং উনিই করে দিয়েছেন। হোটেল, গাড়ি, ট্রাভেল এজেন্সির সমস্ত ঝক্কিই সায়ন সামলাচ্ছে।

ওদের পুরো টিমকে আড্ডা আর খুনসুটিতে যে জমিয়ে রাখছে সে হলো অগ্নিভ। সাংঘাতিক উপস্হিত বুদ্ধি আর সব ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়া এটা অগ্নিভর মধ্যে খুব প্রবল তাই সবার মধ্যে  খুব পপুলার।

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ওদের এই তিনদিন খুব আনন্দে কেটেছে। দার্জিলিং সফর শেষ করে তাদের পরবর্তী গন্তব্যস্হল সান্দকফু। ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ফোনে কথা হয়ে গেছে সায়নের। ড্রাইভারের ফোনে যোগাযোগ করা হয়ে গেছে আগেই।

ল্যান্ডরোভার নিয়ে হাজির বংশীলেপচা, হাসিখুশী কমবয়সী ছেলে। এই রাস্তায় একমাত্র ল্যান্ডরোভারই চলে। নেট দেখে রুটম্যাপ ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছে শুভেন্দু। কোন পথে যাবে আর কোথায় কোথায় নামবে সবই ওর তত্ত্বাবধানে। মাত্র পচাত্তর কিলোমিটার রাস্তা দার্জিলিং থেকে সান্দকফু। রাস্তা অনেক জায়গায়ই ভীষণ খারাপ হওয়ায় সময় লেগে যায় অনেক বেশী। বংশীলেপচা ওর ল্যান্ডরোভারের মাথায় এই ছয়জনের মালপত্র চাপিয়ে ওদের নিয়ে রওনা দেয়।

ঋষি রোড ধরে এগিয়ে চলেছে ওদের ল্যান্ডরোভার। বাতাসিয়া লুপ, লেপচা জগৎ, মাজধুরাকে পেছনে ফেলে ওরা প্রথম থাকে সুখিয়াপোখরী গ্রামে। উদ্দেশ্যে একটু হাত পা ছড়িয়ে নেওয়া, চারিদিকের প্রকৃতিকে মুঠোফোনে বন্দী করা আর সাথে একটু জলযোগ।

একসাথে যেতে যেতে চলতে থাকে আড্ডা, মাঝে মাঝে সুর ধরে দেবিপ্রো, গলা মেলায় অন্যরা। তারপর এর ওর পেছনে লাগা ওদের যাত্রাপথকে আরো মজাদার করে তুলছে। মাঝে মাঝে শুভেন্দুর যাত্রাপথের নানারকম তথ্য দিচ্ছে। তাতে সবাই সমৃদ্ধ হচ্ছে। ছোট থেকেই ওরা একসাথে পড়াশুনা করায় ওদের মধ্যেকার বন্ডিং বেশ মজবুত। ল্যান্ডরোভার থেকে নেমে ওরা মাঝে মাঝেই একটু হাত পা ছড়িয়ে নেয়, সাথে ছবি তোলা তো আছেই, আর টুকটাক মুখ চালানো।

সুখিয়াপোখরির পর মানেভঞ্জনে ওরা থামে। আর ওখানেই ওরা একটা সমস্যায় পড়ে। বেশ কিছু স্হানীয় লোক অনেক মালপত্র নিয়ে ওদের গাড়িতে ওঠে। বংশীলেপচার সাথে এই নিয়ে ওরা বাদানবাদে জড়িয়ে পড়ে। সায়ন সঙ্গে সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সিকে ফোন করায় ওদের সাথে বংশী ড্রাইভারের আর একপ্রস্হ কথাকাটাকাটি হয়। রাতুল আর দেবিপ্রো হম্বিতম্বি করলেও সব প্রচেষ্টা বিফলে যায়। স্হানীয় অধিবাসীদের নিতেই হয়।

এমনিতেই ওরা ছয়জন, তারপর স্হানীয় চারজন প্রচুর বস্তা  মালপত্র নিয়ে ওদের গাড়িতে ওঠায় খানিকক্ষণের জন্য বেড়ানোর ছন্দ কাটে। আগের থেকেই ঠিক করা ছিল ওরা সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে যাবে। আর সবাইকে নিয়ে গাড়ি সেইমতো চলতে থাকে।

এখনো অনেক পথ বাকি তাই অগত্যা বিরক্তি কাটাতে এই স্হানীয় অধিবাসী, যারা একপ্রকার জোর করেই উঠল ওদের গাড়িতে, তাদের সাথে গল্প শুরু করে রাতুল। আলাপ করে সুখিয়া শেরপার সাথে, সে মালপত্র পৌঁছাতে যাচ্ছে সান্দাকফুতে। এছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্যে আছে। অনেক সময় ট্রেকিং এর জন্য অনেকে শেরপার খোঁজ করে, সেরকম যোগাযোগ হলে তখন খানিকটা রোজগার হয়।

—– প্রকৃতির এতো কাছাকাছি থাকো তোমরা, শরীর মন এমনিতেই ভালো থাকে তোমাদের। কি আনন্দ তোমাদের। রাতুল বলে।

—– ওরম মনে হয়। নিজের পরিচয় দেয় দিবাং ভুটিয়া বলে, থাকে মানেভঞ্জনে।

—— কেন তোমাদের ভালো লাগে না এখানে ? প্রশ্নটা করে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে রাতুল।

—— আসলে জায়গাটা নিঃসন্দেহে সুন্দর। কিন্তু অসুবিধাও তো বিস্তর। সব থেকে সমস্যা যাতাযাত ব্যবস্থা। তারপর পড়াশুনা, জীবিকা এসব তো আছেই। দিবাং এর কথায় হতাশা স্পষ্ট।

—– কেন স্কুল নেই ? প্রশ্নটা করে রাতুল কথা বাড়ায়।

——স্কুল আছে, কিন্তু কলেজে পড়তে গেলে সেই দার্জিলিং বা শিলিগুড়ি যেতে হয়। আর সেটা তো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। খরচ, সুযোগ সবটা হয়ে ওঠে না বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই। সুখিয়া যোগ করে।

—– ভালো তো বেশী পড়াশুনা করতে হয় না তোমাদের ছেলেমেয়েদের। সায়ন বলে ওঠে।

—– তুই থামবি ! এক ধমক দেয় রাতুল।

বাইরে তখন দুপাশে পাইন আর ফারের সারি। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে সুখিয়া বলে, এই গ্রামটার নাম চিত্রে। আর এর একটু পরেই মেঘমা গ্রাম।সেদিকে দিকে তাকিয়ে চিত্রে গ্রামটা দেখে ওদের মন ভরে যায়। ব্রিটিশ আমলে চা ব্যবসার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছিল। কালো মসৃণ পিচঢালা সুনসান রাস্তার দুপাশে পাইনের বন। এতো সৌন্দর্য্য চারিদিকে যে এখান দিয়ে যাবার সময় মনে হচ্ছে স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে যেন ওপরে উঠছে।

কথা বলতে বলতেই চলে এলো মেঘমা গ্রাম। বেশ খানিকটা খাড়াই রাস্তা তবে সম্পূর্ণ পাকা রাস্তা হওয়ায় চলতে অসুবিধা হয় না। আর মেঘ আর কুয়াশায় ঘেরা অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রাম মেঘমা, যার একপাশে ভারত আর অন্যদিকে নেপাল।

ওদের সাথের তৃতীয় একজন উঠে থেকে ঘুমোতে ব্যস্ত। তার সাথে আলাপের সুযোগ হয় না তাই। চারজন সহযাত্রীর একজন মাত্র মহিলা। ওনার সাথে আলাপ জমায় রাতুল।

—– দিদির নাম কি ? কোথায় থাকেন ?

—— রিম্বি লেপচা। তা তোমরা এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা একা চললে কোথায় ?

এই হলো নারী চরিত্র। সুযোগ পেলেই শাসন। কথাটা ভেবে মনে মনে হাসে রাতুল। এতোদিন ধরে ওরা বেরিয়েছে, কিন্তু এরকম কথা কেউ বলে নি। কিন্তু অজানা অচেনা মেয়েটি মায়ের মতোই শাসন করলো যেন। রিম্বির কথায় ওরা ছয়জনই একটু থতমত খেয়ে গেল।

নিজেকে সামলে নিয়ে অগ্নিভ বলে, আমরা বাচ্চা ছেলে না, আর কিছুদিন পরেই আমরা চাকরি করবো।

—— দেখেই বোঝা যায় নাক টিপলে দুধ বেরোয়। রিম্বিও দমবার পাত্রী নয়।

কিন্তু হেরে যেতে তো এরাও জানে না, মিচকি হেসে অগ্নিভ আবার বলে, দিদি, আমরা শুধু প্রাপ্তবয়স্কই নয়, আমাদের বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে।

—সে তোমাদের বাবা মায়েরা ছেড়েছেন, তাই তোমরা আসতে পেরেছো। তবে সাবধানে ঘোরাফেরা করবে, এখন আর কোনো জায়গায়ই নিরাপদ নয়। রিম্বির সতর্কবাণী।

——হ্যাঁ দিদি, চিন্তা করবেন না। আমরা সাবধানেই থাকবো। মুখে রাতুল একথা বললেও মনে মনে বললো, কি মরতে যে মেয়েটার সাথে কথা বলতে গেছি !

যাই হোক ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওরা সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান চলে এলো। চেকপোষ্টে ওরা দাঁড়াতেই সবাই হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামলো। আর তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গাড়ীতে রাখা মালের বস্তায় রাতুল চোট পেল।

—– কি আছে রে বাবা বস্তায় ? লোহার মতো। বাস রে কি লাগলো। কার বস্তা এগুলো ? নেমেই বিরক্ত রাতুলের প্রশ্ন।

—– বস্তাগুলো তো আমার নয়, ব্যাগ দুটো আমার। দিবাং উত্তর দেয়।

—– না, বস্তাগুলো আমারও নয়। সুখিয়া শেরপাও বলে।

—– তাহলে বস্তাগুলো মনে হয় ওই লোকটার। গাড়িতে উঠে থেকে ঘুমোচ্ছে। রাতুলের বিরক্ত উক্তি।

—— নিজে ঠিকমতো নামতে পারবি না, দোষ হয়ে গেল বস্তার। শঙ্খ রাতুলকে বলে 

—— খুব লেগেছে রে পায়ে। যন্ত্রণায় উত্তর দেয় রাতুল।

ওরা আবার গাড়িতে চড়ে বসে। গাড়ি সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে।

—– কি চেকপোষ্ট মাইরি  একটা জাতীয় উদ্যান, তার ভেতর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, একবার দেখলো না চেক করে ? আমরা খাবার দাবার, প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছি কিনা সেটা দেখা উচিত ছিল। সায়ন বলে।

শুভেন্দু সংযোজন করে, সেই তো, এতো বস্তা মালপত্র নিয়ে আমরা ঢুকলাম। কি যা তা এখানকার সিকিউরিটি !

বংশী ড্রাইভারকে দেবিপ্রো জিজ্ঞাসা করে, রেড পান্ডা দেখা যাবে ?

—– কপাল ভালো থাকলে দেখা মিলতেও পারে। তবে সাধারণতঃ দেখা যায় না এই দুপুর বেলায়। বংশী উত্তর দেয়।

রেড পান্ডা বা হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের দেখা না পেলেও প্রচুর পাখির দেখা মিললো। আর সারা রাস্তা জুড়ে রডোডেনড্রন, ওক, ম্যাপল, ম্যাগনেসিয়া, ফারের অপূর্ব সারি। মার্চ এপ্রিল মাসে এখানে ফুল ভর্তি থাকে, তবে নভেম্বর মাস বলে সবুজ গাছের সারি আর চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান পার করে ওদের ল্যান্ডরোভার ঢুকলো নেপালের কালাপোখরী গ্রামে। গ্রামটিতে ঢোকার আগে একটা পুকুর আছে যার জলের রং কালো। স্হানীয় ভাষায় ‘পোখরী’ মানে পুকুর। পুকুরটির আকার একজন মানুষের পায়ের ছাপের আদলে। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ এখানে পা দিয়েছিলেন তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুকুরটি অত্যন্ত পবিত্র। কালিপোখরী গ্রাম আসতেই ওদের সাথের ঘুমন্ত সহযাত্রী বস্তাগুলো নামাতে থাকে। বস্তাগুলো যে খুব ভারী তা ওর নামানো দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু  কোনো সহযাত্রীর সাহায্য চাইল না। যেখানে  চারটে বস্তা নামালো সেখান থেকে অন্য একটি লোক এসে সেগুলোকে কাছের একটা দোকানের মধ্যে নিয়ে গেল।

ওরা সবাই নেমে নেপালের মাটিতে পা রাখলো। বিদেশে এসেছে এমন একটা অনুভূতি হলো। সবাই নেমে খেতে গেছে এমন সময় রাতুলের খেয়াল হলো, মোবাইল গাড়িতে ফেলে এসেছে। তৎক্ষণাৎ  মোবাইল নিতে গাড়িতে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নামতে যাবে এমন সময় সিটের নীচে নজরে পড়লো একটা বস্তা। লোকটা যে ধরণের বস্তা নিয়ে নেমে গেছে ঠিক অবিকল সেরকমই। কৌতুহলী হয়ে বস্তার গায়ে হাত রাখতেই খোঁচা খোঁচা শক্ত কোনো জিনিষের অস্তিত্ব টের পেল। এতে লেগেই পায়ে বেশ চোট পেয়েছে। কৌতুহলটা বাড়ল আবার হাত দিল, কেমন কাঁটা কাঁটা মতন কিছু হাতে লাগলো। বস্তাটা টানতেই বুঝতে পারলো বেশ ভারী। বস্তার মুখটা খোলার চেষ্টা করলো, পারলো না। আবার চেষ্টা করে বস্তাটা একটু ফাঁক করলো। কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এলো। আর ঠিক সেই সময়ই বস্তার মালিক সেই লোকটা আর যে লোকটা বস্তা নিয়ে গেল দুজনাই ল্যান্ডরোভারের দরজা খুললো।

—– এই ছোকরা কি করছো এখানে ? রাতুলকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলো সেই সহযাত্রীটি।

—— মোবাইলটা ফেলে গেছিলাম, সেটা নিতে উঠেছিলাম।

—— বস্তাটায় হাত দিয়েছিলে ? রক্তচক্ষু রাঙিয়ে লোকটি বলে।

—— না না  বস্তায় ? নাতো  রাতুল ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়।

—— এখানে বেড়াতে এসেছিস, ঘোরাঘুরি করো। এসবের মধ্যে পড়লে একদম হাফিজ হয়ে যাবি বুঝলি। সাথের লোকটা রাতুলের গলা চেপে ধরে বলে।

——আমি মোবাইল নিতে এসেছিলাম। কোনো বস্তায় হাত দিই নি। রাতুল দৃঢ়তার সাথে বলে এবার।

—– চল্ চল্ টুরিস্টদের সাথে ঝামেলা করিস না। সহযাত্রীটি ছেলেটিকে বাধা দেয়। ছেলেটিও রাতুলের গলা ছেড়ে দিয়ে বস্তা নামিয়ে নিয়ে চলে যায়।

ভয়ে রাতুলের হাত পা কাঁপতে থাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে কোনো বিপদ ডেকে আনলো না তো ? কিন্তু জিনিষটা কি ? সেটা তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না  আবার এদিকে ওরাও হয়তো  যে বস্তায় হাত দিতে দেখেছে। তাহলে ? এদের তো ভালো লোক বলে মনে হলো না। রাতুল ভাবতে থাকে, ঘুরতে এসে কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে না তো ? বাকি বন্ধুরাও ওর সাথে সাথে বিপদের মধ্যে পড়ে না যায় !      

ওঠায় খানিকক্ষণের জন্য বেড়ানোর ছন্দ কাটে। আগের থেকেই ঠিক করা ছিল ওরা সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে যাবে। আর সবাইকে নিয়ে গাড়ি সেইমতো চলতে থাকে।

এখনো অনেক পথ বাকি তাই অগত্যা বিরক্তি কাটাতে এই স্হানীয় অধিবাসী, যারা একপ্রকার জোর করেই উঠল ওদের গাড়িতে, তাদের সাথে গল্প শুরু করে রাতুল। আলাপ করে সুখিয়া শেরপার সাথে, সে মালপত্র পৌঁছাতে যাচ্ছে সান্দাকফুতে। এছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্যে আছে। অনেক সময় ট্রেকিং এর জন্য অনেকে শেরপার খোঁজ করে, সেরকম যোগাযোগ হলে তখন খানিকটা রোজগার হয়।

—– প্রকৃতির এতো কাছাকাছি থাকো তোমরা, শরীর মন এমনিতেই ভালো থাকে তোমাদের। কি আনন্দ তোমাদের। রাতুল বলে।

—– ওরম মনে হয়। নিজের পরিচয় দেয় দিবাং ভুটিয়া বলে, থাকে মানেভঞ্জনে।

—— কেন তোমাদের ভালো লাগে না এখানে ? প্রশ্নটা করে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে রাতুল।

—— আসলে জায়গাটা নিঃসন্দেহে সুন্দর। কিন্তু অসুবিধাও তো বিস্তর। সব থেকে সমস্যা যাতাযাত ব্যবস্থা। তারপর পড়াশুনা, জীবিকা এসব তো আছেই। দিবাং এর কথায় হতাশা স্পষ্ট।

—– কেন স্কুল নেই ? প্রশ্নটা করে রাতুল কথা বাড়ায়।

——স্কুল আছে, কিন্তু কলেজে পড়তে গেলে সেই দার্জিলিং বা শিলিগুড়ি যেতে হয়। আর সেটা তো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। খরচ, সুযোগ সবটা হয়ে ওঠে না বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই। সুখিয়া যোগ করে।

—– ভালো তো বেশী পড়াশুনা করতে হয় না তোমাদের ছেলেমেয়েদের। সায়ন বলে ওঠে।

—– তুই থামবি ! এক ধমক দেয় রাতুল।

বাইরে তখন দুপাশে পাইন আর ফারের সারি। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে সুখিয়া বলে, এই গ্রামটার নাম চিত্রে। আর এর একটু পরেই মেঘমা গ্রাম।সেদিকে দিকে তাকিয়ে চিত্রে গ্রামটা দেখে ওদের মন ভরে যায়। ব্রিটিশ আমলে চা ব্যবসার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছিল। কালো মসৃণ পিচঢালা সুনসান রাস্তার দুপাশে পাইনের বন। এতো সৌন্দর্য্য চারিদিকে যে এখান দিয়ে যাবার সময় মনে হচ্ছে স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে যেন ওপরে উঠছে।

কথা বলতে বলতেই চলে এলো মেঘমা গ্রাম। বেশ খানিকটা খাড়াই রাস্তা তবে সম্পূর্ণ পাকা রাস্তা হওয়ায় চলতে অসুবিধা হয় না। আর মেঘ আর কুয়াশায় ঘেরা অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রাম মেঘমা, যার একপাশে ভারত আর অন্যদিকে নেপাল।

ওদের সাথের তৃতীয় একজন উঠে থেকে ঘুমোতে ব্যস্ত। তার সাথে আলাপের সুযোগ হয় না তাই। চারজন সহযাত্রীর একজন মাত্র মহিলা। ওনার সাথে আলাপ জমায় রাতুল।

—– দিদির নাম কি ? কোথায় থাকেন ?

—— রিম্বি লেপচা। তা তোমরা এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা একা চললে কোথায় ?

এই হলো নারী চরিত্র। সুযোগ পেলেই শাসন। কথাটা ভেবে মনে মনে হাসে রাতুল। এতোদিন ধরে ওরা বেরিয়েছে, কিন্তু এরকম কথা কেউ বলে নি। কিন্তু অজানা অচেনা মেয়েটি মায়ের মতোই শাসন করলো যেন। রিম্বির কথায় ওরা ছয়জনই একটু থতমত খেয়ে গেল।

নিজেকে সামলে নিয়ে অগ্নিভ বলে, আমরা বাচ্চা ছেলে না, আর কিছুদিন পরেই আমরা চাকরি করবো।

—— দেখেই বোঝা যায় নাক টিপলে দুধ বেরোয়। রিম্বিও দমবার পাত্রী নয়।

কিন্তু হেরে যেতে তো এরাও জানে না, মিচকি হেসে অগ্নিভ আবার বলে, দিদি, আমরা শুধু প্রাপ্তবয়স্কই নয়, আমাদের বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে।

—সে তোমাদের বাবা মায়েরা ছেড়েছেন, তাই তোমরা আসতে পেরেছো। তবে সাবধানে ঘোরাফেরা করবে, এখন আর কোনো জায়গায়ই নিরাপদ নয়। রিম্বির সতর্কবাণী।

——হ্যাঁ দিদি, চিন্তা করবেন না। আমরা সাবধানেই থাকবো। মুখে রাতুল একথা বললেও মনে মনে বললো, কি মরতে যে মেয়েটার সাথে কথা বলতে গেছি !

যাই হোক ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওরা সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান চলে এলো। চেকপোষ্টে ওরা দাঁড়াতেই সবাই হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামলো। আর তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গাড়ীতে রাখা মালের বস্তায় রাতুল চোট পেল।

—– কি আছে রে বাবা বস্তায় ? লোহার মতো। বাস রে কি লাগলো। কার বস্তা এগুলো ? নেমেই বিরক্ত রাতুলের প্রশ্ন।

—– বস্তাগুলো তো আমার নয়, ব্যাগ দুটো আমার। দিবাং উত্তর দেয়।

—– না, বস্তাগুলো আমারও নয়। সুখিয়া শেরপাও বলে।

—– তাহলে বস্তাগুলো মনে হয় ওই লোকটার। গাড়িতে উঠে থেকে ঘুমোচ্ছে। রাতুলের বিরক্ত উক্তি।

—— নিজে ঠিকমতো নামতে পারবি না, দোষ হয়ে গেল বস্তার। শঙ্খ রাতুলকে বলে 

—— খুব লেগেছে রে পায়ে। যন্ত্রণায় উত্তর দেয় রাতুল।

ওরা আবার গাড়িতে চড়ে বসে। গাড়ি সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে।

—– কি চেকপোষ্ট মাইরি  একটা জাতীয় উদ্যান, তার ভেতর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, একবার দেখলো না চেক করে ? আমরা খাবার দাবার, প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছি কিনা সেটা দেখা উচিত ছিল। সায়ন বলে।

শুভেন্দু সংযোজন করে, সেই তো, এতো বস্তা মালপত্র নিয়ে আমরা ঢুকলাম। কি যা তা এখানকার সিকিউরিটি !

বংশী ড্রাইভারকে দেবিপ্রো জিজ্ঞাসা করে, রেড পান্ডা দেখা যাবে ?

—– কপাল ভালো থাকলে দেখা মিলতেও পারে। তবে সাধারণতঃ দেখা যায় না এই দুপুর বেলায়। বংশী উত্তর দেয়।

রেড পান্ডা বা হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের দেখা না পেলেও প্রচুর পাখির দেখা মিললো। আর সারা রাস্তা জুড়ে রডোডেনড্রন, ওক, ম্যাপল, ম্যাগনেসিয়া, ফারের অপূর্ব সারি। মার্চ এপ্রিল মাসে এখানে ফুল ভর্তি থাকে, তবে নভেম্বর মাস বলে সবুজ গাছের সারি আর চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান পার করে ওদের ল্যান্ডরোভার ঢুকলো নেপালের কালাপোখরী গ্রামে। গ্রামটিতে ঢোকার আগে একটা পুকুর আছে যার জলের রং কালো। স্হানীয় ভাষায় ‘পোখরী’ মানে পুকুর। পুকুরটির আকার একজন মানুষের পায়ের ছাপের আদলে। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ এখানে পা দিয়েছিলেন তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুকুরটি অত্যন্ত পবিত্র। কালিপোখরী গ্রাম আসতেই ওদের সাথের ঘুমন্ত সহযাত্রী বস্তাগুলো নামাতে থাকে। বস্তাগুলো যে খুব ভারী তা ওর নামানো দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু  কোনো সহযাত্রীর সাহায্য চাইল না। যেখানে  চারটে বস্তা নামালো সেখান থেকে অন্য একটি লোক এসে সেগুলোকে কাছের একটা দোকানের মধ্যে নিয়ে গেল।

ওরা সবাই নেমে নেপালের মাটিতে পা রাখলো। বিদেশে এসেছে এমন একটা অনুভূতি হলো। সবাই নেমে খেতে গেছে এমন সময় রাতুলের খেয়াল হলো, মোবাইল গাড়িতে ফেলে এসেছে। তৎক্ষণাৎ  মোবাইল নিতে গাড়িতে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নামতে যাবে এমন সময় সিটের নীচে নজরে পড়লো একটা বস্তা। লোকটা যে ধরণের বস্তা নিয়ে নেমে গেছে ঠিক অবিকল সেরকমই। কৌতুহলী হয়ে বস্তার গায়ে হাত রাখতেই খোঁচা খোঁচা শক্ত কোনো জিনিষের অস্তিত্ব টের পেল। এতে লেগেই পায়ে বেশ চোট পেয়েছে। কৌতুহলটা বাড়ল আবার হাত দিল, কেমন কাঁটা কাঁটা মতন কিছু হাতে লাগলো। বস্তাটা টানতেই বুঝতে পারলো বেশ ভারী। বস্তার মুখটা খোলার চেষ্টা করলো, পারলো না। আবার চেষ্টা করে বস্তাটা একটু ফাঁক করলো। কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এলো। আর ঠিক সেই সময়ই বস্তার মালিক সেই লোকটা আর যে লোকটা বস্তা নিয়ে গেল দুজনাই ল্যান্ডরোভারের দরজা খুললো।

—– এই ছোকরা কি করছো এখানে ? রাতুলকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলো সেই সহযাত্রীটি।

—— মোবাইলটা ফেলে গেছিলাম, সেটা নিতে উঠেছিলাম।

—— বস্তাটায় হাত দিয়েছিলে ? রক্তচক্ষু রাঙিয়ে লোকটি বলে।

—— না না  বস্তায় ? নাতো  রাতুল ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়।

—— এখানে বেড়াতে এসেছিস, ঘোরাঘুরি করো। এসবের মধ্যে পড়লে একদম হাফিজ হয়ে যাবি বুঝলি। সাথের লোকটা রাতুলের গলা চেপে ধরে বলে।

——আমি মোবাইল নিতে এসেছিলাম। কোনো বস্তায় হাত দিই নি। রাতুল দৃঢ়তার সাথে বলে এবার।

—– চল্ চল্ টুরিস্টদের সাথে ঝামেলা করিস না। সহযাত্রীটি ছেলেটিকে বাধা দেয়। ছেলেটিও রাতুলের গলা ছেড়ে দিয়ে বস্তা নামিয়ে নিয়ে চলে যায়।

ভয়ে রাতুলের হাত পা কাঁপতে থাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে কোনো বিপদ ডেকে আনলো না তো ? কিন্তু জিনিষটা কি ? সেটা তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না  আবার এদিকে ওরাও হয়তো  যে বস্তায় হাত দিতে দেখেছে। তাহলে ? এদের তো ভালো লোক বলে মনে হলো না। রাতুল ভাবতে থাকে, ঘুরতে এসে কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে না তো ? বাকি বন্ধুরাও ওর সাথে সাথে বিপদের মধ্যে পড়ে না যায় ! 

তার ভেতর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, একবার দেখলো না চেক করে ? আমরা খাবার দাবার, প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছি কিনা সেটা দেখা উচিত ছিল। সায়ন বলে।

শুভেন্দু সংযোজন করে, সেই তো, এতো বস্তা মালপত্র নিয়ে আমরা ঢুকলাম। কি যা তা এখানকার সিকিউরিটি !

বংশী ড্রাইভারকে দেবিপ্রো জিজ্ঞাসা করে, রেড পান্ডা দেখা যাবে ?

—– কপাল ভালো থাকলে দেখা মিলতেও পারে। তবে সাধারণতঃ দেখা যায় না এই দুপুর বেলায়। বংশী উত্তর দেয়।

রেড পান্ডা বা হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের দেখা না পেলেও প্রচুর পাখির দেখা মিললো। আর সারা রাস্তা জুড়ে রডোডেনড্রন, ওক, ম্যাপল, ম্যাগনেসিয়া, ফারের অপূর্ব সারি। মার্চ এপ্রিল মাসে এখানে ফুল ভর্তি থাকে, তবে নভেম্বর মাস বলে সবুজ গাছের সারি আর চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান পার করে ওদের ল্যান্ডরোভার ঢুকলো নেপালের কালাপোখরী গ্রামে। গ্রামটিতে ঢোকার আগে একটা পুকুর আছে যার জলের রং কালো। স্হানীয় ভাষায় ‘পোখরী’ মানে পুকুর। পুকুরটির আকার একজন মানুষের পায়ের ছাপের আদলে। কথিত আছে ভগবান বুদ্ধ এখানে পা দিয়েছিলেন তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুকুরটি অত্যন্ত পবিত্র। কালিপোখরী গ্রাম আসতেই ওদের সাথের ঘুমন্ত সহযাত্রী বস্তাগুলো নামাতে থাকে। বস্তাগুলো যে খুব ভারী তা ওর নামানো দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু  কোনো সহযাত্রীর সাহায্য চাইল না। যেখানে  চারটে বস্তা নামালো সেখান থেকে অন্য একটি লোক এসে সেগুলোকে কাছের একটা দোকানের মধ্যে নিয়ে গেল।

ওরা সবাই নেমে নেপালের মাটিতে পা রাখলো। বিদেশে এসেছে এমন একটা অনুভূতি হলো। সবাই নেমে খেতে গেছে এমন সময় রাতুলের খেয়াল হলো, মোবাইল গাড়িতে ফেলে এসেছে। তৎক্ষণাৎ  মোবাইল নিতে গাড়িতে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নামতে যাবে এমন সময় সিটের নীচে নজরে পড়লো একটা বস্তা। লোকটা যে ধরণের বস্তা নিয়ে নেমে গেছে ঠিক অবিকল সেরকমই। কৌতুহলী হয়ে বস্তার গায়ে হাত রাখতেই খোঁচা খোঁচা শক্ত কোনো জিনিষের অস্তিত্ব টের পেল। এতে লেগেই পায়ে বেশ চোট পেয়েছে। কৌতুহলটা বাড়ল আবার হাত দিল, কেমন কাঁটা কাঁটা মতন কিছু হাতে লাগলো। বস্তাটা টানতেই বুঝতে পারলো বেশ ভারী। বস্তার মুখটা খোলার চেষ্টা করলো, পারলো না। আবার চেষ্টা করে বস্তাটা একটু ফাঁক করলো। কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এলো। আর ঠিক সেই সময়ই বস্তার মালিক সেই লোকটা আর যে লোকটা বস্তা নিয়ে গেল দুজনাই ল্যান্ডরোভারের দরজা খুললো।

—– এই ছোকরা কি করছো এখানে ? রাতুলকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলো সেই সহযাত্রীটি।

—— মোবাইলটা ফেলে গেছিলাম, সেটা নিতে উঠেছিলাম।

—— বস্তাটায় হাত দিয়েছিলে ? রক্তচক্ষু রাঙিয়ে লোকটি বলে।

—— না না  বস্তায় ? নাতো  রাতুল ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়।

—— এখানে বেড়াতে এসেছিস, ঘোরাঘুরি করো। এসবের মধ্যে পড়লে একদম হাফিজ হয়ে যাবি বুঝলি। সাথের লোকটা রাতুলের গলা চেপে ধরে বলে।

——আমি মোবাইল নিতে এসেছিলাম। কোনো বস্তায় হাত দিই নি। রাতুল দৃঢ়তার সাথে বলে এবার।

—– চল্ চল্ টুরিস্টদের সাথে ঝামেলা করিস না। সহযাত্রীটি ছেলেটিকে বাধা দেয়। ছেলেটিও রাতুলের গলা ছেড়ে দিয়ে বস্তা নামিয়ে নিয়ে চলে যায়।

ভয়ে রাতুলের হাত পা কাঁপতে থাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে কোনো বিপদ ডেকে আনলো না তো ? কিন্তু জিনিষটা কি ? সেটা তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না  আবার এদিকে ওরাও হয়তো  যে বস্তায় হাত দিতে দেখেছে। তাহলে ? এদের তো ভালো লোক বলে মনে হলো না। রাতুল ভাবতে থাকে, ঘুরতে এসে কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে না তো ? বাকি বন্ধুরাও ওর সাথে সাথে বিপদের মধ্যে পড়ে না যায় !  

ঘুম থেকে উঠলেই আমার খালি খাই খাই।

খিদে পেলে খাবার,

তেষ্টা পেলে জল বা সরবতের থেকেও,

কী খাবো আর খাবো কি’র মর্জিমাফিক জবাব দেওয়ার স্বাধীনতা,

মাসের পর মাস ঘুমের মধ্যে আমার একমাত্র স্বপ্ন।


ঘুম আমার অভিশাপ। যদিও প্রচলিত মতে সেটা নাকি আমারই ইচ্ছে,

কিন্তু জাগ্রত থাকলে রাজা  রাজসভা আমার চাহিদার দাবীতে ব্যতিব্যস্ত হবেন,

সেই আশঙ্কায় তাঁরাই আমায় দীর্ঘশয়নে পাঠিয়েছেন।

নিদ্রিতের অধিকারবোধ থাকেনা, সুতরাং পূরণের চেষ্টাও অপ্রয়োজনীয় বৈকি।

রাজকোষের বিপুল অর্থব্যয় শুধু আমাকে ঘুমন্ত রাখার জন্য।

আমার নাকডাকার আওয়াজে রাজার স্বস্তি,

চামর ব্যজন যেমনই হোকনা, চোখ বন্ধ হলে স্বপ্ন দেখাটাই সত্যি মনে হয়।

ছয়মাসই হোক বা সাত দশক,আমি ঘুমোলেই রাজার মঙ্গল,

বলা তো যায়না,

ভরাপেট খাবারের সাথে কখনো যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কাজের অধিকার দাবী করে বসি!

আমাকে জাগানো শুধু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, যুদ্ধ বাঁধলে।

চোখ কচলাতে কচলাতে আমি শুনি,

শত্রুসেনার সাথে লড়াই বেঁধেছে, ময়দানে আজ প্রয়োজন আমাকে।

কেন যুদ্ধ আমি জানি না, অনেক সময় কার সাথে,

সেটাও জ্ঞানে থাকে না।

শুধু জানি , যুদ্ধে যেতে হবে।

প্রতিবাদ করলে মহামান্য রাজা ধমকে দিয়ে বলেন

 দেশের জন্য এইটুকু করতে পারো না ? ধিক!’

আলুথালু আমি যুদ্ধে যাই।

যেতে হয়।

দৈত্যকে হঠাৎ জেগে উঠতে দেখে তাবৎ বিপক্ষ কামানের গোলা আমারই দিকে তাক করে,

মাথার ওপর উড়ে যায় বিমানের ঝাঁক,

কাছেই সমুদ্রে নোঙর করে অর্ণবপোত।

আমাকে মারতে

কখনো হিরোসিমা, কখনো ভিয়েতনাম,

কখনো বা ভারত চীন পাকিস্তানে লাইন অফ কন্ট্রোলে ছুটকো ঝামেলা।

অন্তিম ফল একটাই, আমার পতন।

ওয়ার ক্যাসুয়ালটি বলো বা কুম্ভকর্ণ, আসলে আমার কোনো নাম নেই, জানো।

রাষ্ট্ররা ভালোবেসে ডাকে ‘জনগণ’।

শহর ঘুমিয়ে পড়ার পর

চাঁদ নেমে আসে

ছোটোবেলায়ে কান্না ভোলাতে

মা যেভাবে ডাকত

ঠিক সেভাবে, আয় আয়…

তারপর বলল —-

আমি রোজ গাছগাছালি পেরিয়ে

সাদা ভাতের গন্ধে নেমে আসি

মৃদু কম্পনে কেঁপে উঠলাম; তিরতির !

প্রতিবেশীরা মৃতদেহ আগলে কান্নায় ভেঙে পড়েছে।

কে যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল-

এবার যাত্রা শুরু করো…

ওই দেখো-

আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী

আজীবন রাত জেগে জেগে

পাহারা দিয়ে যাচ্ছে -খেয়ালি চাঁদ

মনে ভাবি কপালে ধ্যাবড়া টিপ পরে

আবছা দাঁড়িয়ে আছে কে !

আপন ভেবে ওর দিকে এগিয়ে যাই

যত কাছেই যাই

দেখি ধূ-ধূ প্রান্তর !

উত্তরমেরু নিবাসী টার্ন পাখিদের দল

উষ্ণতার খোঁজে

যখন দক্ষিণমেরুতে এসে পৌঁছায়

         মনে হয় পৃথিবীটা অনেক ছোটো

আমার ডাইনিং হল থেকে যতটা বেডরুম

কিংবা ধরো, আফ্রিকান টিউলিপটি

যখন আমার বাগানে ফুটে ওঠে রুদ্রপলাশ

মনে হয় পৃথিবীটা আমার লেখার টেবিলে

অথচ তোমার কথা ভাবলেই

পৃথিবীটা আজকাল ধোঁয়ার মতো উড়তে উড়তে

উড়তে উড়তে এত বড়ো হয়ে ওঠে

একজন্মে যে দূরত্ব ছোঁয়া যাবে না কখনো

ভেসেছিলে বুঝি ছন্দপতনে

        বসেছিলে মুখোমুখি

বুকের ভেতরে লুকোনো ছবিটা ,

অথৈ জলের ঢেউ আঁকাবাঁকা

কতকাল ধরে সাজিয়ে রেখেছি

      ভেঙে চুরে দিলে নাকি ?

অবেলার রোদ কার্নিসে লেগে

      বিদায়ের  তো কথা বলে ,

ঠিক এভাবেই মুহূর্ত যতো

ঝিনুক গর্ভে মুক্তোর মতো

অভিমানী হয়ে কান্না জমায়

          সে খবর রেখেছিলে !!

এখনো আগুন কড়া নেড়ে যায়

             দরজায় চুপিসারে

অদূরে কৃষ্ণচূড়ার চিঠিটা

হাসনুহানার  গন্ধ টা

নীরবতা হয়ে অভ্যাসে মেশে

          সূর্য স্নানের পরে 

আমার গানগুলি শৈবালের দল কিনা

জানি না কিন্তু এটা জানি আমিই

সারাজীবন শৈবালের মতো গানের গভীরে

মিশে আছি, মূর্ছনা শুনছি, বিপদ

শুনছি, আনন্দ শুনছি 

            গায়ে আমার পুলক লাগছে,

সুরে, সুরের অনির্বচনীয়তায়

              জীবন ধন্য হয়ে উঠছে।

সারা দুনিয়ায় যে একটিমাত্র ধর্ম জ্বাজল্যমান-

তা হল- ক্ষুধা।

ক্ষুধা সেই ধর্ম- যা জনে জনে জানান দিয়ে যায়।

আজব এই শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরা ধ্রুব

শুধু পেট আর তার ক্ষুধা- জ্বলে, নেভে।

ক্ষুধা যদি পূজারী হয়-

খাদ্য তবে ঈশ্বর।

ক্ষুধা- পেটের মানুষগুলোর আকুতি-

ঈশ্বরসম খাদ্যের দেখা পাওয়া।

সেই খাদ্যের প্রাপ্তি  ভক্ষণ।

খাদ্যের উৎসের আশেপাশে আমি দেখেছি

সেই একই, ধর্মের মানুষের ভিড়, যারা ক্ষুধার্ত

এই ক্ষুধার্তদের ভিড়ে , আমি ফের বুঝি-

ক্ষুধাই একমাত্র ধর্ম।।

প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটা আলাদা ঘর থাকে,

শূন্যের প্রাপ্তবয়স্কতার কোঠায় এসে এসব হঠাৎ খেয়াল হয়;


চলার পথে কত কত বালির ঝড়,

স্মৃতির তাপ, আশ্রয়ের চিহ্ন-

সব মিলেমিশে যায় শুধু!

কালো পিচের এবড়োখেবড়ো রঙ সংক্ষেপে লেখে এক মায়াগলিত পান্ডুলিপি,

পড়ে থাকে শব্দহীন ভেসে যাওয়ার ভিন্নতা-

অতিক্রান্ত প্রথম আলোয়,

পিছুডাক,

পিছুটান 

বেঁচে থাকার এক আলগা অজুহাতমাত্র!

বরং আরও একটা ঘর গড়ে তোলা দরকার,

হিসেব নিকেশ উলোটপালোট হলেও একটা আলাদা ঘর থাকবে এবার-

নিজের সাথে সম্পর্কের!

পরিচয়টুকুই না হয় নিঃশ্বাস নেবে বালিয়াড়ি পথের শেষ ঠিকানায়।

পৃথিবী আছে আপন মেজাজে যত আঘাত কর তারে;

হৃদয় খুবলে হীরে জহরত লোপাট করেছ

বাহুবলে।

যেখানে যতো মনি-মানিক্যে’র সমাহার

ঝাঁপিয়ে পড়েছ কেড়ে নিতে।

কিছু স্বদেশীয় তাঁবেদার ছিলো ; অর্থের লোভে,

গোপন ষড়যন্ত্রে দাঁও মেরে বিপুল

সম্পত্তির মালিক হয়েছে।

মনে ছিলো পাপবোধ ধূমধাম পুজোর আয়োজনে ;

দেদার খরচ করে ডোল বিলি করেছে।

অর্বাচীন পণ্ডিত আর নিঃস্ব

মানুষজন হাত পেতেছে;

ওদের কি দোষ? পেটে ক্ষুধা সন্তান কাঁদছে

এখন পট পরিবর্তন; আমি ওমুখো হবো না।

বয়কট ভাবে ভাবুক।

লাল রোদ্দুরে কে লিখে রাখে

অমোঘ নিয়তির এ-কথা-

মৃত্যু শেষ নয়-শুরুর সূচনা।

পড়ন্ত রোদের বেলায়

কে পোষ্টম্যান হয়ে আসে

ধীর গতি নদীটির কাছে।

কে ঘুম লিখে দেয়

সন্ধ্যার ফুল, পাখিদের চোখে

কার ডাকে তারা উঠে বসে 

পাথুরে রাত্রির ভিতর

নক্ষত্র বিছানো রাজসভায়

কে চাঁদের সিংহাসন পাতে।


কার জানা আছে মধুমাখা অমৃতকথা

পৃথিবীর সব জঙ্গল ভেঙে

চলে যাবো তার কাছে।

পুরোনো কাগজ,ভাঙা-চোরা বিক্রি,

হেঁকে যেতো সামনের রাস্তা দিয়ে।

লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছে আজ

ওদের  সামান্যতম রোজগার।

আয়লায় কেড়ে নিয়েছে ঘর-বাড়ি

আমফানে কেড়েছে ওদের তাবুর ঘর।

করোনার দাপটে বিদ্ধস্ত সারা পৃথিবী

কেড়ে নিয়েছে ওদের সব রোজগার।

পরিচারিকার কাজে রাখছে না কেউ

অভাবী পেটে খিদের জ্বালায় হাহাকার।

খিদেয় কাঁদে অভাবী ঘরের শিশু

ছাদহীন ঘরে ওরা রোদে জলে ভেজে।

সব কিছু হারিয়ে ওরা নিঃস্ব আজ

কিছুই নেই ওদের চালাবার মতো জীবিকার।

তবুও আশায় বুক বাঁধে আগামীর স্বপ্নে

পৃথিবী আবার আগের মতো সুস্থ সুন্দর হবে।

আবার ফিরে পাবে সকলে তাদের রোজগার

গরম ভাত দু’বেলা ওরা পেট ভরে খাবে।

এসো, একটা ঘর বাঁধি

যেখানে

জানলা দিয়ে কোনো রোদ্দুর না আসলেও

আমাদের উষ্ণতাই যথেষ্ট হবে……

এসো না, বেঁধে নিই একটা ঘর

যার চালে, টুপটাপ আওয়াজের বৃষ্টি না পড়লেও

আমার কান্না দিয়ে সুর বাঁধবে তুমি

খড়ের ভাঁজে ভাঁজে,

ওই চুঁইয়ে পড়া ছন্দ দিয়ে

একটা ধানগাছ পুঁতবো আমি

তোমার আনন্দে……

চলো না, ঘর বেঁধে ফেলি একটা

যেখানে কোনো শয্যাদ্রব্য না থাকুক,

শুকনো পাতার একটা মাদুর

বিছিয়ে দেব, যার ছোঁয়ায়

আমার মুক্তিরা তোমায় স্বস্তি দেবে,

আমার খুশি চিরে চিরে

যে কাঁথাটা বানিয়ে দেবে

জড়িয়ে নেব তাতে তোমার যন্ত্রণাদের……

আসবে ? বাঁধবে একটা ঘর?

যার উঠোন জোৎস্নায় না ভাসলেও

তোমার সুখে আমার আঁচল ভিজিয়ে নিয়ে

মেলে দেব দাওয়ায়,

কোনো ফুলের সুবাস নাই বা থাকলো

একমুঠো মাটি এনে দিও

ওর থেকে নেব তোমার ঘামের আঘ্রাণ……

চলো, বেঁধেই ফেলি একটা ঘর

যার দরজায় কোনো তালা লাগাবার প্রয়োজন হবে না

থাকবে শুধু আমাদের ভালোবাসার গিঁট……

সকালবেলা একটা মৃত্যু। বিজনের মনটা বিষণ্ণ।


পূর্ণিমা আসছে না, গত পরশু থেকে। সে দেশে গেছে। কলকাতা শহরে বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করে যে টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে জমি কিনেছে। সেই জমি নিয়ে গণ্ডগোল। মুসলিমের জমি। সব শরিককে না জানিয়ে বেঁচে দিয়েছে গ্রামের আবুচাচা। এখন অন্য শরিক বাগড়া দিচ্ছে। ঝামেলা মেটাতেই দেশে গেছে। ফিরবে দশ দিন পর।

এখন প্রীতির মাথার ঠিক নেই। পূর্ণিমার সব কাজ তাকে করতে হচ্ছে। এরপর আছে রান্না পুজো দেওয়া, তারপর অফিস দৌড়োনো।

বিজন এগিয়ে এসে বলে ‘ঘরটা আমি মুছে দেব?’

প্রীতি ঠাকুরের বাসন ধুতে ধুতে বলে, ‘ঐ জল জল করে ঘর মুছবে?’

‘তাহলে বাসনগুলো মেজে দিই?’

‘তুমি বাসন মাজলে এঁটো লেগে থাকবে। দরকার নেই।’

‘না হলে আমি পুজোটা দিয়ে দিই?’

‘তুমি দেবে পুজো! কোনদিন ঠাকুরের সামনে দু’দণ্ড বসেছো?’

কথা না বাড়িয়ে বিজন সিগারেট কিনতে নিচে নেমে এল। সি ব্লকের কাছে একটি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘তুমি ভাই সাতদিন আমার ফ্ল্যাটে কাজ করে দেবে? একবেলা।’

‘ও বদলির কাজ। তা ক’জন লোক?’

‘দু’জন।’

‘পঞ্চাশ টাকা রোজ দিতে হবে।’

‘বলো কি?’

‘ত্রিশ টাকা দেবো। একবেলা তো আসবে।’

বউটার নাম জ্যোৎস্না। গায়ের রং কালো। দু’দিন এলো। কাজ করলো। ষাট টাকা নিল। আজ ৮টা বেজে গেল। এখনো এলো না। মনে হয় না আসবে।

জ্যোৎস্না আসবে বলে সব কাজ ফেলে রেখে স্নান সেরে পুজোয় বসেছে প্রীতি। এখন সে কি করবে?

বিজন বলল, ‘আমি শুকনো করে ঘর মুছে দিতে পারবো।’

মুছতে গিয়ে বিজন বুঝল, ঘর মোছাটাও একটা আর্ট। মেঝেতে জল রয়ে গেছে। প্রীতি দেখলে রাগ করবে। জোরে পাখা চালিয়ে দিল বিজন। প্রীতি পুজো সেরে ওঠার আগেই ঘর শুকনো হয়ে যাবে।

বেসিনে হাত ধুয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াল। তারপর বেডরুমে ঢুকে অবাক বিজন। মেঝের জল এখনও শুকোয় নি। ভেজা মেঝেতে বেশ কিছু পালক পড়ে আছে। পালক এলো কোথা থেকে? হঠাৎ চোখ পড়ল, টেবিলের ওপর একটা চড়ুই মরে পড়ে আছে। একটু আগে ঘর মুছলো! কখন মরলো পাখিটা? ঘরের ভিতরই বা কি করে মরলো!

পড়াশুনার টেবিল। তার গায়ে আলমারি। আলমারির গা ঘেষে টেবিলের ওপর পাখিটা শুয়ে। পা দু’টো গুটিয়ে পেটের কাছে। সরু ঠোঁটে তাজা রক্তের দাগ।

বিজনের মনে নেমে এলো মেঘলা সকাল। আঙুল দিয়ে নাড়া দিলো। যদি এতটুকু প্রাণ থাকে! নিথর দেহ।

বিজন একটু গলা তুলে ডাকলো, ‘প্রীতি, প্রীতি, একবার এঘরে আসো তো।’

‘কেন কি হয়েছে?’

‘আসো না একবার। দেখো কি কাণ্ড হয়েছে।’

‘কি হয়েছে? এত ডাকাডাকি কেন?’ ঘরে ঢুকে বলল প্রীতি।

‘দেখো টেবিলের এবার একটা চড়ুই’ মরে পড়ে আছে।’

‘মরলো কি করে?’ মনে হল প্রীতির, পাখাটা ফুল স্পিডে ঘুরছে। তার ব্লেডে আঘাত পেয়ে মরেছে। ‘সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাখা ফুলে দিয়েছো কেন? এর ধাক্কা খেয়ে পাখিটা মরল। এরজন্য তুমি দায়ী।’

‘কি বললে আমি পাখিটাকে মেরেছি?’ তুমি মেরেছো?’

‘আমি?’ প্রীতি অবাক।

‘আলমারির মাথায় তিনটে লাগেজ। ওপরে পিলার থাকায় লাগেজের পাশে দেওয়াল ঘেষে একটা সরু প্যাসেজ হয়েছে। কয়েকদিন ধরে পাখিটা সেখানেই বাসা বাঁধতে চেয়েছিলো। সঙ্গে আরো একটা পাখি ছিলো। দম্পতি। তুমি কি করলে? ওখানে কাপড় গুজে প্যাসেজটা বন্ধ করে দিলে।’

‘দেবো না। ঘরের মধ্যে বাসা বাঁধবে। আমার পছন্দ নয়।’

‘তখন ওরা রুট বদল করলো। আগে ওদের বাসা ছিলো দক্ষিণের দেওয়ালের প্যাসেজ। এবার করলো পশ্চিম দিকের দেওয়ালের প্যাসেজে।’

‘ওরা যে রুট বদল করবে, তা আমি কি করে জানবো? এখন এসব কথা বলার সময় নেই আমার।’

 ‘না, না, তুমি একটু শোনো, মানুষ যখন এক জায়গায় বাসা বাঁধতে পারে না, তখন অন্য জায়গায় বাসার সন্ধানে বের হয়। এই যেমন আবার বাবা পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানের আক্রমণে থাকতে না পেয়ে চলে এলো এই বঙ্গে। কলকাতায়। পাখিরাও তেমন। মানুষ আর পাখিতে কোন তফাৎ নেই।’

‘পাখিরা যে মানুষের মতো আচরণ করে আমার জানা ছিল না।’

‘এখন পশ্চিমের দেওয়ালে বাসা করছে, পাখার তলা দিয়ে যেতে হবে।

সকালবেলা একটা মৃত্যু। বিজনের মনটা বিষণ্ণ।


পূর্ণিমা আসছে না, গত পরশু থেকে। সে দেশে গেছে। কলকাতা শহরে বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করে যে টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে জমি কিনেছে। সেই জমি নিয়ে গণ্ডগোল। মুসলিমের জমি। সব শরিককে না জানিয়ে বেঁচে দিয়েছে গ্রামের আবুচাচা। এখন অন্য শরিক বাগড়া দিচ্ছে। ঝামেলা মেটাতেই দেশে গেছে। ফিরবে দশ দিন পর।

এখন প্রীতির মাথার ঠিক নেই। পূর্ণিমার সব কাজ তাকে করতে হচ্ছে। এরপর আছে রান্না পুজো দেওয়া, তারপর অফিস দৌড়োনো।

বিজন এগিয়ে এসে বলে ‘ঘরটা আমি মুছে দেব?’

প্রীতি ঠাকুরের বাসন ধুতে ধুতে বলে, ‘ঐ জল জল করে ঘর মুছবে?’

‘তাহলে বাসনগুলো মেজে দিই?’

‘তুমি বাসন মাজলে এঁটো লেগে থাকবে। দরকার নেই।’

‘না হলে আমি পুজোটা দিয়ে দিই?’

‘তুমি দেবে পুজো! কোনদিন ঠাকুরের সামনে দু’দণ্ড বসেছো?’

কথা না বাড়িয়ে বিজন সিগারেট কিনতে নিচে নেমে এল। সি ব্লকের কাছে একটি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘তুমি ভাই সাতদিন আমার ফ্ল্যাটে কাজ করে দেবে? একবেলা।’

‘ও বদলির কাজ। তা ক’জন লোক?’

‘দু’জন।’

‘পঞ্চাশ টাকা রোজ দিতে হবে।’

‘বলো কি?’

‘ত্রিশ টাকা দেবো। একবেলা তো আসবে।’

বউটার নাম জ্যোৎস্না। গায়ের রং কালো। দু’দিন এলো। কাজ করলো। ষাট টাকা নিল। আজ ৮টা বেজে গেল। এখনো এলো না। মনে হয় না আসবে।

জ্যোৎস্না আসবে বলে সব কাজ ফেলে রেখে স্নান সেরে পুজোয় বসেছে প্রীতি। এখন সে কি করবে?

বিজন বলল, ‘আমি শুকনো করে ঘর মুছে দিতে পারবো।’

মুছতে গিয়ে বিজন বুঝল, ঘর মোছাটাও একটা আর্ট। মেঝেতে জল রয়ে গেছে। প্রীতি দেখলে রাগ করবে। জোরে পাখা চালিয়ে দিল বিজন। প্রীতি পুজো সেরে ওঠার আগেই ঘর শুকনো হয়ে যাবে।

বেসিনে হাত ধুয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াল। তারপর বেডরুমে ঢুকে অবাক বিজন। মেঝের জল এখনও শুকোয় নি। ভেজা মেঝেতে বেশ কিছু পালক পড়ে আছে। পালক এলো কোথা থেকে? হঠাৎ চোখ পড়ল, টেবিলের ওপর একটা চড়ুই মরে পড়ে আছে। একটু আগে ঘর মুছলো! কখন মরলো পাখিটা? ঘরের ভিতরই বা কি করে মরলো!

পড়াশুনার টেবিল। তার গায়ে আলমারি। আলমারির গা ঘেষে টেবিলের ওপর পাখিটা শুয়ে। পা দু’টো গুটিয়ে পেটের কাছে। সরু ঠোঁটে তাজা রক্তের দাগ।

বিজনের মনে নেমে এলো মেঘলা সকাল। আঙুল দিয়ে নাড়া দিলো। যদি এতটুকু প্রাণ থাকে! নিথর দেহ।

বিজন একটু গলা তুলে ডাকলো, ‘প্রীতি, প্রীতি, একবার এঘরে আসো তো।’

‘কেন কি হয়েছে?’

‘আসো না একবার। দেখো কি কাণ্ড হয়েছে।’

‘কি হয়েছে? এত ডাকাডাকি কেন?’ ঘরে ঢুকে বলল প্রীতি।

‘দেখো টেবিলের এবার একটা চড়ুই’ মরে পড়ে আছে।’

‘মরলো কি করে?’ মনে হল প্রীতির, পাখাটা ফুল স্পিডে ঘুরছে। তার ব্লেডে আঘাত পেয়ে মরেছে। ‘সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাখা ফুলে দিয়েছো কেন? এর ধাক্কা খেয়ে পাখিটা মরল। এরজন্য তুমি দায়ী।’

‘কি বললে আমি পাখিটাকে মেরেছি?’ তুমি মেরেছো?’

‘আমি?’ প্রীতি অবাক।

‘আলমারির মাথায় তিনটে লাগেজ। ওপরে পিলার থাকায় লাগেজের পাশে দেওয়াল ঘেষে একটা সরু প্যাসেজ হয়েছে। কয়েকদিন ধরে পাখিটা সেখানেই বাসা বাঁধতে চেয়েছিলো। সঙ্গে আরো একটা পাখি ছিলো। দম্পতি। তুমি কি করলে? ওখানে কাপড় গুজে প্যাসেজটা বন্ধ করে দিলে।’

‘দেবো না। ঘরের মধ্যে বাসা বাঁধবে। আমার পছন্দ নয়।’

‘তখন ওরা রুট বদল করলো। আগে ওদের বাসা ছিলো দক্ষিণের দেওয়ালের প্যাসেজ। এবার করলো পশ্চিম দিকের দেওয়ালের প্যাসেজে।’

‘ওরা যে রুট বদল করবে, তা আমি কি করে জানবো? এখন এসব কথা বলার সময় নেই আমার।’

 ‘না, না, তুমি একটু শোনো, মানুষ যখন এক জায়গায় বাসা বাঁধতে পারে না, তখন অন্য জায়গায় বাসার সন্ধানে বের হয়। এই যেমন আবার বাবা পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানের আক্রমণে থাকতে না পেয়ে চলে এলো এই বঙ্গে। কলকাতায়। পাখিরাও তেমন। মানুষ আর পাখিতে কোন তফাৎ নেই।’

‘পাখিরা যে মানুষের মতো আচরণ করে আমার জানা ছিল না।’

‘এখন পশ্চিমের দেওয়ালে বাসা করছে, পাখার তলা দিয়ে যেতে হবে। সেই যেতে গিয়েই ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে মারা গেল পাখিটা।’

‘দেখো পাখিটার মৃত্যুর জন্য আমি বা তুমি দায়ী নই। ওর মৃত্যু ছিলো। মরে গেছে। প্রীতি চলে গেল।

কয়েক মাস আগে দু’টো চড়ুই বাসা বেঁধেছিলো বারান্দায়। বারান্দার দেওয়ালে হুকে একটা বালতি ছিল দরজার আড়ালে।

একদিন দুপুরবেলা বিজন দেখলো, ঠোঁটে একটা পোকা নিয়ে একটা চড়ুই বারান্দার দড়িতে বসে দুলছে। অন্য একটা চড়ুই একটু দূরে কেবল লাইনের তারে বসে ডাকছে। হঠাৎ খাবার নিয়ে পাখিটা বারান্দার দরজার পিছনে চলে গেল। কি ব্যাপার দরজার পিছনে কেন? ততক্ষণে দ্বিতীয় পাখিটা প্রথম পাখির জায়গায় চলে এসেছে। ঘাড় তুলে এদিক ওদিক দেখছে। যেন পাহারা দিচ্ছে।

বিজনের খাওয়া হয়ে গেছে। বেসিনে হাত ধুয়ে বারান্দার দরজাটা সরাতেই দেখলো বালতির ভিতর থেকে পাখিটা উড়ে গেল। তাহলে কি বালতিতে বাসা বেঁধেছে?

বালতিটা নামিয়ে তার ভিতর চোখ ফেলে বিজন অবাক হয়ে গেল। ছোবরা সরিয়ে কি সুন্দর একটা গর্ত করেছে। গর্তের চারধারে লোহার তার দিয়েছে। যাতে ছোবরাগুলি পড়ে না যায়। সেই গর্তে রোম ওঠা চারটে ছানা চিঁ চিঁ করছে। ওদেরই খাবার দিয়ে যাচ্ছে পাখি দু’টো। এরপর থেকে প্রতিদিন একবার করে বালতি নামিয়ে বিজন দেখে ছানাগুলো কতটা বড় হলো। ছানা থেকে পূর্ণাঙ্গ পাখি হবার আশ্চর্যময় পর্বটা তো সে কোনদিন দেখেনি।

একদিন বিকেলে প্রীতি বলেছিল ‘আচ্ছা এই বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরা যায় না?’

বিজনের বুকটা ধক করে ওঠে, ‘কেন জাল দিয়ে ঘিরবে কেন?’

‘আর বলো না। পাখিতে আমার কারি গাছের সব পাতা খেয়ে ফেলছে।’

‘না, না। গাছের কোন অসুখ হয়েছে। তুমি নার্সারিতে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এসো’।

‘জল আর ওষুধ সবই আমি দিচ্ছি। চড়ুই পাখিই পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। তুমি আজই বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরার চেষ্টা কর।’

‘এখন মিস্ত্রি পাবো কোথায়?’

‘তাহলে কাল করো।’

‘এত তাড়াতাড়ির কি আছে?’

‘জাল লাগাতে তুমি এত অনীহা দেখাচ্ছো কেন?

বিজন তখন সত্য কথাটা বলে ফেলল, ‘ঐ বালতিতে কয়েকটা চড়ুই ছানা আছে। জাল দিলে ওদের মা আসতে পারবে না। ওরাও না খেয়ে মরে যাবে।’

‘বালতি ওখান থেকে সরাতে হবে। ছোবরা গুলো ফেলে দিতে হবে। তাই তুমি নেট দিতে চাইছো না। আসলে পাখিগুলোকে তুমি প্রশ্রয় দিচ্ছো, এরপর বেডরুমে বাসা বাঁধবে।’

প্রীতির কথাই ঠিক হলো। ছানাগুলো বড় হয়ে উড়ে যেতেই ওখান থেকে বালতি সরিয়ে নেওয়া হলো। বারান্দা জাল দিয়ে ঘেরা হল।

 দুটো চড়ুই, না অন্য চড়ুই বাসা বাঁধতে চেয়েছিলো বেডরুমে। পরিণতিতে মৃত্যু হল।

মৃত পাখিটাকে দেখছিলো বিজন। পেটে কটা ডিম ছিল কে জানে? চার পাঁচটা ছানা তো হতো নিশ্চয়। ওদের সংখ্যা একটু বাড়ত। ইদানীং তো মোবাইল টাওয়ারের দৌলতে ওদের প্রজন্ম শেষ হতে চলেছে।

‘এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করছো নাকি? যাও ওটাকে ফেলে দিয়ে এসো।’

‘সে না হয় আমি দিচ্ছি। তুমি লাগেজের কোন থেকে কাপড়গুলো সরিয়ে নিও।’

‘না।’ প্রীতি জোর গলায় বলে, ‘এবার জানালায় নেট লাগাবো।’

বিজন অসহায় গলায় বলে, ‘ওরা যাবে কোথায় প্রীতি? আমাদের দু’টো ঘর! অনেকটা জায়গা। তার এক কোণে ওরা যদি বংশ বিস্তার করে মানে বেঁচে থাকতে চায় তুমি এই টুকু স্পেস ওদের জন্য ছাড়তে পারবে না?’

‘ঐ তো পূর্ণিমাকে নিয়ে কয়েকদিন ছুটলে, দিল কেউ জায়গা?’

কথাটি মিথ্যে বলেনি প্রীতি। পূর্ণিমাদের ঝুপড়িতে ২০-২৫টা পরিবার থাকে। বিজন কয়েকদিন ওদের কয়েকজনকে নিয়ে স্থানীয় নেতা, কাউন্সিলারের কাছে ছুটে গেছে। সবার এক কথা, যার জায়গা সে তো তার জায়গা দখল নেবেই। তোমরা খুঁজে দেখো এমন ফাঁকা জায়গা কোথাও আছে নাকি? অনেক খুঁজেছে তারা, খাল ধার, সুভাষ মেলার মাঠ, ধোবার মাঠ, পুরনো ফাঁড়ির পিছনের জায়গা, রেল লাইনের ধার, কোথাও এতটুকু জায়গা তারা পায়নি। তখন বিজনের বাবার কথা মনে পড়ছিল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে প্রথমে নবদ্বীপ তারপর শোভাবাজার, তারপর উল্টোডাঙায় বাসস্থান করে। সে এক যাযাবর মানুষের মতো জায়গা বদল করা। বিজন বলতে যাচ্ছিল আমাদের যদি সন্তান থাকতো। ‘শোন প্রীতি’।

‘প্রীতির শোনার সময় নেই। ‘প্রীতি জুতোয় পা গলিয়ে সিঁড়িতে শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল।



কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলো প্রীতি। রাতে জুতো বাইরে থাকলে চুরি হয়ে যায়। তাই জুতো জোড়া হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে চমকে উঠলো বিজন। বারান্দায় আলো জ্বলচ্ছে। বস্তির পালান একটা বড় কাতার দিয়ে জালটা অর্ধেক কেটে ফেলেছে। তাকে দেখে পালন বলে, ‘দেখো বউদির কাণ্ড। এত রাতে জাল কাটবে। বললাম, কাল সকালে কেটে দেবো, তা শুনলো না।’

পালানের গলা দিয়ে মদের গন্ধ আসছে। সন্ধ্যা হলে পালান বাংলা মদ খায়। প্রীতি কি মদের গন্ধ টের পায়নি? তবু পালানকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে!’ আশ্চর্য। আরো আশ্চর্য হলো বিজন। বারান্দার দরজা সরিয়ে সেখানে জুতো রাখতে গিয়ে দেখল, সেখানে একটা নতুন বালতি ঝুলছে। আর তার ভিতর ছোবা রাখা হয়েছে।

প্রীতি কিচেনে রাতের রুটি করছে। বিজন সেখানে গিয়ে আলতো করে প্রীতির ঘাড়ে একটা চুমু দিলো।

প্রীতি বলল, ‘কি হচ্ছেটা কি?’

‘আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি।’

‘জানো আজ অফিসে গিয়ে না খুব বাবার কথা মনে পড়ছিলো। ওপার থেকে বাবা যখন এখানে আসে, আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন ছিলো, তারা কেউ আশ্রয় দেয়নি। নানা জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে থেকেছে। শেষে আজাদ-হিন্দ-কলোনীতে জায়গা দখল করছে। টিনের চাল দিয়ে ঘর বানালো। সেই নোংরা কলোনীর ছোট্ট ঘরে আমরা ভাইবোনেরা বড় হয়েছি। বাবাকে বলতাম, বাবা একটা ভাল জায়গা দেখে চলে যাই না আমরা। বাবা বলতো, ‘আর উদ্বাস্তু হতে বলিস না মা, উদ্বাস্তুদের অনেক জ্বালা।’ প্রীতির চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।

‘প্রীতি আমিও সেই কথাই বলতে চাইছি। এই যে ফ্ল্যাট বাড়িটায় আমরা থাকছি, এখানে আগে গাছপালা ছিল, পুকুর ছিলো। পাখিরা এখানে আশ্রয় পেতো। আজ ওদের

উদ্বাস্তু করে আমরা থাকছি। তাহলে ওরা যাবে কোথায় বলো?’

একটু রাত হলো শুতে।

প্রীতি বলল, ‘আজ কাগজে একটা খবর পড়ে মনটা খুব খুব খারাপ হয়ে গেল।’

‘কি খবর?’

‘পোল্যান্ড থেকে দশ লক্ষ লোক উদ্বাস্তু হয়ে জার্মানিতে ঢুকে পড়েছে। জার্মানি বলছে ওদের আশ্রয় দেবে না। ওরা কোথায় যাবে বিজন।’

বিজন কোন জবাব দিতে পারে না।

এখনও লেখেনি হাওয়া নীলাকাশে পতনের গান,

এখনও বোঝোনি তুমি সর্বনাশা ঝড়ের অনুরাগ।

থেমে যাও হে বিধাতা ;

অশ্রুর কালি দিয়ে লিখে নিতে দাও কৃষকের পান্ডুলিপি,

অধিকারের ফলায় গর্জে উঠুক দু’বাহুর ঘাম।

তুমিই তো ভেঙেছো পাঁজর;

যতটুকু বিশ্বাস লেখা ছিল হৃদয়ের গভীরে,

সব কোদাল নিয়েছো কেড়ে ;

খুবলে খেয়েছো বুকজ মাংসল পেশি,

রক্তলোলুপ নখর থাবায়।

অবশিষ্ট আজ কেবল আ-দেহে অস্থিচর্ম,

আর শামুকের খোলে মূর্তমান লোহিত বর্ণ প্রখর নেত্র।

যা দিয়ে মেপে নেয় ওরা;

আবিশ্ব ব্রহ্মান্ডের আপাদমস্তক পরিচয়।

সাধু সাবধান ; এখানেই স্তব্ধ হোক তোমার কালিমালিপ্ত রথের চাকার গতিময়তা,

বারবার পিষ্ট কোরো না কাঙালের মন,

নষ্ট না হোক সহস্র পথিকের আশা।

গরীব চাষার মন নিয়ে খেলো না জুয়া,

পথ এসে মিশে যাক পথের সাথে,

সুরে সুরে ভাসুক মানুষের জীবন,

রশি দিয়ে বেঁধো না রসদের ঘর।

দাও এই অধিকার ;

লাঙলের ফলায় আপন ভাগ্য শুধু নির্মাণ করার।

সীমান্তবর্তী বিশ্বাসের দ্রাঘিমা অতিক্রম করে 

আরম্ভ হয় জীবনের লুকোচুরির পরম্পরা 

সাদা পায়রার ডানায় ভর করে ..

দৃশ্যকল্পে উড়তে থাকি অন্তহীন ব্যস্ততায় 

দেনা পাওনার হিসাব ভুলে গিয়ে 

সুষুপ্তির অন্তরাল থেকে জেগে উঠে..

ক্যানভাসে আঁকা জীবনের জলছবি খুঁজি 

একলা আকাশে যখন তাকাই গভীর ভাবে…

অসীমের প্রত্যাশী মন পৌঁছাতে চায়…

জ্যোৎস্না মাখা এক অলৌকিক বন্দরে 

বর্ণময় অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে বেড়ানোর পর…

কুজ্ঝটিকাচ্ছন্ন গভীর খাদ পার করে…

মধ্যরাতের অসাড়তায় নামাবলীর উন্নাসিক দহনে…

রঙীন মন চেনে অচেনার মাঝে অচিনকে 

ফলিত উত্তাপে ঠোঁট ডোবে ঠোঁটের চুমুকে 

ছাদের কার্নিস থেকে যতবার চোখ মেলে দেখি

অনায়াসে দূরতম অচেনা আকাশ হও তুমি

নীল ঘনত্বের শূন্যে উড়ে যায় ঘুড়ির জীবন

অবনত চোখের পাতারা নিষিদ্ধ জোনাকি ভূমি

চার্চের চূড়ায় কে যেন অশ্রু অক্ষরে লিখে যায়

গূঢ়তর বিস্ময় ভেঙে উড়ে আসে কোনো বালিহাঁস

প্রাণহীন বাসাগুলো ভাঙাচোরা দেহে টেনে চলে

তুমুল নগর বিপর্যয় , তখন চৈত্রের মাস

সেই কবে ফেলে আসা আমাদের অন্য যুগান্তর

স্কোয়ার ফিল্ডের গাছ ছয়লাপ অলৌকিক ফুলে

ঘন শান্ত ছিল সেই বীথি দীর্ঘ নির্জনতা তিথি

আদিগন্ত ছুঁয়ে ছিল কিশোরী সংলাপ ভুলে

সেদিনের ওষ্ঠাধরে বর্গফুটে ভালবাসা কত

অর্থহীন জরিপের ফিতে, নীরবতা সাক্ষী তার

জলপাই শাড়ি মনে আছে বেহিসাবী সময়ের

এত আলো চারিদিকে তবু এই ঘর অন্ধকার I

ছেলেটা ছুটছে পায়ে বল নিয়ে ড্রিবলিং

বাঁ পায়ে তার অমরত্বের ডজ

শরীরের দোলে বিপক্ষ কুপোকাত

গ্যালারি দেখছে বিদ্যুৎ বেগে শট।

বলে শট নয়, যেন বর্শার গতি

হাওয়া কেটে ছোটে, নিশানাটা মাপা, স্থির

টিভি পর্দায় বিমোহিত সারা বিশ্ব

নীল আকাশেতে ওড়ে সাদা গাঙচিল।

একবার নয়, সেমিতেও সেই রিপ্লে

রাতঘুম ভেঙে রূপকথারাও জাগছে

বল পায়ে ছোটে ফুটবল রাজপুত্র

সবুজ মনেতে হাজারটা তারা ফুটছে।


এই ছায়াপথে কতশত তারা ফুটবে

সবুজ মাঠেতে তারাও ফোটাবে ফুল

তবুও দিয়েগো, ছিয়াশির রাজপুত্র

তোমার জাদুতে বাকি সব ভুল, বিলকুল।

ওই জাদুতেই গ্যাালারিতে ঢেউ ওঠে

মেক্সিকো থেকে কলকাতা দুলে যায়

এক দৌড়ে হাজার স্বপ্ন জাগে

শিখা হয়ে জ্বলে মশালে মশালে ধায়।

সে তো গোল নয়, আকাশেতে ঘুড়ি ঘূর্ণি

স্মৃতি সরণিতে মেঠো রাজ ফিরে আসে

শিশু উচ্ছ্বাসে জাদুগর ডানা মেলে

অ্যালবামে শুধু মুহূর্তগুলো ভাসে।

(Between the dog and the wolf I am standing on the verge of  border

 i.e between terrestrial world and subtle world)

 

বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি

           আর ভুল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

মনুষ্যলোক ছাড়িয়ে যে কল্পলোক হয়তো রয়েছে—

সেখানে পৌঁছোনোর অদম্য ইচ্ছে।

 

এই সীমান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলা বারণ

এখানে শব্দের নাম দৃশ্য

এখানে দেখার নাম অনুভব,

এমন একটা আনন্দ আর আলোকময়তা

আমাকে টানছেচুম্বকের মতো !

 

আর একটু পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সূক্ষ্মপথে

সে পথের গন্ধে কী আনন্দ।

প্রভুযারা ভালোবাসেযারা বাসে না—সবাইকে ভালো রেখো !

কেমন আছো তিলোত্তমা?

তিল মাত্র সুখের খোঁজ দিতে পারো?

বা, নিদেনপক্ষে স্বস্তির এক পল?

তোমার ঝলমলে রোশনাই 

মায়াবী বিলাসিতার ইচ্ছে ফানুস ছুঁতেই আলপিনের খোঁচা।

দেখি নিঃশ্বাসেও অনুশাসন!

হাঁফ ধরে যায় 

সামাজিকতাও অঙ্কের কথা বলে।

একলা মনে ভাবতে গিয়ে দেখি

কল্পনার জমিতেও ক্যাকটাস।

সুখের কাঁথায় কফিনের জ্যামিতি।

গুঁড়িয়ে যাওয়া জীবনে কনামাত্র খুশি,

তাও ভেসে যায়–

বয়ে যায় ভাগীরথী।

জীবন বীমায় জমানো সুখ

বেচে দেওয়াই ভালো।

ফেরিঘাটে, বাস-ট্রামে

অস্থির স্নায়ুরা বেপাত্তা 

চাকা ভাঙা রথে সময় খুঁড়িয়ে চলছে।


তিলোত্তমা?

হাঁটবে নাকি আমার সঙ্গে দু’কদম?

বসন্ত কেবিন কিম্বা জেলে

পাড়ার সঙ-এর মাঠ?

চলো আমরা চুল্লির পাক খাওয়া ধোঁয়া দেখি, দূর থেকেই না হয়–

তুমি বরং গুনে নিও কতগুলো টিপ তোমার সাজের বাক্স থেকে হারিয়ে গেলো 

এক, দুই, তিন…

হে মাতৃভূমি

এমন ভূমি তো চাই নি,

যেখানে তোমার কন্যাদের

এতটুকু স্বাধীনতা নেই

যেখানে বর্বর ভাবে তোমার

কন্যাদের অপমান অত্যাচারিত

হতে হয় 

যেমনটা হয়েছিল যুদ্ধে

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর

হাতে!

যেমন করে পাকিস্তানি হায়নাররা

বন্দুকের নল দিয়ে খুঁচিয়ে ধর্ষিতা নারীর

যৌনাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত করেছিলো,

আজ এই মাতৃভূমিতে আবার সেই

ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।

তুমি কি একবারও পাকিস্তানি

বীজদের চিনতে পারো নাই?

আজ এই দেশ ধর্ষিতা নারীর

রক্তাক্ত ভূমি 

আজ আমরা নারীরা ক্রমশঃ তলিয়ে

যাচ্ছি আঁধারে 

প্রতিমুহূর্তে বুকের ভেতর একটা ভয়

কাজ করে ঠিক ভাবে বাড়ি ফিরতে

পারবো তো 

কিংবা আমার কন্যা সন্তানকে

আলোর বর্তিকা জ্বালিয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবো তো?

আজ সাহসী পুরুষ রা  হায়নারদের

হাত থেকে তোমার কন্যা…

রাতে ফোটা সাদা ফুলের মতো

জেগে থাকি আমি জেগে থাক তুমি

সাথে, অংকের ডান দিক চেপে

শূন্যের মতো মালবিকা ;

বুনো ফুলের মতো সরল, সে মালবিকা


তুমি নাকি দেখেছিলে তাকে সন্ন্যাসী আলোয়

কনে-দেখা পশ্চিমের রোদে

কিংবা কোনো এক দুপুরে

নাকের ওপর স্ফটিক গুঁড়োর মতো বিন্দু বিন্দু ঘামে

মালবিকার মুখ যেন ঈশ্বরী

আমার শ্বাস ভারী হয়ে আসে

ভেতরে ছেঁড়া পালক কেঁদে কেঁদে ওঠে

আর

তারপর নদীগুলোতে বন্যা আসে

জমিজমা সব হারিয়ে হই এলোমেলো

আর তোমাকে ঈশ্বর করে

আমি মনে মনে হয়ে উঠি

যদি ভুলিয়ে দিতে চাই নদীর মতো

এক কোনে ফেলে রেখে যাই

আবেগে মাখা যন্ত্রণাগুলো ?

যদি প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসে হত্যা করি

অপেক্ষার প্রহর, প্রতিক্ষণে ?

যদি পার হয়ে যেতে হয়

সেই অজানা মাতালকরা সুরধ্বনি

যার তারের ঝংকারে বাজতে থাকে

করুন রাগিনী ?

ছিঁড়ে ফেলি যদি সেই পালক হালকা ওড়নাটা,

যা দিয়ে লজ্জার নিবারণ হয় আমার ?

যদি ভুল করে সরিয়ে দিই যাবতীয় সংকোচ

নিরাভরণ এক আকুতির আনন্দাশ্রু ?

কি চাই  জীবন থেকে,

যদি চিৎকার করে বলতে থাকি, অকপটে?

কোথাও বুঁদ হয়ে থাকা আপন অন্ধকারটুকু-

জ্বালিয়ে রাখি যদি প্রেমের মশাল হিসাবে

নিজের গোপন কুঠুরিতে?

কি করবে সেদিন, যে দিন দেখবে

সব আরাম অতিক্রম করে এক অমানুষিক হাহাকার

উঠছে মননরূপী মহাসমুদ্র থেকে

তীব্র গর্জনে জেগে উঠছে সমস্ত নিকষ রাত ,

রক্তের প্রতি ফোঁটায় বেজে উঠছে তার

পেয়ে না পাওয়ার শীৎকার, বজ্রের মতো |

সত্যের প্রতিধ্বনি সে যে অমোঘ

জানান দেবেই নিজস্ব অভ্যাসে ,

প্রশান্তি আসবে কি ?

নাকি দহন যন্ত্রণায় প্রতিষ্ঠা পাবে

যত্নের বদলে ভালবাসার শেষ আহুতি?

হাজার কথা শুনেও যখন

মৌন থাকো মনে,

তোমার চোখের নীরব ভাষা

শুনি আজো গোপনে।

যতোই আসুক রাত্রি ঘিরে

আঁধার করো দূর,

একলা রাতে তোমার বুকে

বাজাই বসে নূপুর।

এই সময়ের ধূসর পটে

আর এঁকোনা গ্লানি,

শ্রাবণ শেষের বৃষ্টি মেখেই

আসবে তুমি জানি।

ঝিঙে ফুলের হলুদ আভা

সবুজ ক্ষেতের পাশে,

তোমার মনের ফাগুন কথা

হাওয়ায় শুধু ভাসে।

মন ছুঁয়েছে তোমার পরশ

আসবে তুমি কবে,

দিইনি প্রাচীর মনের মাঝে

তুমিই শুধু রবে।

জীবন এখন মরুভূমির ক্যাকটাস

হিয়া ভট্টাচার্য্য

বাঁচতে হয় তাই বাঁচছে জীবন

আসলে এটা ঠিক বাঁচা নয় !

সত্যি বলতে একজীবনে মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্যই বাঁচার মতো করে বাঁচে

আর বাকিটা অভ্যেস !

এই যেমন

ব্যস্ততায় তালা বন্দী স্মৃতির আলমারি !

দিন যায় , রাত আসে …ফেলে আসা অন্ধকার ব্যালকনি

বুকের মধ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠে !

যে চোখের জল সহ্য হতো না এতোকাল

সেই চোখেও হয়তো আজ ভরা শ্রাবণ

এদিকে অসময়ের বৃষ্টির কারণে শুকনো চরের ভিতর দিয়েও

বয়ে চলছে চোরা স্রোত 

জীবন এখন ঠিক যেন মরুভূমির ক্যাকটাস !

এখন শুধু অপেক্ষা এই ক্যাকটাসের ফুল ফোটার !

শ্রদ্ধেয় ঈশ্বর,

আপনার সাগর থেকে এক আঁজলা জল, প্রথম তুলে দিয়েছিল আমার মা। বলেছিল যত্নে রাখিস, সঠিক ভাবে ব্যবহার করিস। একে যত ভালোবাসবি, দান করবি ততই স্বচ্ছ হবে আর বৃদ্ধি পাবে। আমি বিস্ময়ে বলেছিলাম  এটা কি ম্যাজিক জল?!” মা হেসে বলেছিল, “ বড় হলে মিলিয়ে নিস।  সেই জলকে ধরে রেখেছিলাম সযত্নে, আমার মনের আঁচলে। কী মিষ্টি, কী স্বচ্ছ, কী সুগন্ধি সেই জল। যত বড় হচ্ছি মার কথামত জলটাও সত্যি সত্যি ক্রমশ ম্যাজিক দেখাতে আরম্ভ করল। নিজের অজান্তেই মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেললাম গুণমান সমৃদ্ধ এই জলকে। আজ, ঘুম ভাঙতেই দেখলাম জল ভর্তি পাত্রটিকে কে বা কারা ভেঙে দিয়ে গেছে। হাহাকার করে উঠলাম। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা পাত্রটিকে নিয়েই ছুটলাম আপনার কাছে। দুহাতে ভাঙা পাত্রটিকে বাড়িয়ে ধরে দাঁড়ালাম, মাথা নত করে। আপনি নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে। সাগরের এক ফোঁটা জলও আজ পেলাম না। জানি, অশিক্ষিত বর্বর মানুষের অত্যাচারে, অপমানে আজ আপনি বিধ্বস্ত, যন্ত্রণায় কাতর। অভিমানের ঢেউ সাগর জলকে উত্তাল করছে প্রতি মুহূর্তে। বর্ণপরিচয় হীনদের পরিচিতির গ্রাফ আজ ঊর্ধ্বমুখী। সাগরকে ঘোলা করার দুঃসাহস যে পরীক্ষক দের—-পারেন না, হে বীরসিংহের বীর পুরুষ, আপনি পারেন না, তাদের ডুবিয়ে মারতে ?

নমস্কারান্তে

বিপন্ন সমাজ

হঠাৎ অনুরাধাকে সুটকেস নিয়ে বাড়ি আসতে দেখে অমলবাবু তো অবাক হয়ে গেলেন —।

তুই একা এভাবে? জামাই কোথায়?

 আমি চলে এলাম বাবা–

 অনুরাধার অসহায় মুখ বাপের মনে একটুও দয়ার সঞ্চার করল না– বরং ওর ক্লান্ত মুখটা তার ধৈর্যের বাঁধ আরও ভেঙে দিচ্ছে —- চলে এলাম? চলে এলাম মানেটা কি? গলার শব্দে ভেতর থেকে অমলবাবুর সাধ্বী স্ত্রী আর ছেলে অনির্বাণ বেড়িয়ে এলো–।

আধুনিক ছেলে অনির্বাণ বোনের হাতটা ধরে বলল– আয় ভেতরে আয়–।

ভেতরে আয় মানে? ওকে এক্ষুণি হাতে পায়ে ধরে আবার শ্বশুরবাড়ি রেখে আয়– এত বড়ো সাহস সুটকেস হাতে করে বেড়িয়ে এসেছিস– আর তোকে ওরা ঘরে নেবে?

অনির্বাণ বাবাকে ধমক দিয়ে বলল– তুমি একটু চুপ করবে? শুধু শুধু বেড়িয়ে আসার মেয়ে  নয়– আগে আমাকে দেখতে হবে কি কারণে  বেড়িয়ে আসতে বাধ্য হল?

 মনোরমা দেবী  মেয়ের চোখ মুখের অবস্থা দেখে মিনমিন করে বলতে গেলেন  মেয়েটাকে একটু জিরুতে দাও– জল খেতে দাও, তারপর না হয়– এই তুমি চুপ করবে? মেয়েমানুষের অত কথা বলা আমি পছন্দ করিনা– জানো না?

 হ্যাঁ জানি- নিজের ক্ষেত্রে তা মেনেও এসেছি– মরে  বেঁচে আছি  কিন্তু সন্তানের বেলায় তা পারবো না –।

পারবে না?

 না

 খুব সাহস হয়েছে তাই না?

হ্যাঁ শুধু বসে বসে মার খেয়ে তোমার এই অন্ধবিচার আমি দেখতে পারবনা  দরকার হলে মেয়ের হাত ধরে আমি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো–।

অনুরাধার চোখে ধারা শ্রাবণ  ওর দাদা মাথায় হাত রেখে বলল– কি হয়েছে রে? বল তো আমাকে?

অনুরাধা তখন পিঠের আঁচলটা সরিয়ে দাদাকে দেখালো– চমকে উঠল অনির্বাণ  একি রে? সমস্ত পিঠে লাল দাগ মোটা হয়ে কেটে কেটে বসেছে –।

 হ্যাঁ দাদা এরপর ওখানে থাকলে ওরা আমাকে মেরেই ফেলত–

অমল বাবু মেয়ের কথা শুনে রাগে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন  তা এভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসে আমার মুখ না পুড়িয়ে  মরে গেলেই তো পারতে–

মনোরমা দেবী বললেন  তুমি কি মানুষ –?

এই অশিক্ষিত মেয়েমানুষ তুমি চুপ করে থাকো– এটাই নিয়ম  বাপেরবড়ি এসে ওঠার থেকে শ্বশুরবাড়িতে মরে যাওয়া সম্মানের 

অনির্বাণ ওর হাত ধরে বলল– আয় আমার সাথে–

অনুরাধা ভয়ে ভয়ে বলল– কোথায়? তুই কি আমাকে দিয়ে আসতে যাচ্ছিস? তোর পায়ে পড়ি দাদা– অনির্বাণ ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল– তোর দাদা অত কসাই নয় যে তোকে মরবার জন্য  বাড়িতে রেখে আসবে- আমি বাবার হোটেলেও খাইনা যে পিতৃবাক্যকে শিরোধার্য করে নেব– আমি থানায় যাচ্ছি  তুই জানিস না তোর দাদা একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল  ওদের সবকটাকে জেলের ঘানি না খাটাই তো আমার নামও অনির্বাণ নয়–।

অমলবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন  অনি সাবধান  তুমি লায়েক হয়েছো জানি  তবে তুমি আমার ওপর দিয়ে যেতে পারো না– আমার বিচার বলে শত কষ্ট সহ্য করেও মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতেই থাকতে হয়  তাতে যদি মরেও যায় সবাই বলবে  মেয়েটা এত অত্যাচার সহ্য করেও মুখে রা কাটেনি– ওর সতী নামটাও বজায় থাকে–

 বাবা আমার বোনকে সতী হতে হবেনা- একটা সুন্দর জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার ওর আছে– তোমরা ওর কাছ থেকে তা কেড়ে নিতে পারো না–

 তুমি থানা পুলিশ করলে ওকে আর ওরা ঘরে তুলবে কোনদিন?

 ওরা কি তুলবে? আমি আর পাঠাবো না জীবনে ওখানে  তোমার চিরকালীন অন্ধবিচার নিয়ে তুমি থাকো  আমি আইনের বিচার চাই –।



এর চারবছর পরে দেখা যায় অনুরাধা ওর মাকে নিয়ে একটা সুন্দর কোয়ার্টারে আছে   এখন সরকারি চাকরী করে– দাদা ওর জীবনের মোড়টাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়েছে  ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মামলায় হেরে গিয়ে প্রচুর টাকার জরিমানা দিয়েছে আর স্বামী দুবছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল নারী নির্যাতনের অভিযোগে –।

অনুরাধার বাবা একা ঘরে এখনও বিরবির করে বলে যায় এরা আমার মুখটা পুড়িয়ে দিল একেবারে  কি করতে যে একটা মেয়ে জন্মেছিল—।।

আমি তোমাকে বলছি,

তুমি শুনছো?

তোমার মনে আছে তো সেদিনের কথা? মন আর পরিস্থিতির যুদ্ধের মাঝে এক ছিলাম। যুদ্ধের জায়গা ছিল মেট্রো স্টেশন, এক কিলোমিটারের মধ্যে।

বেশ তো ছিলাম দুজনে একসাথে। হঠাৎ করে কখন যে হারিয়ে গেল নির্মাল্য বুঝতেই পারলাম না। পথের শেষ ঠিকানায় এসে বুঝলাম অজান্তে সে হারিয়ে গেছে। আমার মাথার উপর সমস্ত আকাশ ভেঙে পড়েছিল আর মেঘগুলো চোখ দুটোকে অন্ধ করে দিয়েছিল। চারিদিক যেন অন্ধকারে ডুবে গেছে।

অন্তরের কথা শুনে ছুটে গেলাম, কিছুটা পিছনের দিকে।

নিজেকে সঁপে দিলাম স্টেশন মাস্টারের কাছে। উনি ঈশ্বর রূপে মনের কষ্টকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।

ততক্ষণে মন আর পরিস্থিতির যুদ্ধ তুঙ্গে। জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল নির্মাল্য এর উপর। শেষ পর্যন্ত জয় হল মনের। নির্মাল্য এর হদিস পাওয়া তে।

মনে পড়লো তো সবকিছু?

জানো আজ ঠিক পাঁচ বছর পরে আবার শুরু হয়েছিল তাদের দুজনের যুদ্ধ। ওদের যুদ্ধের মাঝে আমার অস্তিত্বের হিসেব কষতে শুরু করলাম। আর যাকে নিয়ে এই যুদ্ধ সেই নির্মাল্য।

আমার জীবন বিরাট একটা ভুলকে আঁকড়ে বেঁচে থাকবে, নিজের কথা না ভেবে। এটাই আফসোস। প্রতিমুহূর্তে শাস্তি দিয়ে যাবে এই যুদ্ধ। তুমি বলতে পারো যে, এই শাস্তির বোঝাটা কে সারা জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বিশ্বাস করো, সময়ের দাপটে ভুলেই যাই নিজের সত্ত্বা।

আচ্ছা বলতো, আমি খুব অপরাধ করি কি? হাসি, আনন্দ, মজা কে ভালোবেসে বেঁচে থাকি তাই! যদি তাই হয়ে থাকে, তোমাকে কথা দিলাম শুধরে যাবো।

একটা কথা শুনে স্বার্থপর ভাববে। তবুও বলছি সত্যিই আর পারছি না।

আমার মনে তে এতোটুকু ফাঁকা জায়গা নেই নতুন করে চিন্তাগুলোকে আশ্রয় দেবো। একেবারে অক্ষম।

আমার মধ্যেও তো আবেগ গুলো বেঁচে থাকতে চায়। যন্ত্র  তো চলতে চলতে হাঁপিয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। আর আমি তো……..।

যখন খবরটা শুনলাম নির্মাল্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। বার বার মায়ের মুখটা মনে পড়ছিলো। ঠিক আছে তো? অনেকবার ফোন করেছিলাম গলা শোনার জন্য।

জানো! নির্মাল্যকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কেন জানো? আমার থেকে হৃদপিণ্ডটা আলাদা হতে চাইছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাঁচার আশায়। আমাকে তখন মরলে চলবে না। যেমন করেই হোক বেঁচে থাকতেই হবে। আমার হাতের মুঠোয়

ফোন থাকতেও তোমাকে ফোন করতে পারিনি। কেননা, তুমি তো আমাকে নিয়ে চিন্তা শুরু করে দেবে। এই বোঝা কাকে বোঝাবো? নিজের কাছেই তো উত্তর ছিল না।

তুমি তো জানো আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী  শ্মশান ঘাটে, গঙ্গার ঘাটে,হাসপাতালে, থানায় যুদ্ধ করতে করতে মন প্রায় হেরে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে শুরু করেছিল। তখন ঈশ্বর তিন জনকে দেবদূত রূপে আমার কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। এই জন্যেই তো এতো ভালোবাসি। কোটি কোটি বিপদের মাঝে ঠিক উদ্ধার করেন। আজকে একটাই প্রশ্ন করেছিলাম যে, আর কত পরীক্ষা নেবে? পরীক্ষা দিতে দিতে শেষ হয়ে যাবো।

আচ্ছা তুমি তো আমাকে পাল্টিয়ে দিচ্ছো। মাঝে মাঝে নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয়। বুঝতে পারি এই পরিবর্তন। সময় লাগবে কিন্তু তুমি সফল হবে। দু- চারজন চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি।

নির্মাল্য ফিরে আসার পর একটা তফাৎ খুঁজে পেলাম। আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে। আমি নির্বিকার ছিলাম। তুমি তো সময় বিশেষে আমার ক্রোধ কে বন্দি করে রাখো।

যাই হোক, ঈশ্বরের দয়ায় মনের কাছে পরিস্থিতি হেরে গেছে। এটাই জীবনের পরম প্রাপ্তি।