কবিতা

১) অঞ্জনা দে ভৌমিক

২) অভিজিৎ সেন

৩) মীনা ঘোষ

৪) প্রলয় কুমার বিশ্বাস

৫) অঞ্জনা মুখার্জী ( ভট্টাচার্য  )

৬) মাধুরী বরগাঁও

৭) আশাবর্ষা

৮) জয়দৃতা সরকার

৯) হিমাদ্রী শেখর

১০) জয়তোষ ঘোষ

 

মুক্তগদ্য

১) অনুপম মিত্র

 

ভ্রমণ কাহিনী

১) তীর্থঙ্কর দে

ভিডিও

১) ঈশিত্রী চৌধুরী
২) প্রজ্ঞাময় মজুমদার
৩) আত্রেয়ী মজুমদার

ভোরের আলো উঠেছে ফুটে

ফাল্গুনী করেছে শয্যা ত্যাগ

দর্পণে প্রিয়তমার প্রতিবিম্ব ছায়া

সাগরের দিকে প্রবাহিত জাহ্নবির মত সুললিত অঙ্গমনলোভা রূপ

সাগর করেছে তার জলপান

নবীন বসন্তে আনন্দ -চঞ্চল প্রাণ।

 

পল্লবে রচিত ছিল বাসর

কৃষ্ণমেঘের গলায় দোলে 

হলুদ রঙের মধুক ফুলের মালা। নবমেঘের মধুর ধ্বনিতে যেন কত প্রসন্নতা!

 

জাগ্রত বসন্তে গোপনেঅন্তরালে ফুটেছে ফুল

ফাল্গুনীর আলোকচ্ছটায় সজ্জিত উদ্যানমুখরিত বাতাসনব পল্লবের মত রক্তাভ ঠোঁট

দীপ্তিময়ী সদ্যজাত বসন্তকন্যা,  সাধনায় তপস্বিনী।

 

সবুজের শঙ্খসুরে মুহুর্মুহু পুষ্পবৃষ্টি

নবীন বসন্তেউল্লাসে

কুসুম কোমল পা দুটি বৃষ্টিস্নাত ধুলোর উপর।

যতটুকু পেয়েছে সূর্য- কিরণ 

আলোকরশ্মী রাত্রিতে সমাদৃতা সে,

সে যেন প্রজ্জ্বলিত হোমাগ্নি

তপস্যা – প্রাঙ্গণে প্রবাহিত জলধারায়  আনন্দের জোয়ারে পলাশের রক্তিম আভায় আকাশচুম্বী।

জীবন যেন নুন আর পান্তাভাত

চাইলেই পাওয়া যায়,

অথবা ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় দূরে !

কোন অক্ষর দিয়ে তুমি লিখে দিলে জীবনের নির্মম অবিচার।

 

আমি সিসিফাসের মতো পাথর গড়িয়ে যাবো

জীবনের জন্য;

তবু অস্ত্র তুলে নেবো না আর হাতে

কত লাশ এভাবেই যাচ্ছে ভেসে চোখের জলে

তারা প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে আসে আমাদের প্রশ্ন মঞ্চে।

 

সারারাত জেগে তৈরী করো এক এক টুকরো মারণ-এপিগ্রাম

জীবন যাক হারিয়ে,  তাতে কী আসে যায় ?

শুধু অনুভূতিহীন শব্দের রঙ্গিন রেশম-তুলো যাও উড়িয়ে

জীবনের সঘোষ ট্র্যাজেডিঅধরাই থেকে যায় সঙ্ঘারাম-অন্ত্যমিলে ৷

 

ব্যথা আছে তাই জীবন আনন্দময়সত্য বটে

রাগ-রাগিনী সহ নেচে-বেজে চলে সকাল-সন্ধ্যে

বীরের মতো প্রমিথিউস চুরি করে আনে আগুন

রবীন্দ্রনাথ তাই যেতে চান না সুন্দর ভুবন ছেড়ে ৷

পৃথিবী যখন ঘুমায়নিঃশব্দে আমি যাই হেঁটে,

সূর্য ওঠে আর ডোবেমেঘের গায়ে

আঁচড় কেটে,

 

ঝড় এসে ঘর করে খালিউড়ে যায় প্রিয় ঠিকানা,

জ্যোৎস্নার বুকে নামে ঢলআমি তার

অব্যর্থ নিশানা,

 

ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্মৃতিরাএঁকে যায় অজস্র আল্পনা,

ঝরাপাতার চিবুক ছুঁয়ে উষ্ণ কফির স্বাদ,

আমাদের শুধু দিন গোনা …

হাড়ের কম্পন কমেছে কিছুটা,

শহীদের বেদী ফি-বছর সকলের ঘরে ঘরে এলে

বিধবা গাছেরাও ফুলবতী হয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেয়,

মুক্ত পাখিদের কলতানে ভাসে মুক্ত কোকিল।

 

যতই শোকার্ত হইতারাই অহংকার আমার বাংলা মায়ের,

জীবন দিয়ে মায়ের মুখোজ্বল করেছে আমার পরলোকগত সহোদর ভাই।

আগেও বহুবার তাদের রক্তমাখা শরীরে স্মিত হাসি দেখেছি

যখন পাখিরাগাছেরা আর সব জীবেরা নিজেদের ভাষায় সাবলীল,

আমিও গালে টোল ফেলে হেসেছি তাদের সাথে

কৃষ্ণচুড়ার লালে আমাদের সব রঙ মিশে গিয়ে এক হয়ে গেছিলো বহুবার।

 

কিন্তু এই একবিংশের এক রাতে স্বপ্নে দেখি তাদের মুখে বিষন্নতা,

যাদের জন্য তাদের এই বলিদানএত আত্মত্যাগ

তারাই স্রষ্টার কাছে ধার করা ভাষায় কথা বলে।

 

আর অবুঝেরা অজান্তেই গায়,

মায়ের ভাষায় মায়ের গান।

বড় দুঃসময়ে আছি আমরা

চারিদিকে মৃত্যু ভয় ,

ভাইরাস রং বদলাচ্ছে

সমাজে-রাষ্ট্রে ।

আমাদের অনুতে হৃদয়ের তন্ত্রিতে।

চেনা রংয়েও তাই বড় ভয় আজকাল।

আজকাল বড় ভয় মুখ খুঁজে পাই না বলে ।

প্রিয় ,

 

চিঠি কখনও কখনও বাতিঘর হয় !

এমন কথা আগুনের মাঝখানে

দাঁড়িয়ে আমি বিশ্বাস করেছিলাম ।

তোমাকে লেখা চিঠি

আমি হাজারবার কেটেকুটেটুকরো করে

ফেলে দিয়েছি ডাস্টবিনে।

আধফোঁকা দর্শনে আমার

কোনদিনই বিশ্বাস নেই।

পর্দানশীন আঁশটে গন্ধ

যাদের যৌবনে গেঁথে আছে

প্রতিবাদ হাতে করে তাদের

মৌনরোদ  আর বিপ্লবের আলো

আমার রান্নাঘরের ছোট্ট গন্ডিতে

এসে পড়েছিল।

উনুনে উল্টোনো হাঁড়ি আর অসমাপ্ত খিদে

ক্রীতদাস হয়ে আছড়ে পড়েছিল আন্টাকর্টিকায়।

উন্মুক্ত যন্ত্রণার দিন তোমাকে

উপহার দিতে চাই বলে

ছেড়ে এসেছি সুন্দর বাড়িতে একটি জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেস।

কোন কোন সময়স্বাভাবিক নয় এমন কিছু

ঘর আলো করে রাখে।

আমার চিঠিও তোমাকে অস্বাভাবিক  নদীপথ চেনাবে।

চিঠির উত্তর আমি চাইনা।

কারণ সব কিছুর উত্তর হয়না।

এভাবেই মৌন থেকো।

ইতি …….

আকাশের মাঝ বরাবর যতদূর চোখ যায়

উড়ে চলেছে একঝাঁক চিল।

নেই কলরবে হুংকারনেই আর্তনাদ;

নিশ্চিন্ত উল্লাসে ওরা ডানা ঝাপটায়।

 

পাশের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ হররোজ,

মধ্য-তিরিশ নীলশার্ট খেতে দেয় রোজ।

শালিক-টিয়েবুলবুলি-ফিঙে হলে হতো বেশ,

দুরাচারী চিল শেষমেশ!

 

ঘড়ি যখন বেলা বারোটার ঘন্টা বাজায়,

ছেলেটি দু-হাত ভরে খাবার নিয়ে ডাকে,আয়—

তৃপ্ত-আহার শেষে আকাশের নীল ক্যানভাসে

বৃত্ত বানিয়ে ওরা চলে যায় নিজ ঠিকানায়।

 

আজকাল কি ভাগাড়ে খাবারে ঘাটতি পড়েছে

না কি গোটা দেশ আজ পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে !

ওই সেই একটাই পথএকটাই গতি।

কিছু ভুল থেকে যায়যাতায়াতের পথে।

কিছু ফুল চোখে পড়ে না।

ঝরে পড়া পাতায় নজর দিতে গিয়ে,

পায়ের তলে পিষে যায় কিছু ঘাস।

এতে দুঃখের তো কিছু নেই ,

ওদের জন্ম তো এই কারণেই।

দীর্ঘশ্বাসসান্ত্বনা শুধু।

তারপর হঠাৎ একটা বাঁক আসে,

এখানে রাস্তা কঠিন-কংক্রিট।

কিন্তু ভুল থেকেই যায়।

ঠেকে যাই কততবু শিখি না কিছুই।

পথ এগিয়ে যায় আমিও এগোই।

তবুও একদিন পথ শেষ হয়সামনেই খাদ।

পা থেমে যায়পিছনে তাকাই,

ভুলগুলো বলেমনে পড়ে সেদিন ?

একটা গলি ছিল বাঁদিকেচোখে পড়েনি।

একটা বেগুনি ফুল ছিলচোখে পড়েনি।

কী জানি হয়তো কিছু মানুষও ছিল,

শুধু চোখে পড়েনি।

কেবল ছুটছি,

ছুটছি আর ডিঙোচ্ছি

ডিঙোতে হলে কখনও ল্যাং মারতে হয়

ল্যাং মারতে মারতে যখন তলানিতে পৌঁছে যাই

তখন নদীর কাছে আসি

নদীর বুকের মাঝে যে তিল –

তা থেকে কুয়াশা নিংড়ে আকন্ঠ ঢেলে নেয় মাঝি

দাঁড় টানেখোঁচা মারে নদীরই শরীরে

নেশায় বুদ হয়ে বোরোলী মাছেরা

চড়ের কাছে এসে শ্যাওলা খায়

যে ফাঁদ আমরা বসাই ঘুঘু-বগা

তাতে থুতু ফেলে এখন

যে জাল আমরা ফেলিতা দেখে

কুকুরও হায়নার মত হাসে

যাত্রা শেষে কেবল পড়ে থাকে অসাড় অসত্য ও

দেবীর পরিত্যক্ত কাঠামো

নদীর কাছে গিয়ে এভাবেই একটা আস্ত সমুদ্র,

আর হরিণ দেখতে গিয়ে আমরা বাছুর দেখে ফেলি।

অচেনা গলিপথের যে বাঁকেরেখে গেছো আমায়

সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি বহুদিন,

 লাউডগার  স্পর্শের দায়ে!

 

ল্যাম্পোস্টের নিচে আলো আর ছায়া

সারারাত খেলেচোখ ঢলে আসে তবুও,

 

 তুমি ছাড়া বসন্ত বুঝিনি,

আবির মাখিনি ঠোঁটের পাশে।

 

তুমি ফিরে এলেই বসন্তের সাথে বৃষ্টি,

বুকের ভেতর হাওয়া বয়ে ওঠে,

আবির দিয়ে বসন্ত বসন্ত খেলায় ঠোঁটের পাশে চিহ্ন আঁকি।

 

বড্ড ভুল হয় এই ভেবে,

বসন্ত দেখতে গিয়ে ভুল করে না তোমায় দেখে ফেলি!

“মনের খবর মন ই জানে” সত্যি আমরা শরীর খারাপ হলে চিন্তিত হই কিন্তু মন খারাপ হলে তাকে প্রাধান্য দেই না,  মন উদাস হলে আমরা তাকে বিলাসিতা বলে উপেক্ষা করি। আসলে মন এমন এক জিনিস যাকে আমরা দেখতে পাইনা কিন্তু প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করি। আনন্দে মন পুলকিত হয় আবার দুঃখে ব্যথিত হয়ে যায়। মন ও মানুষিক সুস্থতা ভীষন ভাবে জরুরি আমাদের নিকট।

মানসিক স্বাস্থের কথা বলতে গিয়ে বলতে হয় কার্ল মেনিজার (Karl Maninjar), তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেনমানসিক স্বাস্থ্য শুধু সন্তোষ জনক ভাবে অথবা আত্মা তুষ্টির মাধ্যমে নিয়ম অনুসরণ করার মধ্যেই সীমা বদ্ধ নয়এটি হলো সর্বাধিক কার্যকারিতা এবং আনন্দের সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের প্রক্রিয়া।

 W H O  এর ভাষায়-Health is a state of total subjective well being and mearly absence of diseases and disorder.

শারীরিক স্বাস্থ্য র সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা করার গুরুত্ব অপরিসীম।

আমরা কিছু সহজ উপয়ে মন ভালো রাখতে পারি যেমন —

 

সৃষ্টিশীল কাজে বা সৃজনশীল কার্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।

 

নিজেকে চিন্তা মুক্ত রাখাঅহেতুক অকারণ চিন্তা কে দূরে সরিয়ে রাখা।

 

নিজের কিছু সখ বা hobby তৈরি করাযা মনকে আনন্দ দেবে।

 

কোনো কিছুর উপর অধিক expectation না করা।

 

চাওয়া পাওয়া মধ্য সীমারেখা অঙ্কন করা।

নিজের সামর্থ্য সমন্ধে নিজে জানা।

 

নিজেকে সময় দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকা।

 

অনেক কথা যা বলতে পারছিনা তা Diary তে লেখা।  প্রয়োজনে কাউন্সেলিং এর সাহায্য নেওয়া।

 

নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর ও মনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।

 

মন ও শরীর  একে অপরের সম্পর্ক যুক্ত। উভয়ের ভালো থাকা জরুরি।

২০১৬ সালের বর্ষশেষের রাতে দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসা ধামসা মাদলের ত্রিদিম ত্রিদিম বোল আমাদের কাজিরাঙ্গা সফরকে আরো স্বপ্নিল করে তুলেছিল। বড়দিনের ছুটি আর নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের জন্য এবার বেছে নিয়েছিলাম কাজিরাঙ্গা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারিকে।

 

        কোচবিহার থেকে কাজিরাঙ্গা ৫৫১ কিমি পথ। ঠিক হলো গাড়ি চালিয়ে কাজিরাঙ্গা যাবো। ৩০ শে ডিসেম্বর ঘুম ভাঙলো সকাল ৬ টায়। গতরাতের  করা প্ল্যান অনুয়ায়ী আমাদের এই সময়ে রওনা হয়ে যাওয়া উচিত ছিলকেননা বেলা করে রওনা হলে সেই দিন আর কাজিরাঙ্গা পৌঁছানো সম্ভব নয়। কিন্তু  আমাদের বাড়ি থেকে বেড়োতে বেড়োতেই সকাল ৮ টা হয়ে গেল।  কোচবিহার থেকে স্টিয়ারিংটা প্রথমে আমিই ধরে বসলাম। আলিপুরদুয়ার কামাখ্যাগুড়ি বারোবিশা হয়ে সংকোশ নদী পেড়িয়ে ১ ঘন্টার কিছু বেশি সময়ে আমরা  অসম প্রবেশ করে গেলাম। কিছুক্ষণ আগেই ফোরলেন পেয়েছি। গাড়ির এক্সেলেটরকে আমার পা টা আজ একটু বেশিই প্রেস করছে। শ্রীরামপুর হয়ে অসম প্রবেশ করলে রাস্তার দুধারে যেন একটু বেশিই  ফাঁকা জমি দেখতে পাওয়া যায়। অসম বাংলা সীমান্তের এই জায়গায় বাড়ির থেকে পেট্রোল পাম্প আর ধাবার সংখ্যাই বেশি। প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা কোঁকড়াঝাড়ের আশেপাশে হাইওয়ের ধারের একটা ধাবায় দাঁড়ালাম জলখাবারটা সেরে নেওয়ার জন্য। যেহেতু একরাতের প্ল্যানে চলে এসেছিতাই কোনো রিসোর্টবাংলোহোটেল আমাদের বুকিং করা নেই। চা খেতে খেতে চললো হোটেলের খোঁজ। চা পানের পর আমরা আবার গাড়ি নিয়ে চলতে শুরু করেছিকিন্তু তখনো হোটেল বা রিসোর্টের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। সব জায়গায় ফুল। কোথাও রুম না পেয়ে আমরাও চিন্তিত। ঘড়ির কাঁটা সকাল ১১ টা পেরিয়ে গেছে। আরো প্রায় ৪৫০ কিমি পথ যাওয়া বাকি। এমতাবস্থায় বুকিং ছাড়া একটা নতুন জায়গাতার ওপর ফরেস্ট এলাকাকি করে যাই – চলতে চলতে এই আলোচনাই করছিলাম সবাই। গাড়ি নিয়ে একে একে বঙাইগাঁওবিজনিবরপেটা রোডহাউলি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি গৌহাটির দিকে। ইতিমধ্যে দুপুরের খাবারের সময়ও পেরিয়ে গেছে। রঙ্গিয়ার কাছে পেট্রোল পাম্প লাগোয়া রোডসাইড একটা ধাবায় ঢুকলাম খাবার খেতে। সমস্ত পদই হাজির হলো কাসার থালাবাটিগ্লাসে। ধাবাটি খুব পরিচ্ছন্ন এবং ভালো খাবার পরিবেশন করেছিলো। খাবার শেষে ঘড়িতে দেখলাম ৩.৩০ মিনিটউপরন্তু আমাদের কোনো বুকিং নেই কাজিরাঙ্গায়তাই ঠিক হলো আজ রাতটা গৌহাটিতে থেকে যাবো। এবার রঙ্গিয়ার ধাবা থেকে গাড়ি ছুটতে শুরু করলোশেষ বিকেলে আমরা গৌহাটি এসে পৌঁছলাম। পল্টন বাজারের একটি হোটেলে আমরা আজ রাতটা থাকবো বলে ঢুকে গেলাম।

 

        ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৭.৩০ মিনিটে আমরা গৌহাটির হোটেল থেকে বেড়িয়ে পড়লাম কাজিরাঙ্গার উদ্দেশ্যে। গৌহাটিতে এসে জোগাড় করা একটি হোমস্টের নাম্বারে ফোন করে আমাদের কাজিরাঙ্গার বুকিং কনফার্ম করলাম মিস্টার গগৈয়ের বাড়িতে। গৌহাটি শহর থেকে দিসপুর হয়ে গাড়ি আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছে। এই জায়গায় রাস্তার এপাশ ওপাশ একদিকে অসম একদিকে মেঘালয়। জোরবাট থেকে ডানদিকে শিলং বেড়িয়ে গেছেআমরা বাঁ দিকে এগিয়ে চললাম নগাঁওয়ের দিকে। চওড়া হাইওয়ে দিয়ে সকাল বেলা গাড়ি ছুটে চলেছে। একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম রাস্তার পাশে। বিশাল বিশাল চিতল মাছ নিয়ে গাড়ি দেখতেই চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছে জেলেরা। এমন দৃশ্য ভারতের আর কোথাও এর আগে আমি দেখিনি! অনেকবার পাশ কাটিয়ে গেলেও শেষমেশ দাড়িয়ে পড়লাম কৌতূহল বশত।  মাত্র ৩০০ টাকা দাম চাইলো! কিন্তু নেবার উপায় ছিল না। নগাঁও এর কাছাকাছি একটা দোকানে দাড়ালাম চা পানের জন্য। তারপর কালিবোড় হয়ে গাড়ি সোজা এগিয়ে চললো। কালিবোড় থেকেই বা দিকের রাস্তা তেজপুর হয়ে অরুণাচল যাচ্ছে। কাজিরাঙ্গা পৌছনোর ৫০ কিমি আগে পর্যন্ত ফোরলেন হাইরোডঅসম্ভব ভালো রাস্তা। শেষের ৫০ কিমি সিঙ্গেল রোডতাই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি। বাগুরি থেকেই দেখছি ফরেস্ট শুরু। কালো পিচ রাস্তার বাঁ দিকে কাজিরাঙ্গা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি আর ডানদিকে ভীষণ সুন্দর সুন্দর বিলাসবহুল কটেজবাংলোরিসোর্ট। রাস্তার দু ধারে শিমুলশিশুহিজলগামার প্রভৃতি বৃক্ষরাজি রাস্তার আরো শোভাবর্ধন করেছে। এই ফরেস্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ১২.৩০ নাগাদ আমরা কাজিরাঙ্গার সেন্ট্রাল রেঞ্চ কোহরা পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে দেখি ২.৩০ মিনিট থেকে জঙ্গল সাফারি। হাতে রয়েছে ২ ঘন্টা। এই সময়ে আমরা কোহরার একটি হোটেলে ভাত খেয়ে নিলাম এবং আমাদের লোকেশন জানিয়ে গগৈ বাবুকে ফোন করে তার বাড়ির ঠিকানাটা ভালো করে বুঝে নিলাম। ২.৩০ মিনিটে আমাদের জঙ্গলে জিপ সাফারি শুরু হলো। ঢুকতেই যেটা চোখে পড়লো অরণ্য কিন্তু তেমন ঘন নয়। গাইড জানালো ৬৬ ঘাস জমি২৭% অরণ্যবাকি অংশে রয়েছে বিল। ভাগ্য ভালো থাকলে ডিসকভারি চ্যানেলে যেমন পশুপাখি দৌড়েতে দেখেন এখানেও তেমন দেখতে পেতে পারবেন। প্রথমেই জঙ্গলের রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাবার সময় কাজিরাঙ্গার বিখ্যাত একশৃঙ্গ গন্ডার দেখতে পেলাম। চোখে পড়লো হরিণওয়াইল্ড বাফেলো। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট ফরেস্টের ভেতরে ঢোকার পর আমাদের জিপ একটি ওয়াচ টাওয়ারের সামনে এসে দাড়ালো। এই টাওয়ার থেকে প্রচুর গন্ডার চোখে পড়লেও বাঘহাতি অধরাই থেকে গেলো। এরপর জিপ আবার চলতে শুরু করলো ফরেস্টের ভেতরে মাটির রাস্তা দিয়ে। আমরা চলে এলাম আরো একটি ওয়াচ টাওয়ারের সামনে। এই টাওয়ারের সামনেই রয়েছে বিশাল জলাশয়। টাওয়ারের চারিদিকের  প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভীষণ সুন্দর এখানে। এখানে থেকে বহু দূরে বাইসনের দেখা মিললোএছাড়াও প্রচুর পাখি দেখতে পেলাম। ২ ঘন্টার সাফারি শেষে বেড়িয়ে এসে গাড়ি নিয়ে আবার ন্যাশনাল হাইওয়েতে  উঠে এলাম। কোহরা থেকে জোড়হাটের দিকে এক কিমি এগোলেই আমাদের ঠিক করা হোমস্টের ঠিকানা। এই ন্যাশনাল হাইওয়ের বাঁ দিকে কাজিরাঙ্গা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি আর ডান দিকে বিভিন্ন রিসোর্টস্থানীয়দের বসত বাড়িদূরে কার্বি পাহাড়। স্থানীয় অর্থনীতির একটা বড় অংশ পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এখানকার বাড়িগুলোতে অনেকেই হোমস্টের ব্যাবস্থা রেখেছেনকেউ কেউ জঙ্গলের গার্ডগাইডের কাজ করেনআবার কেউ জঙ্গল সাফারির জিপ চালানজিপ কিনে ভাড়া দেন। এই কাজিরাঙ্গাকে কেন্দ্র করেই তাদের রোজগার। ফরেস্টের পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়াল ব্রক্ষ্মপুত্র মাঝেমধ্যেই বন্যায় পশুপাখি সহ মানুষজনের জীবনযাপনকে ছন্নছাড়া করে তোলে। সাফারি শেষে ৩৭ নং ন্যাশনাল হাইওয়ের ডানদিকে রাস্তা থেকে মাত্র ২৫ মিটার দূরে গগৈজীর হোমস্টেতে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ ঢুকে গেলাম। চাবিস্কুট দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো মিস্টার গগৈ এবং তার পরিবার। একটি ছোট দোতলা বাড়ি। নীচতলায় গগৈজীরা থাকেনআর ওপরের তলাটি বরাদ্দ হোমস্টের গেস্টদের জন্য। চা খেয়ে আমরা ওপরের তলায় আমাদের রুমে ঢুকে গেলাম। রাস্তা দিয়ে একের পর এক গাড়ি যাচ্ছেতার স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘর থেকে। রাস্তাটা একবার দেখবো ভেবে বেড়োলাম। বাইরে এসে দেখি নিকষ কালো অন্ধকারে এই জঙ্গলপথ  ভেদ করে গাড়ি গুলো একে একে এগিয়ে যাচ্ছে জোড়হাটশিবসাগরতিনসুকিয়াডিব্রুগড়ের দিকে। রাস্তা একদমই ফাঁকা শুধু দূড়পাল্লার গাড়ি ছুটে চলেছে। এই অন্ধকারে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর সাহসই হলো না। আমরা যে বাড়িটিতে উঠেছি তার পাশের বাড়ির বাচ্চার মহা আনন্দে পিকনিক করছে সেই বাড়ির উঠোনে – ওটাই ওদের বর্ষবরণের আয়োজন। ওদের আনন্দ দেখতে দেখতে চলে এলাম রুমে। রাত ৯ টার মধ্যেই গগৈজী খাবার খেতে ডাকলেন। আমরা নেমে এলাম সকলে। এই প্রথমবার ঢুকলাম তাদের ঘরেবেশ সুন্দর সাজানো বাড়ি। দূর পাহাড় থেকে ধামসা মাদলের ভেসে আসা শব্দে পরিবেশটা  যেন আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো। বছরের শেষ দিন অসমীয়া পরিবারের হোমস্টের আতিথেয়তা মুগ্ধ হলাম সকলে। যথেষ্ট ভালো মানের  সমস্ত খাবার পরিবেশন করলেন গগৈজীর স্ত্রী। সমস্ত রান্নাই তিনি নিজে হাতে করেছেন। যথেষ্ট তৃপ্তি সহযোগে আমরা রাতের খাবার খেলাম। খাবার খেয়ে ওনাদের  গুডনাইট জানিয়ে রুমে চলে এলাম সকলে। নতুন বছরে সকাল ৬.৩০ মিনিটে গগৈজীদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘন কুয়াশায় ১ কিমি এগিয়ে এসেই কোহরা গেটে পৌঁছে গেলাম। সকাল বেলা কিছু দোকানপাট খুলছে দেখে আমরাও একটু দেখে নিলাম বাজারটা। অবশেষে লং ড্রাইভ করে রাত ৯ টার পর কোচবিহারে বাড়ি এসে পৌঁছলাম।

কবিতা

উদয় সাহা

তাপস দাস চৌধুরী

রৈবতী বন্দোপাধ্যায়

জয়তোষ ঘোষ

ছোটগল্প

ঈদারুল ইসলাম এবং সঞ্জয় মল্লিক

নিবন্ধ

উৎসব ও পরিবেশ দূষণ : ড. তপন দাস

বেলা পড়ে আসছে

আবারো একটা রাত-জাগা রাত

 

যেভাবে মদ মিশে যায় রক্তের সাথে

শব্দহীন বিষণ্নতা মিশে গেছে হিমগর্ভ রাতে

 

যে বটগাছকে উইকেট বানিয়ে খেলেছি বালুকাবেলায়

তার ছায়ায় বসে থাকি বোকা জাদুকরের মতো

 

আমার শহর ঘেঁষা বোতামে আটপৌরে পারিপট্য

খোলা হাওয়ায় শুধু স্মৃতিরা খুশিয়াল

 

কী শীতল এই অস্তরাগের উরুসন্ধি!

 

বেলা পড়ে আসছে

তেতো রাতের পরে আরো উজ্জ্বল হবে

তোমার নখের মতো চাঁদ

 

একটু উপশম চাইছি কিংবা উপশমগান

তেতো রাতে স্বপ্নেরা জিরোতে চায়খামোখা    

তোমার মনের সীমান্তে,

কাঁটা-তারের বেড়া,

আমার বিগত ফাগুনের—

পলাশরা লাল রঙ ছুঁয়ে দিয়েছে তোমার সীমন্ত। 

লাইটহাউস  থেকে দেখতে পারা যাবে

মন-দরিয়ার ঢেউ!

বিউগলের শব্দে ঢাকা পড়ে —-

তরঙ্গের আরক্ত ছলাৎ-ছলাৎ আর্তনাদ!

কাজলে লেপ্টে যাওয়া আমার বুক,

নোনা স্রোতআমার জামার, 

কাঁধ বেয়ে নেমে আসে আর্দ্র অভিমানে।

তবু ও! তুমি নীলনদ হতে পারলে কোথায়!

আমি তো আজ ও সাহারায়

এক চাতক হয়ে আছি।

সেই মেয়েটি এখন আর হাসে না,

কথা গুলো চুপ কথা হয়ে গেছে,

কে যেন ব্যস্ত জীবনটায় ছেদ টেনে

দিয়েছে,বাইরে আঁধার কালো রাত ,

রাত জেগে সেই মেয়েটি ঝির ঝির

বৃষ্টির শব্দ শোনে,

রেলগাড়ি চলে যায় ,বাতাসে শব্দ

ভাসে ঝমাঝম,

সেই মেয়েটি মুখ ঢেকে কাঁদে,

তার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে

এই রেললাইন,রতন এখন নিঃশব্দে ঘুমায়।

শীতের সকালে আলোর মতো

ছুঁয়ে চলে গেছো তুমি!

 

বসে রই জল,  হাওয়া আর

পাখির গান নিয়ে। আমার হৃদয়

 আর বেঁকে উঠা গাছের এডাল

ওডাল করা পাখিকে এক সুতোয়

গেঁথে দেখি শূন্যতার নীল ছবি।

 

ভেতরের ভেঙ্গে যাওয়া মনটা

বাইরের ঠোঁটে বুলেট গানের মতো

হাসি ছুঁড়ে দেয় !

সন্ধ্যা রক্তাক্ত অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চারিদিকে বহু লোকের কোলাহলকিন্তু বারংবার ওঠার চেষ্টা করেও কিছুতেই সে উঠতে পারছে না। কিন্তু কেন এমন হচ্ছেশরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাতটা বাড়াবার চেষ্টা করেও বিফলে যাচ্ছে। ওই তো পাশেই সম্পূর্ণ গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে উল্টে আছে আর পিছনের সিটে বসে থাকা এক সহকর্মীর উপরের অংশ পুরোপুরি থেঁতলে পাশেই মরে পড়ে আছে। অনেক কষ্টে মুখ তুলেই সামনে ড্রাইভার তপেশের নিথর দেহডঃমল্লিক সহ আরো দুজনের রক্তাক্ত দেহ কয়েকজন মিলে এম্বুলেন্স-এ তুলে দিলেও সন্ধ্যার আওয়াজ কেউ শুনছে না কেন! অনেকক্ষণ চেষ্টা শেষে সে চিৎকার করে ওঠেঠিক এমন সময় সেলফোনটা বেজে উঠতেই দুচোখ খুলে নিজেকে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় পায়। ফোনটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে মাধবীর আওয়াজ-

— হ্যালোসন্ধ্যা দি তুমি কোথায় জানো আজ স্যারের গাড়িটা একসিডেন্ট করেছে আর ড্রাইভার সহ মৌমিতার স্পট ডেথ হয়েছে। ডঃমল্লিক স্যারের অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল আর অনীক ও মৈনাকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

— বলিস কি ! অফিস থেকে ফিরে একটু চোখ লেগেছে ঠিক এমন সময় আমি তো এগুলোই দেখছিলাম। আমিও রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছিআর চারিদিকে এত মানুষের ভীড়ে কেউ আমার আওয়াজ শুনছিল না !

— হ্যাঁগো। তুমি তো একটু কাজ বাকি ছিল বলে ওই গাড়িতে যাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দিলে।

— হ্যাঁ রেআমি একটু পরেই বেরিয়ে একজনের বাইকে গ্রামের রাস্তায় তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছি। বিছানায় শুয়ে কখন যে চোখ লেগেছে বুঝতে পারি নি।

— সত্যিই তোমার কপাল আজ ভালো ছিল। মাঝ রাস্তায় দুজন নেমে যাওয়ার পর আমি বাড়ির সামনে নেমে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পরেই দুম করে একটা আওয়াজ শুনতে পাই। চোখ ফিরিয়ে দেখি বোলেরো গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে উল্টে আছে আর চারিদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি সবই শেষ !

 

জীবন মৃত্যুর মাঝখানে যে ফ্রাকশন অফ সেকেন্ডের ব্যবধান সেটাই চিরন্তন সত্য। এই যে তুমি গাড়িতে উঠতে চেয়েও উঠলে না বা আমরা যারা একটু আগেই গাড়ি থেকে নেমে গেছিহয়তো আমাদের কারো সময় আসে নি অথবা এই সময়ের ব্যবধানে প্রাণে বেঁচে গেছি।

ষাটোর্ধ্ব সতীশ দাস। রেললাইনের ধারে ঝুপড়িতে বাস। ঘরে স্ত্রী ও ষোড়শী কন্যা লতা। ঘাম ঝরিয়ে লতার জন্য ঘুম কিনে আনেন।

      দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থ । ওষুধ ও খাবারের তাগিদে লড়াইয়ে লতা । সারা শহর কাজের জন্য ছুটে বেড়ায়। কাজ মেলে না ! আশার আলো এক বাবুর প্রস্তাব- 

কাজ আছে। আমার বিছানায়। করবি ?

     বুকের তপ্ত হাড় দাউ দাউ করে দাবানল। লতা দেখতে পায় স্বপ্ন আঁকা ঘুড়িটা ছিঁড়ে পড়ছে অন্ধকারের খনি গর্ভে। ঘরে অসুস্থ বাবা কাতরাচ্ছে। মা চোখের জল ফেলছে। কাজ না পেয়ে হতাশ লতা ! একমাস বাদে ওই বাবুকে-

    – আমি রাজি। আমায় কাজে নেবেন ? 

   বাবু হেসে- 

   পাখি আয়। জানতাম  আসবি। 

       লতা কথা বলার শক্তি হারায়।

   রোজ সন্ধ্যা থেকে রুচি মত বিছানায়। এটাই কাজ

    লতার পা কাঁপতে থাকে। চোখ বন্ধ করে অসুস্থ বাবাকে দেখতে পায়।

    – পারবি তো?

    –হ্যাঁ। আমাকে পারতেই হবে !

   কাজ চলে,নরম শরীর কুঠারাঘাতে বিদ্ধ হয়। ঘরে খাবার আসে,ওষুধ আসে। মা-বাবা খুশি। মেয়ে চাকরি পেয়েছে। মনের আকাশে মেঘ সরিয়ে  সূর্যোদয় হয়। একমাসেই অসুখ সেরে যায়। লতা নিজের গোপন গল্প গোপনই রাখে। 

      মা-বাবা জন্মদিনে কেক কেটে লতাকে সামান্য আনন্দ দিতে চায়। কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায়  গোপনে আয়োজন শুরু করে।

      আজ আগেই ছুটি পেয়েছে লতা। শরীরটাও খারাপ। বাবু বাড়িতে ছেড়ে দেবে 

     তুই বিছানায় থাক। রিক্সা দেখছি

       জীর্ণ চাদর জড়ানো এক বৃদ্ধ 

     এই রিক্সা,যাবি ?

     না। তাড়া আছে ।

     যাবি না ৩০ টাকা ভাড়া। ৫০ টাকা দেব

     কোথায় যাবেন ?

     – ওই বস্তিতে

     তবে চলুন।

     – দাঁড়া । আসছি।

      শীতে চাদরে মুখ ঢেকে লতা। রিক্সা ধীরে ধীরে ঝুপড়ির কাছে পৌঁছয়

     – বাবু,আজকের টাকাটা দিন

     – দিচ্ছি,দিচ্ছি । আজ কিন্তু  কম সময় দিয়েছিস ! আগামীকাল ফ্ল্যাটের বিছানায় শুধু তুই আর আমি

      বাবু লতার হাতে ২০০ টাকা দেয় ।

      লতা রিক্সায় বসেই-       

    –বাবা,দরজা খোলো।

      অনেক ডেকেও আওয়াজ নেই !

    –বাবা ! ও বাবা ! কী হলো দেখো আজ কত তাড়াতাড়ি এসেছি ! 

     শেষে রিক্সাচালকের সিট থেকে-  

    –লতা ! মা ! মা আমার !

     চোখের জল গড়িয়ে পড়তে থাকে রিক্সার হ্যান্ডেলে ঝোলানো জন্মদিনের কেকের প্যাকেটে । সুখের ঢেউগুলো দুঃসহ ঘূর্ণিঝড় হয়ে ফিরে আসে।

কাশ্মির থেকে কন‍্যাকুমারী অথবা কচ্ছের রন থেকে ইটানগর মানুষ যে প্রান্তের ই হোক না কেন আনন্দ উৎসবে মেতেওঠা এটি একটি সাভাবিক প্রবৃত্ত্বি। তা সে উৎসব যে উপলক্ষেই হোক না কেন। উৎসবে মেতে উঠতে কার না ভালো লাগে। উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে আমরা ভুলে যাই আমাদের পরিবেশের কথা। আমাদের বারোমাসে তের পার্বন এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনদিত বিভিন্ন উৎসব। উৎসব পালনের মাধ্যমে পরিবেশ কি ভাবে দূষিত হচ্ছে এই বিষয়েই আলোচনা করব।

প্রথমেই আসি শব্দ দূষণের কথায়। উৎসবের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিবিড়। উৎসব হবে অথচ শব্দ দূষণ হবে না তা হতেই  পারে না। উৎসব মানেই চড়া সুরে মাইক বাজবেডিজে বাজবে তবেই তো উৎসব জমজমাট। সেই আওয়াজ ছাড়িয়ে যাবে কয়েকটা 65 ডেসিবেল। দূর্বীসহ হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষের জীবন যাপন। বাদ্ যাবেনা সদ্যজাত শিশু  কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত প্রবীণ নাগরিকও। এইটুকু তো মানতেই হবেউৎসব তো আর প্রতিদিন হবেনা না। আজকাল শুধু দেওয়ালী উপলক্ষেই বাজি পটকা ফোটানো হয় এমন টা নয় কোনকিছুর শুভ উদ্বোধন থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের শনি পূজা সবেতেই বাজি ফাটানো যেন একটা রীতি। প্রশ্ন করলে উওর একটাই মেলেএটা কি আর প্রতিদিন হয়। সঙ্গে থাকছে বায়ু মাটি ও জল দূষণ। বাজিপটকা থেকে  যেসমস্ত পদার্থ বের হয় তা জলমাটিতে মিশে পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। 

একটি পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে দেওয়ালীর পরে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন কণার পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ২৩২.৬ মাইক্রোগ্রাম বাড়েসালফার অক্সাইডের বাড়ে ৪৮.৭ মাইক্রোগ্রাম এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে ৩৫.৩ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারে। বাজি পটকা বানাতে ক্লোরেটপারক্লোরেটপটাশিয়াম নাইট্রেটের সাথে থাকে কার্বনসালফার। ফ্লাস উৎপাদনের জন্য থাকে বিভিন্ন ধাতব লবন যেমন সোডিয়াম ক্লোরাইডব‍্যারিয়াম ক্লোরাইডস্টোনসিয়াম নাইট্রেট ইত‍্যাদি। এই ধাতব আয়নগুলি হলুদ সবুজ লাল বিভিন্ন রঙ উৎপন্ন করে। বাজি পটকা পোরানোর পর বিক্রিত ও অবিক্রিত পদার্থ গুলি পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সাথে মিশে যায়। উৎপন্ন সালফার ডাইঅক্সাইডে শ্বাসকস্ট হয়নাইট্রাইটের প্রভাবে চোখ জ্বালা শুরু  হয়লেড এর প্রভাবে নার্ভাস সিস্টেমের ব‍্যাঘাৎ ঘটে। কপার শ্বাসনালির ক্ষতি করেক‍্যাডমিয়াম কিডনির ক্ষতি করেম‍্যাগনেসিয়াম ও অ্যলুমিনিয়াম এর প্রভাবে এলজাইমার রোগ হতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে এক দুদিনের উৎসব উপহার দিচ্ছে অনেক কিছু।

‌এবার আসি জল দূষণের কথায়। কৃষি কাজে ব‍্যবহৃত কীটনাশক ও বিভিন্ন রাসায়নিকের ব‍্যবহার কিংবা শিল্প কারখানার বর্জ‍্য পদার্থ যেমন জলদূষণের অন‍্যতম কারনপাশাপাশি বিভিন্ন উৎসব উৎযাপনের মাধ্যমে  জল দূষনের পরিমাণটাও  কম নয়। অনেক পরিবারের মধ্যেই লক্ষ‍্য করা যায় বাড়িতে পূজার পর পরে থাকা ফুল বেলপাতা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু এমনকি ছিড়ে যাওয়া ঠাকুরের ক‍্যালেন্ডার পর্যন্ত জলে ফেলার একটা রীতি দেখা যায়।  অতিরিক্ত ভার হিসাবে বইতে হয় ফূল বেলপাতাচালকলা কাশকলাগাছ ইত্যাদি ইত্যাদি। পূজোর পর প্রতিমা বিষর্জণ সে তো জল ছাড়া আর কিভাবে সম্ভব। আর প্রতিমার  গায়ে লেগে থাকা রঙ মিশে যাচ্ছে জলে। দূষিত হচ্ছে জল। এক সময় প্রতিমা তৈরী করতে ব‍্যবহার হতো জৈব ভঙ্গুর পদার্থ। আজকের দিনে ব‍্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন জৈব অভঙ্গুর পদার্থ। প্রাকৃতিক রঙের পরিবর্তে ব‍্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত রঙ যাতে মেশানো হয় লেডপারদক্রোমিয়াম ও ম‍্যাঙ্গানিজের মতো ভাড়ি ধাতু। তাছাড়াও প্লাস্টার অব্ প‍্যারিসের সাথে থাকছে ভার্নিস যাতে থাকে মিথানল আর গার্মিন তেল। ফলে জাদুর মতো বেরে যাচ্ছে জলের biological oxygen demand (BOD)একটি non profit toxic link এর পরিসংখ‍্যান অনুযায়ী ভারতীয় নদী গুলিতে প্রতিবছর প্রায় ১০০০০০  টি প্রতিমা নিরঞ্জন হয় । বারানসীর গঙ্গার ঘাটের তর্পণ হোক আর তোর্ষার পারের হুজুর সাহেবের মেলাই হোকপ্রতিমা নিরঞ্জন হোক বা যেকোন ঘাটে ছট পুজাই হোক দূষিত হচ্ছে জল । ব‍্যাঘাৎ ঘটছে জলজ জীব বৈচিত্র্য।

এভাবেই পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান জলমাটি বায়ু দূষনের কবলে জর্জরিত । উৎসবের মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে গোটা দেশ।  বিভিন্ন ওছিলায় আমরা যখন পরিবেশ কে আঘাত করছিতখন পরিবেশ ও আছে বদলা নেবার অপেক্ষায়। তার একটি ছোট নিদর্শন সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া কেরালার ভয়াবহ বন‍্যা। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগেই চলুন আমরা পরিবেশের সাথে একটা সমঝোতায় আসি। চুক্তি পত্র তে থাকতে পারে ১: যেকোন পূজা মিলিত ভাবে করে সংখ‍্যাটা  কমানো ২: প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব‍্যবহার কমানো ৩: পরিবেশ বান্ধব রঙের ব‍্যবহার করা ৪: মাইকের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাখা ৫: হোস পাইপের মাধ্যমে প্রতিমা নিরঞ্জন ৬: বাজি পটকা পোড়ানো সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা ৭ : পুজোর অবশিষ্টাংশ জলে না ফেলা ৮: কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্য দূষণ  নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এর বিধি মেনে চলা। তাহলে হয়তো আমরা পরিবেশ কে কিছুটা হলেও সতেজ রাখতে পারবো।